যেভাবে অভিনেতা হলেন মাসুম আজিজ

তরুণ মাসুম আজিজ তখন নিজেকে সব সময়ই গানের মানুষ বলে পরিচয় দিতেন। কিশোর বয়স থেকে তাঁর গান নিয়ে নানা পরিকল্পনা ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনার আগে থেকেই গান নিয়ে থাকতেন। গান গাওয়া ও বাদ্যযন্ত্র বাজানোতে তিনি ছিলেন দক্ষ। এই গান থেকে একসময় তিনি অভিনয়ের প্রেমে পড়েন। একসময় অভিনয় ঘিরেই ঘুরতে থাকে জীবন। নিভৃতচারী অভিনেতা মাসুম আজিজের অভিনেতা হিসেবে নাম লেখানোর ঘটনাটাও নাটকীয়ভাবেই।

মাসুম আজিজ তখন চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। সেই সময় আন্তবিশ্ববিদ্যালয় হল নাটক প্রতিযোগিতা হচ্ছিল। মাসুম আজিজকে হল থেকে বলা হয়, একটি নাটকের ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক করতে। সেই সময় ক্যাসেট দিয়ে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক তৈরি করা হতো। এই প্রসঙ্গে মাসুম আজিজ এর আগে এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, ‘নাটকের ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক করব। আমরা প্রস্তুতি নিয়ে বসে থাকতাম। নাটকের প্রধান চরিত্রের অভিনেতা শফিক কামাল নামে একজন ছিলেন। যথারীতি রিহার্সাল হচ্ছে কিন্তু কামাল ভাই আসেন না। হলে প্রভোস্ট স্যার তো কিছুটা বিরক্ত। তখন প্রভোস্ট স্যার আমাকে বললেন, মাসুম তুমি প্রক্সি দাও। প্রথম আমি অভিনয়ের প্রক্সি দিলাম।’

‘সনাতন গল্প–এর দৃশে্য মাসুম আজিজ ও সহশিল্পীরা। ২০ বছর আগে ছবিটির কাজ শুরু হয়েছিল

এভাবে সাত দিন প্রক্সি দিতে হয় মাসুম আজিজকে। সেই সময় অভিনয়ে প্রক্সি দিলেও অভিনয় নিয়ে তেমন কোনো ভাবনা ছিল না। এদিকে নাটকের অভিনেতা কামাল জানিয়ে দেন, তিনি নাটকটি করছেন না। এমন কথায় বিপদে পড়ে যায় আলাওল হল কর্তৃপক্ষ। সে সময় কোনো উপায় না পেয়ে হলের প্রভোস্ট শফিক হায়দার চৌধুরী মাসুম আজিজকে বলেন নাটকের শফিকের চরিত্রটিতে অভিনয় করতে। মাসুম আজিজ এই প্রসঙ্গে জানিয়েছিলেন, ‘স্যার বলায় আমি অভিনয় করলাম। একসময় কম্পিটিশনে আমি সেরা অভিনেতার পুরস্কার পেলাম। এরপরে চট্টগ্রামের থিয়েটারের যাওয়া–আসা শুরু হলো। অভিনয় করতে গিয়ে বসে থাকতাম। পরের বছর আবার ইন্টার হল ড্রামা কম্পিটিশনে আমার ওপর হল থেকে দায়িত্ব দেওয়া হলো নাটক নির্মাণের।’ সেই প্রথম ঋত্বিক কুমার ঘটকের ‘জ্বালা’ নাটকটি পরিচালনা করেন। নাটকটি মঞ্চায়ন হলে দর্শকদের প্রশংসা পায়। এই নাটকটির জন্যও আন্তবিশ্ববিদ্যালয় হলের সেরা নির্দেশক হয়েছিলেন মাসুম আজিজ।

পরপর দুবার হল থেকে সফল হয়ে মাসুম আজিজের মনে হয় তাঁকে দিয়ে অভিনয় হতে পারে। তত দিনে অভিনয়ের প্রতি ভালোবাসা জন্মেছে। কিন্তু মনে একটাই ভাবনা, অভিনয় করলে তাঁকে ঢাকায় যেতে হবে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করে ঢাকায় আসেন। সেই সময় শফিকুল আমান নামে সামাজবিজ্ঞান বিভাগের একজন শিক্ষক মাসুম আজিজকে পাঠান নাসির উদ্দীন ইউসুফের কাছে। ঢাকা থিয়েটার ঘুরাঘুরি করলেও তাঁর ভালো লাগছিল না। মাসুম আজিজের ভাষায়, ‘তাঁকে সেভাবে গুরুত্ব দিচ্ছিলেন না ঢাকা থিয়েটারের অনেকে। এর কারণ ছিল ক্যাম্পাসে তাঁর ছাত্ররাজনীতির সম্পর্ক।’ তখন বাধ্য হয়ে তিনি জীবিকা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। বিভিন্ন সময় চাকরি করলেও ১৫ দিনের মাথায় ছেড়ে দেন। তখনো অভিনয়ের নেশায় নিয়ম করে বাসায় রেওয়াজ করতেন। আর প্রিন্টিং সরবরাহের ব্যবসা করে জীবিকা নির্বাহ করতেন।
প্রিন্টিং সরবরাহের ব্যবসায়ের মধ্যেই একদিন ঢাকা পদাতিকের এস এম সোলায়মানের সঙ্গে পরিচয় হয়। এস এম সোলায়মান তাঁকে জামিল আহমেদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। মাসুম আজিজের হারমোনিয়াম দিয়ে, তাঁরই বাসায় চলত অনুশীলন। মাসুম আজিজ দূর থেকে দেখতেন সেগুলো। এতেই তাঁর ভালো লাগত। সেই সময় ‘ইন্সপেক্টর জেনারেল’ নাটকের ডিসি চরিত্রে অভিনয় করতেন মুকুল নামে একজন। এই অভিনেতার ফিল্মের ওপর একটি কোর্স করার কারণে শেষ মুহূর্তে নাটকটি থেকে সরে যান।

তখন নাটকটিতে অভিনয়ের সুযোগ পান মাসুম আজিজ। জড়িয়ে যান ঢাকা পদাতিকে। তখন অভিনয়ের জন্য ঢাকা থাকতে অনেক সরকারি–বেসরকারি চাকরি করেননি এই অভিনেতা। সেই থেকেই অনেক বাধা পেরিয়ে অভিনয়ের জন্য ঢাকায় মাসুম আজিজ। তিনি অভিনয়কে এতটাই ভালোবাসতেন যে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আমি যদি মঞ্চে অভিনয় করতে করতেই মারা যেতাম, তাহলে আমি হতাম ভাগ্যবান ব্যক্তি।’ দীর্ঘ প্রায় এক দশক মঞ্চে অভিনয় করে ১৯৮৫ সালে তিনি প্রথম বাংলাদেশ টেলিভিশনে অভিনয় করেন।

মাসুম আজিজ

একুশে পদকপ্রাপ্ত মঞ্চ ও টিভি নাটকের জ্যেষ্ঠ অভিনয়শিল্পী মাসুম আজিজ ক্যানসারের পাশাপাশি দীর্ঘদিন ধরে হার্টের সমস্যায়ও ভুগছিলেন। ২০১৭ সালে তাঁর হার্টে চারটি ব্লক ধরা পড়লে অস্ত্রোপচার করা হয়। শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় গত বৃহস্পতিবার সকালে তাঁকে ‘লাইফ সাপোর্টে’ নেওয়া হয়। চিকিৎসকেরা চেষ্টা করছিলেন, তবে সব চেষ্টা ব্যর্থ করে আজ সোমবার বেলা ২টা ৪৫ মিনিটে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। তাঁর মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী, সংস্কৃতিমন্ত্রী। এ ছাড়া সাংস্কৃতিক অঙ্গনের সব নাট্যদল ও নাটকের কলাকুশলীরা।

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন