দুই কন্যার বাইরে পড়ানো নিয়ে অনেক কথা শুনেছি: অভিনেত্রী ছন্দা

মায়ের সঙ্গে টাপুর টুপুর। ছবি: ফেসবুক

দুই মেয়ে তখন ঢাকার একটি স্কুলে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে। ব্যস্ততায় তাদের দেখাশোনা নিয়ে বেশ বিপাকেই পড়ে যান অভিনেত্রী গোলাম ফরিদা ছন্দা। অনেক সময় শুটিং বাতিল করতে হতো। কখনো শুটিং থেকে বিরতি নিয়ে স্কুলে যেতে হতো বাচ্চাদের আনতে। এমনও হয়েছে, মায়ের শুটিংয়ের জন্য যমজ বাচ্চা দুটি নানির বাড়িতে। এভাবে মেয়েদের নিজের মনের মতো সময় দিতে পারছিলেন না। তাই সিদ্ধান্ত নেন, তাদের দেশের বাইরের কোনো বোর্ডিং স্কুলে পড়াশোনা করাবেন। সেই সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে পরিবার, সহকর্মীসহ অনেকের মুখে নানা কথা শুনতে হয়েছে।

অভিনেত্রী ছন্দার দুই মেয়ে টাপুর ও টুপুর। তাঁরাও মায়ের মতো অভিনয়ের জগতে এসেছেন। নাম লিখিয়েছেন সিনেমায়। তবে শখের বসে এই অভিনয় শুধুই পড়াশোনার ফাঁকে। ছুটিতে দেশে এলেই তাঁদের বড় বা ছোট পর্দায় পাওয়া যেত। পড়াশোনায় ব্যস্ত সেই টাপুর ও টুপুর এবার ভারত থেকে পড়াশোনা শেষ করে এখন অপেক্ষা রয়েছেন ফলাফলের। বর্তমানে তাঁরা দেশেই রয়েছেন। তাঁদের মা ছন্দা জানালেন, তাঁদের আপাতত ভারতে পড়াশোনার পর্ব শেষ। এই সময় তিনি ফিরে গেলেন মেয়েদের দেশের বাইরে পড়াশোনা করানোর ‘কঠিন’ দিনগুলোতে।

অভিনয়শিল্পী টাপুর–টুপুর। ছবি: ফেসবুক

ছন্দাকে তখন নিয়মিত ছুটতে হতো শুটিংয়ে। যে কারণে চাইছিলেন মেয়েদের ভালো কোনো বোর্ডিং স্কুলে পাঠাতে। সেই সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে শুরুতেই হোঁচট খেলেন। কারণ, অনেকেই তাঁর এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত নন। ছন্দা বলেন, ‘আমার পরিবারের অনেকে আমার সিদ্ধান্ত নিয়ে নানা কথা বলতে শুরু করলেন। মেয়েদের পড়াশোনার জন্য দেশের বাইরে পাঠাব, এটা কেউ কেউ মানতেই পারেননি। আমার সহকর্মীদেরও অনেকেই বলছেন, কেন ভারতে পড়াশোনা করতে পাঠাচ্ছি মেয়েদের। অনেকেই মনে করত, ভারতে কেন পাঠাচ্ছি। তারপরে ছোট মেয়ে। সবকিছু মিলিয়ে নানান কথা শুনতে হয়েছে। সময়টা ছিল অনেক কঠিন।’

সবার কাছ থেকে নানা কথা শুনলেও নিজের ইচ্ছাতেই মেয়েদের দার্জিলিংয়ের একটি স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন। তখন দেশে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ত দুই মেয়ে। কঠিন সেই সিদ্ধান্ত প্রসঙ্গে ছন্দা জানান, দীর্ঘদিন ধরে তিনি খুঁজছিলেন এমন একটা স্কুল, যেখানে একসঙ্গে পড়াশোনা করানো হয়, সঙ্গে গান, ড্রয়িং, সাঁতার-নাচ-অভিনয় শেখানো হয়, আবার থাকার ব্যবস্থা আছে, তেমন একটি স্কুলে ভর্তি করাতে।

‘দেখলাম, এই স্কুল, এই কোচিং—এগুলো করানো তো আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। যাঁরা গৃহিণী, তাঁরা হয়তো সন্তানদের নিয়ে দৌড়াতে পারেন, আমার তো সেই উপায় ছিল না। একটি করতে গিয়ে অন্যটি হচ্ছিল না। তখন তাদের বাইরে বোর্ডিং স্কুলে পাঠিয়ে দিই। তারপরে যা দেখলাম, সেটা আমার জন্য সুবিধা হয়েছে।’

মায়ের সঙ্গে টাপুর–টুপুর। ছবি: ফেসবুক

সেই সুবিধাটা কেমন ছিল, সেই প্রসঙ্গে এই অভিনেত্রী বলেন,‘দেখা যেত, আমি বিরতি নিয়ে এক–দুই মাসের জন্য মাঝেমধ্যেই তাদের কাছে যেতাম। তখন পুরোটা সময় তাদের দিতে পারতাম। আবার দেশে এলেও তাদের কোয়ালিটি সময়টা দিতে পারতাম। তখন কাজ কম করতাম। আমি তাদের জন্য যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, সেটা সঠিক ছিল। যে কারণে, অনেকের কথা শুনেছি, কিন্তু দুই মেয়েকে নিয়ে আমার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসিনি। শুরু থেকেই আমি ফলাফলটা ঠিকমতো পাচ্ছিলাম।’—কথাগুলো বলেন টাপুর ও টুপুরের মা।

কালিম্পং, দার্জিলিংয়ের একটি স্কুল থেকে বর্তমানে তাঁরা এ লেভেল শেষ করেছেন। এখন ঢাকাতেই রয়েছেন। পরীক্ষার ফলাফল হলেই সিদ্ধান্ত নেবেন অন্য কোনো দেশে পড়তে যাওয়ার। তবে সেই সিদ্ধান্ত মেয়েরাই নেবেন। টুপুর জানান, মায়ের সংগ্রামের সঙ্গে তাঁরা দুই বোন শুরু থেকেই পরিচিত। সেটা তাঁরা কখনোই ভোলেননি।

টাপুর বলেন, ‘আমরা যখন বোর্ডিং স্কুলে ভর্তি হই, তখনো তো অনেক ছোট ছিলাম। মায়ের এমন সিদ্ধান্তে অনেক শকড হয়েছিলাম। অনেক মন খারাপ হয়েছিল। ওই বয়সে পরিবার থেকে দূরে থাকাটা যেকোনো শিশুর জন্য কষ্টের। পরে অভ্যস্ত হয়ে যাই। তখন বুঝতে পারি মা ভালো সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আমাদের আর বাইরে পড়াশোনা করতে খুব বেশি সমস্যা হয় না। সব সময়ই মায়ের স্ট্রাগলের কথাগুলো মনে থাকত। ভালো করতে হবে, সেই চেষ্টাই সব সময় করেছি।’

মায়ের সঙ্গে টাপুর টুপুর। ছবি: ফেসবুক

দেশের বাইরে পড়াশোনা করলেও টাপুর-টুপুর ছুটি পেলেই দেশে চলে আসতেন। তাঁদের বাবা নাট্যপরিচালক সতীর্থ রহমান। মা অভিনেত্রী। বলা যায়, শৈশব থেকেই তাঁরা লাইট–ক্যামেরা দেখে বড় হয়েছেন। কখনো বাড়িতে হতো শুটিং। আবার বাবা-মায়ের সঙ্গে চলে যেতেন শুটিংয়ে। একসময় আফসানা মিমি এই যমজ বোনকে অভিনয়ের প্রস্তাব দেন। মেয়েদের না নেই। এভাবেই ২০১৬ সালে বাবার ‘খোলস’ নাটক দিয়ে শুরু। তারপর অমিতাভ রেজা চৌধুরী, মাতিয়া বানু শুকু, চয়নিকা চৌধুরী, শুভ্র খানসহ অনেকের নাটক ও বিজ্ঞাপনে কাজ করেছেন। কিন্তু পড়াশোনার জন্য দার্জিলিংয়ে থাকার কারণে অভিনয়ে নিয়মিত হওয়া হতো না। টাপুর প্রথম আলোচনায় আসেন অনুদানের ছবি ‘দেশান্তর’-এ নাম লিখিয়ে। পরবর্তী সময় দুই বোনই একাধিক নাটকে অভিনয় করেছেন।

টাপুর জানান, পড়াশোনার জন্য তিন সিনেমা ছাড়তে হয়েছে। ঈদে মুক্তি পাওয়া ‘দাগি’ সিনেমায় অভিনয় করার কথা ছিল। ‘এখন আমরা আপাতত টুয়েলভ গ্রেডের পড়াশোনা শেষ করেছি। রেজাল্ট হয়নি। এখন কিছুটা সময় হাতে রয়েছে। বেশ কিছু কাজ নিয়ে কথা হচ্ছে, সেগুলোতে অভিনয় করব।’

মেয়েদের চাওয়াকেই সব সময় প্রাধান্য দিতে চান ছন্দা। দুই মেয়ে পরবর্তী সময় কোন দেশে পড়াশোনার জন্য যেতে চায়, সেখানেও পূর্ণ সহায়তা ও স্বাধীনতা দিতে চান। সবশেষে এই অভিনেত্রী বলেন, ‘দুই মেয়ে নিয়ে একা কতটা যুদ্ধ করেছি, তা কেবল আমিই জানি। সেটা আমার কন্যারাও অন্তর দিয়ে ধারণ করতে পেরেছে। কারণ, তারা সহযোগিতা না করলে ১০ বছরের বোর্ডিং লাইফ শেষ হতো না। এই পথচলায় আমার একটা চ্যালেঞ্জ ছিল নিজের সঙ্গে। সেখানে আমি পেরেছি। এই পারাটা সহজ ছিল না, পথ ছিল অনেক কঠিন।’

‘দেশান্তর’ সিনেমায় টাপুর ও মৌসুমী। ছবি: ফেসবুক
আরও পড়ুন