টোকিওতে জমেছে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব
টোকিওর হিবিয়া পার্ক ঘিরে শরতের নরম আলো আর ঠান্ডা বাতাস। গাছের পাতায় পাল্টাচ্ছে রং। এমন পরিবেশে জমে গেছে ৩৮তম টোকিও আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব। বিশ্বের নানা প্রান্তের চলচ্চিত্রপ্রেমী, নির্মাতা, তারকা আর সমালোচকেরা একত্র হয়েছেন জাপানের এই ঐতিহ্যবাহী আয়োজনকে ঘিরে। লালগালিচা থেকে সিনেমা হল, মাস্টারক্লাস থেকে টিফ লাউঞ্জ—সবখানেই এখন শুধু চলচ্চিত্রেরই জয়গান।
উৎসবের শুরু
২৭ অক্টোবর, সোমবার সন্ধ্যায় হিবিয়ার ঐতিহ্যবাহী তাকারাযুকা থিয়েটারে উৎসবের পর্দা ওঠে জাঁকজমকপূর্ণ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে। ১৬২ মিটার দীর্ঘ লালগালিচা ধরে হেঁটে যান বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা দুই শতাধিক চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব। লালগালিচায় ছিলেন অস্কারজয়ী পরিচালক পল শ্রেডার, বিখ্যাত ফরাসি অভিনেত্রী জুলিয়েট বিনোশ, মালয়েশীয় নির্মাতা চং কিট আউন, কোরিয়ান–চীনা পরিচালক ঝাং লু, স্বনামধন্য চিত্রগ্রাহক ক্রিস্টোফার ডয়েল ও আজারবাইজানি নির্মাতা হিলাল বাইদারোভ। জাপানি চলচ্চিত্রাঙ্গনের প্রতিনিধিত্ব করেছেন অভিনেত্রী তাকিউচি কুমি, পরিচালক ফুকাদা কোজি, নাকাগাওয়া রিউতারো, সাইতো কিয়োকো ও আরও অনেকে।
আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা বিভাগের জুরি সভাপতি হিসেবে দায়িত্বে আছেন ইতালীয় চলচ্চিত্র সমালোচক কার্লো চ্যাট্রিয়ান। তাঁর সহ-জুরি দলে রয়েছেন তাইওয়ানের অভিনেত্রী গিওয়েই লুন-মেই, ফরাসি সম্পাদক ম্যাথিউ ল্যাক্লাউ, জাপানি অভিনেতা ও নির্মাতা সাইতোহ তাকুমি এবং চীনা প্রযোজক ভিভিয়ান কু।
চলচ্চিত্রে নারী ও নতুন কণ্ঠ
গত বছরের মতো এ বছরও টিফে বিশেষভাবে গুরুত্ব পাচ্ছে চলচ্চিত্রে নারীর ক্ষমতায়ন। উদ্বোধনী সন্ধ্যায় ফরাসি তারকা জুলিয়েট বিনোশ তাঁর প্রথম পরিচালিত ছবি ‘ইন-আই ইন মোশন’-এর প্রিমিয়ারের জন্য উপস্থিত ছিলেন। উৎসবের নেভিগেটর তাকিউচি কুমির সঙ্গে আলাপচারিতায় বিনোশ বলেন, ‘যেকোনো শিল্পে আত্মনিয়োগ জরুরি। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের যুগে সৃজনশীল হওয়ার বিকল্প নেই।’ বিনোশের বক্তব্যে যেমন নারীর দৃঢ়তা প্রতিফলিত হয়, তেমনি চলচ্চিত্রের প্রতি তাঁর গভীর বিশ্বাসও। দর্শকেরাও সেই বার্তায় উচ্ছ্বসিত করতালিতে সাড়া দেয়।
সিনেমার প্রতি ভালোবাসার উৎসব
উৎসবের জুরি সভাপতি কার্লো চ্যাট্রিয়ান উদ্বোধনী বক্তব্যে বলেন, ‘চলচ্চিত্রপ্রেমী জাপানে এমন উৎসবে অংশ নিতে পেরে আমি গর্বিত। ১০ দিন ধরে আমরা বৈচিত্র্যময় সিনেমা দেখব, জানব পৃথিবীর নানা অজানা গল্প। এতে আমরা আরও সমৃদ্ধ হব—এটাই চলচ্চিত্রের শক্তি।’ চ্যাট্রিয়ানের এই বক্তব্য যেন পুরো উৎসবের মন্ত্র—চলচ্চিত্র মানুষকে কাছাকাছি আনে, পৃথিবীকে করে আরও বোধগম্য।
উদ্বোধনী চলচ্চিত্র ও সম্মাননা
৩৮তম আসরের উদ্বোধনী চলচ্চিত্র ছিল সাকামোতো জুনজির ‘ক্লাইম্বিং ফর লাইফ’। মঞ্চে তাঁর সঙ্গে ছিলেন বিখ্যাত অভিনেত্রী ইয়োশিনাগা সায়ুরি এবং তরুণ সহ–অভিনেত্রী নন। এভারেস্টজয়ী প্রথম নারী পর্বতারোহী তাবেই জুনকোর জীবনের অনুপ্রেরণায় নির্মিত এই চলচ্চিত্র দর্শককে আন্দোলিত করেছে। সেই মঞ্চেই টিফের আজীবন সম্মাননা পুরস্কার দেওয়া হয় এই চলচ্চিত্রের মূল চরিত্রে অভিনয় করা ইয়োশিনাগা সায়ুরিকে। ১২৪টি চলচ্চিত্রে অংশ নেওয়া এই তারকা চারবার জাপান একাডেমি পুরস্কার জিতেছেন মূল চরিত্রে সেরা অভিনয়ের জন্য। পুরস্কার তুলে দেন জুরি সভাপতি কার্লো চ্যাট্রিয়ান আর টিফ চেয়ারম্যান আন্দো হিরোইয়াসু দেন ফুলের তোড়া। ১৯৮৫ সালে অনুষ্ঠিত টিফ-এর প্রথম আসরের পর এবারই প্রথম কোনো জাপানি অভিনেত্রী এই সম্মান পেলেন। সায়ুরি বিনম্র কণ্ঠে বলেন, ‘এই স্বীকৃতি আমাকে গভীরভাবে অনুপ্রাণিত করেছে।’
সিনেমার রাজ্যে প্রতিযোগিতা
চেয়ারম্যান আন্দো হিরোইয়াসু উৎসবের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন ঘোষণা করেন। এ বছর টিফে ১৮৪টি চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হচ্ছে, সঙ্গে প্রশ্নোত্তর পর্ব, সিম্পোজিয়াম, মাস্টারক্লাস ও ‘টিফ লাউঞ্জ টক’-এর মতো নানা আয়োজন। বিশ্বের ১০৮টি দেশ ও অঞ্চল থেকে জমা পড়া ১ হাজার ৯৭০টি চলচ্চিত্রের মধ্য থেকে নির্বাচিত ১৫টি চলচ্চিত্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে ‘টোকিও গ্র্যান্ড প্রি’ পুরস্কারের জন্য।
এ তালিকায় রয়েছে মেসিডোনীয় নির্মাতা তিওনা স্ট্রুগার মিতেভসকার ‘মাদার’, কম্বোডীয় রিথি পানের প্রামাণ্যচিত্র ‘উই আর দ্য ফ্রুটস অব দ্য ফরেস্ট’, চীনা ঝাং লুর ‘মাদারটাং’, আজারবাইজানের হিলাল বাইদারোভের ‘সারমন টু দ্য ভয়েড’ এবং জাপানি নির্মাতা সাকাশিতা ইউইচিরোর ‘ব্লন্ড’। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নির্মিত ছবির মধ্যেও নজর কাড়ছে হ্যালি গেইটসের ইরাক যুদ্ধনির্ভর ‘এট্রোপিয়া’ এবং ফিলিস্তিনি নির্মাতা এনেমারি জাকিরের ‘প্যালেস্টাইন ৩৬’।
সিনেমার বাজারে জাপানের সক্রিয় উপস্থিতি
উৎসবের পাশাপাশি চলছে চলচ্চিত্র বাজার ‘টিফকম’-এর ২২তম আসর, যা অনুষ্ঠিত হচ্ছে টোকিওর হামামাতসুচো–কান ভবনে। এই বাজারে অংশ নিচ্ছে বিশ্বের নানা প্রযোজক, পরিবেশক ও স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম প্রতিনিধি। এখানে চলছে কো–প্রোডাকশন মিটিং, স্ক্রিনিং পিচ ও নতুন সিনেমা বিক্রির চুক্তি। ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত চলবে এই বাণিজ্যিক অংশ।
প্রতিদিন হিবিয়া, ইউরাকুচো, মারুনোচি আর গিনজা এলাকার হলগুলোয় ভিড় জমাচ্ছেন দর্শক। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চলছে প্রদর্শনী, প্রশ্নোত্তর পর্ব, আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। জাপানি দর্শকেরা যেমন তাঁদের নিজস্ব সিনেমাকে নতুনভাবে দেখছেন, তেমনি এশিয়া ও ইউরোপের নির্মাতাদের নতুন ভাষা ও দৃষ্টিকোণও তাঁদের মুগ্ধ করছে।
পর্দা নামবে ‘হ্যামনেট’-এ
৩৮তম টোকিও আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব চলবে ৫ নভেম্বর পর্যন্ত। সমাপনী প্রদর্শনী হিসেবে থাকছে অস্কারজয়ী পরিচালক ক্লোয়ে ঝাও নির্মিত উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের ‘হ্যামলেট’ নাটক রচনার প্রেক্ষাপটনির্ভর চলচ্চিত্র ‘হ্যামনেট’। উৎসবের শেষে ঘোষণা করা হবে বিভিন্ন বিভাগের সেরা চলচ্চিত্র, অভিনেতা, পরিচালক ও চিত্রনাট্যকারদের পুরস্কার। শরতের আবহে টোকিওতে তাই এখন সিনেমারই রাজত্ব, যেখানে প্রতিটি পর্দায় ফুটে উঠছে মানুষ, সময় ও অনুভবের গল্প।