মহামারির ক্ষতিকর প্রভাব কাটিয়ে উঠেছে টোকিও আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব

টোকিও আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব কমিটির চেয়ারম্যান হিরোইয়াসু আন্দো ফটো: প্রথম আলো

২৩ অক্টোবর কিছুটা সীমিত মাত্রায় হলেও আকর্ষণীয় একটি অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে ৩৬তম টোকিও আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব। ১০ দিনের এই উৎসবের সমাপ্তি টানা হবে ১ নভেম্বর প্রতিযোগিতামূলক কয়েকটি বিভাগের বিভিন্ন চলচ্চিত্রকে পুরস্কৃত করার মধ্য দিয়ে। সেই অর্থে উৎসব এখন অনেকটা মাঝামাঝি পর্যায়ে।
এবারের চলচ্চিত্র উৎসব অন্য যে আরেকটি কারণে অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে তা হলো, গত তিনটি উৎসব সীমিত আকারে আয়োজন করা হলেও করোনাভাইরাস–পরবর্তী সময়ে এবারের পূর্ণাঙ্গ আয়োজন সংকট কাটিয়ে ওঠার ইঙ্গিত দিতে পারবে কি না, সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা। এবারের চলচ্চিত্র উৎসবের সার্বিক আয়োজন এবং প্রাসঙ্গিক অন্যান্য বিভিন্ন দিক নিয়ে কথা বলার জন্য টোকিও আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব কমিটির চেয়ারম্যান শুক্রবার বিকেলে মিলিত হয়েছিলেন প্রথম আলোসহ অন্য কয়েকটি দেশের সাংবাদিকদের সঙ্গে। খোলামেলা আলোচনায় চলচ্চিত্র উৎসবের পাশাপাশি এশিয়ার ছায়াছবি জগতের মধ্যে আদান-প্রদান বৃদ্ধির সম্ভাবনা নিয়েও কথা বলেছেন হিরোইয়াসু আন্দো।

তিন বছর ধরে তিনি টোকিও আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব কমিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করে যাওয়ায় এবারের উৎসব শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত তাঁর পুরো সময়ের অনেকটা কেটেছে যেন সংকটের মধ্য দিয়ে। এবারই প্রথমবারের মতো পূর্ণাঙ্গ উৎসব আয়োজনের সুযোগ তিনি পাচ্ছেন এবং চলচ্চিত্র উৎসবের এ পর্যন্ত লক্ষণীয় হয়ে ওঠা বিভিন্ন অগ্রগতি এর সার্বিক সাফল্য সম্পর্কে তাঁকে আশাবাদী করে তুলছে। প্রথম আলোর পক্ষ থেকে শুরুতে তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, এবারের আয়োজনের মধ্য দিয়ে টোকিও আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব আবারও এর গতানুগতিক ধারায় ফিরে যেতে সক্ষম হবে বলে তিনি মনে করেন কি না?

আরও পড়ুন

প্রশ্নের উত্তরে হিরোইয়াসু আন্দো বলেছেন, এই প্রশ্ন টোকিও আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের সামনেই কেবল বিরাজমান নেই, একই সঙ্গে বরং বিশ্বের অধিকাংশ অন্যান্য চলচ্চিত্র উৎসবগুলোকেও এই একই সমস্যার মোকাবিলা করতে হচ্ছে, তাই বলা যায় অন্যান্য উৎসবও এই দিকের ওপর ঘনিষ্ঠ নজর রেখেছে এবং এখনো রেখে যাচ্ছে। এসবের মধ্যে বেশ কয়েকটি প্রথম সারির চলচ্চিত্র উৎসব মহামারির সময় বন্ধ রাখা হলেও টোকিওর আয়োজন কিন্তু পুরোপুরি থেমে যায়নি। গত তিনটি উৎসব সীমিত আকারে অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং বিদেশি অতিথিদের সরাসরি উপস্থিতি যেসব ক্ষেত্রে সম্ভব হয়নি, সেগুলোর বেলায় অনলাইন আয়োজনের মধ্য দিয়ে সেই ঘাটতি পূরণ করে নেওয়ার চেষ্টা টোকিও করেছে। তবে সে রকম আয়োজন যে সত্যিকার অর্থে চলচ্চিত্র উৎসবের বিকল্প হতে পারে না, তা গত কয়েকটি উৎসব পরিষ্কারভাবে দেখিয়ে দিয়েছে। যেকোনো চলচ্চিত্র উৎসবের গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক হচ্ছে, দর্শকদের জন্য ছায়াছবি জগতের সাম্প্রতিক অগ্রগতির বিভিন্ন দিক বুঝে উঠতে সাহায্য করা। তবে মহামারির সময়জুড়ে আয়োজিত উৎসবের ছবির প্রদর্শনীগুলোতে দর্শক উপস্থিতি সীমিত থাকায় সেদিকের অর্জন বলা যায় অনেকটাই থেমে ছিল। তবে এবারের উৎসব আয়োজকদের এ কারণে আবারও আশাবাদী করে তুলছে যে এখন পর্যন্ত দর্শকসংখ্যা হচ্ছে খুবই উৎসাহব্যঞ্জক। এ বছর এখন পর্যন্ত বিভিন্ন হলে দেখানো উৎসবের ছবিগুলোতে টিকিট বিক্রির সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে ২৭ শতাংশ এবং আগামী কয়েক দিনে তা আরও বৃদ্ধি পাবে বলে আমরা ধারণা করছি।

এ ছাড়া এবারের উৎসবে বিদেশি অতিথির সংখ্যাও এক বছর আগের তুলনায় অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। গত বছর মাত্র ১০৪ জন বিদেশি অতিথি চলচ্চিত্র উৎসবে উপস্থিত থাকলেও এবার সেই সংখ্যা দুই হাজার ছাড়িয়ে গেছে।

অন্যদিকে এবারের উৎসব ঘিরে অন্যান্য দেশ থেকে সারা পাওয়াও ছিল খুবই উৎসাহব্যঞ্জক। এবারের উৎসবের জন্য ছবি জমা পড়েছে দুই হাজারের কাছাকাছি এবং উৎসব চলাকালীন দেখানো ছবির সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়ে ২১৯টিতে দাঁড়িয়েছে। সব মিলিয়ে বলা যায়, মহামারির সংকট আমাদের এই চলচ্চিত্র উৎসব কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছে।

টোকিও আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব কমিটির চেয়ারম্যান হিরোইয়াসু আন্দো ফটো: প্রথম আলো

প্রথম আলোর পক্ষ থেকে আরও যা জানতে চাওয়া হয়েছিল তা হলো, টোকিও আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের বিশ্বের নেতৃস্থানীয় বিভিন্ন চলচ্চিত্র উৎসবের পর্যায়ে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও প্রচারগত দিক থেকে এই উৎসবের পিছিয়ে থাকার কারণ কী এবং এই অবস্থা সংশোধন করে নিতে বিশেষ কোনো পদক্ষেপ টোকিও উৎসব কমিটি বিবেচনা করে দেখছে কি না। বিশেষ করে এশিয়ার নেতৃস্থানীয় একটি চলচ্চিত্র উৎসব হওয়া সত্ত্বেও এমনকি বুসান উৎসবের তুলনায় প্রচারগত দিক থেকে টোকিও সম্ভবত কিছুটা পিছিয়ে আছে। এর পেছনে বিশেষ কোনো কারণ রয়েছে বলে তিনি মনে করেন কি না এবং মনে করে থাকলে তা কাটিয়ে উঠতে বিশেষ কোনো পদক্ষেপ টোকিও গ্রহণ করছে কি না?

উত্তরে হিরোইয়াসু আন্দো বলেছেন যে টোকিও চলচ্চিত্র উৎসব ভেনিস কিংবা কান উৎসবের মতো সমৃদ্ধ অতীত ঐতিহ্য বহন করা চলচ্চিত্র উৎসব নয়। এটাকে বরং নতুন চলচ্চিত্র উৎসব হিসেবে দেখা যেতে পারে। ভেনিসের যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৩৭ সালে এবং এর কয়েক বছর পর কান সেই পথে এগিয়ে যায়। সেদিক থেকে টোকিও উৎসবের সূচনা ১৯৮৫ সালে হওয়ায় ইউরোপের ঐতিহ্যময় উৎসবগুলোর তুলনায় আমাদের এই আয়োজন হচ্ছে অনেকটাই নতুন এক চলচ্চিত্র উৎসব। ফলে টোকিও চলচ্চিত্র উৎসবের সূচনার সময় থেকেই আমরা আমাদের লক্ষ্য অনেকটাই সীমিত রেখেছি। যেমন মূলত এশিয়া, বিশেষ করে পূর্ব এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার চলচ্চিত্রশিল্পের বিকাশে অবদান রাখার ওপর অনেক বেশি গুরুত্ব আমরা আরোপ করছি।

তবে বলতে বাধা নেই যে এখানেও বুসান কিংবা হংকংয়ের তুলনায় প্রচারগত দিক থেকে টোকিওর পিছিয়ে থাকা অবশ্যই গ্রহণযোগ্য নয়। এর কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে উৎসবের সময় সূচির দিকে আমাদের তাকিয়ে দেখতে হয়েছে। অনেকটা কাছাকাছি সময়ে একাধিক চলচ্চিত্র উৎসবের আয়োজন স্বাভাবিকভাবেই সবগুলোর দিকে মনোযোগ আকৃষ্ট করতে ব্যর্থ হয়। ফলে একসময় আমাদের মনে হয়েছিল যে বছরের ভিন্ন কোনো এক সময়ে উৎসবের আয়োজন হয়তো আরও বেশি ভালো ফলাফল নিয়ে আসতে পারে। তবে সে ক্ষেত্রেও সমস্যা রয়ে গেছে। অক্টোবরের শেষ দিক থেকে নভেম্বর মাসের শুরুর দিক পর্যন্ত সময় হচ্ছে জাপানের খুব ভালো সময়গুলোর অন্যতম। গ্রীষ্ম শেষ হয়ে যাওয়ার পর শীতের আগমনের আগে সবচেয়ে বেশি রৌদ্রোজ্জ্বল দিন বছরের এই সময়ে দেখা যায়। এ ছাড়া গ্রীষ্মের দাবদাহের পর বছরের এ সময়ে তাপমাত্রাও থাকে খুবই আরামদায়ক। ফলে সময়সূচি অপরিবর্তিত রেখে অন্য যে দিকটির ওপর আলোকপাত করার মধ্য দিয়ে আমাদের এই চলচ্চিত্র উৎসবকে আরও বেশি আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য বিশেষ যে দিকটির ওপর আমরা এখন মনোনিবেশ করছি, তা হলো টোকিওর আকর্ষণ। সমৃদ্ধ ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের পাশাপাশি সর্বাধুনিক বিভিন্ন অগ্রগতির এক সমৃদ্ধ সমাহার হচ্ছে জাপানের রাজধানী। অসংখ্য হোটেল, নানা রকম সুস্বাদু রকমারি খাবারের রেস্তোরাঁ, জাদুঘর এবং অন্যান্য বিনোদনব্যবস্থার ব্যাপক উপস্থিতির কারণে বিদেশি অতিথিদের কাছে যে শহর ক্রমেই আরও বেশি আকর্ষণীয় এক গন্তব্য হয়ে উঠছে। চলচ্চিত্র উৎসবের আয়োজনকে এসব কিছুর সঙ্গে সহজেই মিলিয়ে নেওয়া সম্ভব এবং সেই লক্ষ্যে আমরা এখন কাজ করছি। তবে তা সত্ত্বেও বলতে হয় যে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নয়, বরং এশিয়া মহাদেশের প্রধান একটি চলচ্চিত্র কেন্দ্র হিসেবে টোকিওর বিকাশ সেই পথ ধরে অর্জন করা সম্ভব হবে বলে আমরা মনে করি এবং এ কারণেই আমাদের এই চলচ্চিত্র উৎসবেও এশিয়াকেন্দ্রিক নানা রকম আয়োজন আমরা অন্তর্ভুক্ত রাখছি।

সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচিত হয়ে ওঠা জাপানি পরিচালক হিরোকাজু করে-এদা যেমন মাত্র শেষ হওয়া এশিয়ার নবীন চলচ্চিত্র নির্মাতাদের জন্য আয়োজিত বিশেষ একটি সেমিনার পরিচালনা করেছেন, যেখানে তিনি ছায়াছবি নির্মাণের খুঁটিনাটি বিভিন্ন দিক তাঁর নবীন এশীয় সহকর্মীদের সামনে তুলে ধরেন।

এ ছাড়া চীনসহ এশিয়ার অন্য দেশের সঙ্গে যৌথ ছবি নির্মাণও আমরা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে দেখছি। চীনের সঙ্গে আগে থেকে এ বিষয়ে একটি চুক্তি জাপানের থাকলেও এশিয়ার অন্য প্রতিবেশীদের সঙ্গেও একই ধরনের চুক্তিতে উপনীত হওয়া আমরা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে আসছি। এভাবেই ছায়াছবির সঙ্গে সম্পর্কিত অন্যান্য বিভিন্ন দিকের ওপরও আমরা নজর দিচ্ছি, এশিয়ার চলচ্চিত্রশিল্পের ভবিষ্যতে আরও সামনে এগিয়ে যাওয়ায় যা সহায়তা করবে বলে আমাদের বিশ্বাস।

ছবির ক্যাপশন:
১.
২. সাক্ষাৎকারে প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন হিরোইয়াসু আন্দো ফটো: প্রথম আলো