নগ্ন হওয়া যাবে না
গতকাল মঙ্গলবার থেকে শুরু হয়েছে ৭৮তম কান চলচ্চিত্র উৎসব। প্রথম দিনেই ‘পোশাক বিতর্ক’-এ উত্তপ্ত উৎসব। কারণ, এবার উৎসব শুরুর এক দিন আগে কানের লালগালিচায় ‘নগ্ন’ বা ‘অতিরিক্ত লম্বা’পোশাকের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। এটা অবশ্য নতুন নয়, তবে এবারে তা আরও কঠোরভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে। ২০২৫ সালের কানে চলচ্চিত্র উৎসবকে ঘিরে যে পোশাকবিধি চালু হয়েছে, তার পেছনে রয়েছে দীর্ঘ ইতিহাস।
গতকাল উৎসবের উদ্বোধনী দিনেই আয়োজকেরা জানিয়ে দেন, ‘ভদ্রতার খাতিরে, উৎসবের লালগালিচায় কিংবা অন্য যেকোনো স্থানে নগ্নতা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।’
এই সিদ্ধান্তে অনেকেই বিস্মিত। কারণ, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কানের লালগালিচা ছিল ‘নগ্ন’ পোশাকের জন্য সুপরিচিত। গত বছর সুপারমডেল বেলা হাদিদ স্বচ্ছ পোশাকে হাজির হয়েছিলেন। ইসাবেল হুপার, নাওমি ক্যাম্পবেল, কেনডাল জেনারের মতো তারকারাও এর আগে একই ধরনের পোশাক পরেছেন। যেখানে তাঁদের ঊর্ধ্বাঙ্গ ছিল উন্মুক্ত। তবে এবার কানে নিভারণ হওয়া একেবারেই নিষিদ্ধ।
এই নতুন বিধিনিষেধ এমন সময়ে এল, যখন বিশ্বজুড়ে সংস্কৃতিগত রক্ষণশীলতার বাড়বাড়ন্ত দেখা যাচ্ছে। অনেকেই মনে করছেন, এটি নারীদের শরীরের ওপর সামাজিক নিয়ন্ত্রণ আরোপের একটি প্রকাশ—এ ক্ষেত্রেও তা ‘ভদ্রতা’র নামে। ফ্যাশন-বিশ্বের জনপ্রিয় ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্ট ‘বোরিং নট কম’ মন্তব্য করেছে, ‘ঈশ্বর না করুন, কেউ যদি ঊর্ধ্বাঙ্গ দেখিয়ে ফেলে!’ সঙ্গে আলোচিত ইনস্টাগ্রাম হ্যান্ডলটি আরও লিখেছে, ‘রক্ষণশীলতার নীরব প্রত্যাবর্তন।’
অনেকে আবার উৎসবে ‘দ্বৈতনীতি’ নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে। ‘বোরিং নট কম’ মন্তব্য করেছে, ‘গালিচায় উন্মুক্ত হওয়া নিষিদ্ধ, অথচ প্রেক্ষাগৃহে পর্দায় তো তা দৃশ্যমান—এসব (নিষেধাজ্ঞা) প্রায় সব সময়ই নারীদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।’
২০১৫ সালে যখন নারীদের হাই হিল পরা উৎসবে নিষিদ্ধ হয়, তখনো বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছিল। একই উৎসব আবার রোমান পোলানস্কির মতো বিতর্কিত পরিচালককেও স্বাগত জানায়, যিনি ১৯৭৮ সালে একজন অপ্রাপ্তবয়স্ককে ধর্ষণের মামলায় দণ্ড ঘোষণার আগেই যুক্তরাষ্ট্র থেকে পালিয়ে যান।
নারীদের পোশাক নিয়ে কানের দ্বৈত আচরণের আরও একটি নজির হলো ২০১৬ সালের বুরকিনি (মুখ, হাত ও পা ছাড়া পুরো শরীর ঢেকে রাখে এমন পোশাক) নিষেধাজ্ঞা। তখন বলা হয়েছিল, ধর্মীয় কারণে ঢেকে থাকা মুসলিম নারীর এই পোশাক ‘সর্বজনীন শৃঙ্খলার জন্য হুমকি।
পরে লেখক শাহেদ ইজায়েদি ‘স্টাইলিস্ট’ সাময়িকীতে লিখেছেন, ‘একদিকে যে নারী নিজের বিশ্বাস থেকে শরীর ঢেকে রাখেন, তিনি অগ্রহণযোগ্য। অন্যদিকে স্বচ্ছ পোশাক পরলেও তাঁকে অশালীন বলা হয়। আপনাকে সংযত হতে হবে, তবে বেশি সংযতও চলবে না—এ যেন অদ্ভুত এক পরিস্থিতি।’
নতুন নির্দেশনা শুধু নগ্নতা নয়, বড় বিশালাকৃতির পোশাকও নিষিদ্ধ করেছে। কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, এ ধরনের পোশাক চলাচলে বিঘ্ন ঘটায়। প্রশ্ন উঠেছে, লালগালিচার উদ্দেশ্য আসলে কী? আজকালকার তারকারা নির্দিষ্ট ব্র্যান্ডের পোশাক পরার জন্য প্রচুর অর্থ পান। ফলে সিনেমার চেয়ে ফ্যাশনই যেন মুখ্য হয়ে উঠেছে।
তবে কান কিছুটা ব্যতিক্রম, এমনটাই মত ফ্যাশন–বিশেষজ্ঞদের। ২০২৩ সালে গার্ডিয়ানে একজন বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানগুলোতে পোশাক নিয়ে অনেক বেশি অর্থ ব্যয় হয়, কানে সে চাপ অনেক কম।’ তবু কান এখন একরকমের ফ্যাশন সপ্তাহ হয়ে উঠেছে, যা অনেক সময় চলচ্চিত্রের গুরুত্বকেই ছাপিয়ে যায়।
আর চলতি বছর নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হলো উৎসব শুরুর মাত্র এক দিন আগে। যার কারণে পোশাক পরিকল্পনায় ব্যস্ত থাকা স্টাইলিস্টদের জন্য এটি যেন বড় একটি আঘাত।
হলিউড তারকা হ্যালি বেরি, যিনি এবার কানে বিচারকের দায়িত্বও পালন করছেন, তিনিও এই নিষেধাজ্ঞায় পরেছেন। কারণ, তার জন্য নির্ধারিত পোশাকটি অতিরিক্ত বড় হওয়ায় সেটি আর পরা যাচ্ছে না। তবে নগ্নতা–সংক্রান্ত বিধিনিষেধকে তিনি ‘ভালো সিদ্ধান্ত’ হিসেবেই দেখছেন।
লম্বা পোশাক–বিষয়ক নিষেধাজ্ঞাটি কিছুটা যৌক্তিক মনে করছেন কেউ কেউ। কারণ, বড় পোশাক পরা ইনফ্লুয়েন্সারদের ভিড়ে লালগালিচা রীতিমতো অচল হয়ে পড়ছিল, এটা তো যে কেউই স্বীকার করবেন।
২০১৮ সালেই উৎসব পরিচালক থিয়েরি ফ্রেমো সেলফি নিষিদ্ধ করেছিলেন, যুক্তি ছিল—‘লালগালিচায় বিশৃঙ্খলা তৈরি করে, যা উৎসবের মর্যাদার সঙ্গে যায় না।’ তবে এবার কী সত্যিই কড়া হাতে এই নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়ন করা হবে? উৎসব কর্তৃপক্ষ বলেছে, নিয়ম না মানলে লালগালিচায় প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে বাধ্য হবেন তাঁরা।
কিন্তু অতীত বলছে, এই নিয়ম সব সময় সবার জন্য সমানভাবে প্রয়োগ হয়নি। গুঞ্জন আছে, এই নিয়ম ‘আসল তারকাদের’ জন্য কার্যকর হবে না। যাঁরা শুধুই ফটোশুটে এসে ছবি তোলেন, সিনেমা না দেখেই বেরিয়ে যান (অধিকাংশ তারকাই তা–ই করেন) এই নিয়ম কেবল তাঁদের জন্যই।
তথ্যসূত্র: সিএনএন, বিসিসি