নার্সের ভুলে ‘ব্রুস লি’, রাস্তায় মার খাওয়া ছেলেটিই কুংফুর রাজা

ব্রুস লি। আইএমডিবি

১৯৪০ সালের ২৭ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের সান ফ্রান্সিসকোর চায়নাটাউনের এক হাসপাতালে জন্ম নেয় এক হালকা-পাতলা শিশু। জন্মের সঙ্গেই জড়িয়ে যায় এক কাকতাল—মা গ্রেস ছেলের নাম রাখতে চেয়েছিলেন ‘ইউমেন ক্যাম’; কিন্তু হাসপাতালের নার্স নামটি ঠিকমতো উচ্চারণ করতে না পারায় বার্থ সার্টিফিকেটে লিখে ফেলেন অন্য এক নাম ‘ব্রুস লি’। মা–বাবা আপত্তি করেননি, নাম বদলানোর কথাও আর ওঠেনি। তখন কি ভেবেছিলেন, এই নামই একদিন হয়ে উঠবে বিশ্ব চলচ্চিত্র ও মার্শাল আর্টের ইতিহাসের প্রতীক—পূর্ব ও পশ্চিমের সাংস্কৃতিক দূরত্ব ভাঙার এক নীরবকিন্তু প্রবল শরীরী ভাষা!

যদিও জন্ম যুক্তরাষ্ট্রে, তবে ব্রুস লির পারিবারিক শিকড় ছিল হংকংয়ে। জন্মের এক বছরের মধ্যেই ক্যান্টনিজ অপেরার জনপ্রিয় শিল্পী বাবা লি হুই চোয়েন পরিবার নিয়ে ফিরে যান হংকংয়ে। সেখানেই মঞ্চ, আলো ও ক্যামেরা আর অভিনয়ের আবহে বেড়ে ওঠে এই শিশু, যাঁর জীবন মাত্র ৩২ বছরেই থেমে গেলেও প্রভাব রেখে গেছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম। আজও ব্রুসলিকে নিয়ে চর্চা হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁর ছবি ও পোস্টার শেয়ার হয়।

শিশুশিল্পী থেকে আত্মগঠনের কঠিন পথ
ফিল্ম স্টুডিওই ছিল ব্রুস লির প্রথম খেলার মাঠ। বাবার হাত ধরে ছোটবেলা থেকেই ক্যামেরা, আলো, সেট—সবই তাঁর কাছে হয়ে ওঠে স্বাভাবিক পরিবেশ । মাত্র ছয় বছর বয়সে ‘দ্য বিগিনিং অব আ বয়’ ছবিতে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে শুরু হয় তাঁর চলচ্চিত্রযাত্রা । সমালোচকদের মতে, সাত বছর বয়সেই ক্যামেরার সামনে তাঁর উপস্থিতি ছিল বিস্ময়করভাবে স্বচ্ছন্দ—চোখের দৃষ্টি স্থির, শরীরী ভঙ্গি নিয়ন্ত্রিত, যেন বয়সের আগেই তিনি বুঝে ফেলেছিলেন ফ্রেমের ভাষা।

সিনেমার দৃশ্যে ব্রুস লি। আইএমডিবি

কিন্তু পর্দার এই শান্ত শিশুটির বাস্তব জীবন ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত। কৈশোরে পা রাখার আগেই হংকংয়ের রাস্তায় ব্রুস লি পরিচিত হয়ে ওঠেন ঝগড়া আর মারামারির জন্য। সমবয়সীদের নিয়ে ছোটখাটো একটি ‘গ্যাং’ তৈরি করেন। অন্যায়ের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া আর জমে থাকা আগ্রাসী মানসিকতা তাঁকে বারবার সংঘর্ষে জড়িয়ে ফেলে।
সমস্যা ছিল একটাই—শরীর। ছিলেন হালকা-পাতলা। শক্তিশালী প্রতিপক্ষের কাছে বহুবার মার খেতে হয়েছে তাঁকে। এই অপমান, ক্ষত আর ব্যর্থতার অভিজ্ঞতাই ধীরে ধীরে তাঁকে ঠেলে দেয় মার্শাল আর্টের দিকে। কুংফু তাঁর জীবনে আসে সমাধান হিসেবে নয়; বরং আত্মরক্ষার জরুরি প্রয়োজন হিসেবে। এরপর যুক্ত হয় উইং-চুন-চীনা আত্মরক্ষার এক সূক্ষ্ম, নিয়ন্ত্রণনির্ভর শৈলী, যেখানে শক্তির চেয়ে বেশি গুরুত্ব পায় সময়জ্ঞান, দূরত্ব আর প্রতিক্রিয়ার বুদ্ধিমত্তা। দিনের পর দিন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা চলা কঠোর অনুশীলনই ব্রুস লিকে ধীরে ধীরে বদলে দেয়।

রিং, ছন্দ আর ‘খুদে ড্রাগন’
সেন্ট ফ্রান্সিস জেভিয়ার স্কুলে পড়ার সময় একটি ঘটনাই প্রথমবারের মতো প্রকাশ্যে জানিয়ে দেয়—ব্রুস লি সাধারণ ছাত্র নন । দুর্বিনীত আচরণে বিরক্ত হয়ে এক শিক্ষক, ব্রাদার এডওয়ার্ড, তাঁকে শাস্তি দিতে স্কুলের বক্সিং রুমে নিয়ে যান। উদ্দেশ্য ছিল কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা। শিক্ষক তাঁকে রিংয়ে নামতে বলেন।
বাস্তবতা হলো, সে সময় ব্রুসের কোনো আনুষ্ঠানিক বক্সিং প্রশিক্ষণ ছিল না; কিন্তু রিংয়ের ভেতরে দাঁড়িয়েই তিনি নির্ভর করেন নিজের শেখা উইং-চুন কৌশল, দ্রুত পা চালনা আর আত্মবিশ্বাসের ওপর । কয়েক মিনিটের মধ্যেই অভিজ্ঞ শিক্ষককে পরাস্ত করেন তিনি। শাস্তির বদলে সেখানে জন্ম নেয় বিস্ময়। ব্রাদার এডওয়ার্ড রাগ না করে মুগ্ধ হন এবং ব্রুসকে স্কুল বক্সিং দলে নেন। সেই বছরই আন্তবিদ্যালয় টুর্নামেন্টে তিন বছর ধরে অপরাজিত চ্যাম্পিয়নকে হারান ব্রুস লি।

সিনেমার দৃশ্যে ব্রুস লি। আইএমডিবি

এ সময়েই তাঁর মার্শাল আর্টে যুক্ত হয় আরেক গুরুত্বপূর্ণ মাত্রা—নৃত্য । খুব কম মানুষই জানেন, ব্রুস লি ছিলেন দক্ষ চা-চা নৃত্যশিল্পী এবং কিশোর বয়সেই হংকংয়ে চা-চা প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন। নাচ থেকে পাওয়া ভারসাম্য, পায়ের সূক্ষ্ম কাজ, শরীরের ঘূর্ণন পরে এসে মিশে যায় তাঁর মার্শাল আর্টে। ফলে তাঁর লড়াই হয়ে ওঠে শক্তির প্রদর্শন নয়; বরং গতি ও ছন্দে গড়া এক জীবন্ত কোরিওগ্রাফি। ১৮ বছর হওয়ার আগেই তিনি অভিনয় করেন ২০টির বেশি হংকং চলচ্চিত্রে। দর্শকের কাছে তাঁর নাম হয়ে ওঠে ‘লি সিউ লুং’ বা খুদে ড্রাগন।

যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় নির্বাসন
একটি মারামারির ঘটনায় পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার পর পরিবারের উদ্বেগ চরমে পৌঁছায়। মা বুঝে যান, এই পরিবেশে ছেলেকে রাখা আর নিরাপদ নয়। সেই সিদ্ধান্ত থেকেই ব্রুস লিকে পাঠানো হয় যুক্তরাষ্ট্রে। ষাটের দশকের শুরুতে সিয়াটলে শুরু হয় নতুন অধ্যায়—যা ছিল নির্বাসনের মতো।

পড়াশোনা, বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচ, বাসা ভাড়া, দৈনন্দিন ব্যয়—সব মিলিয়ে অর্থকষ্ট ছিল নিত্যসঙ্গী । খণ্ডকালীন কাজ করতে হয়েছে তাঁকে। এই সংগ্রামের মধ্যেই ব্রুস নতুন করে নিজেকে গড়তে শুরু করেন। সিয়াটলেই তিনি কুংফু শেখানো শুরু করেন এবং ধীরে ধীরে মার্শাল আর্ট স্কুল গড়ে তোলেন। এখানেই তাঁর জীবনে আসে লিন্ডা এমেরি। ছাত্রী থেকে ভালোবাসা, ভালোবাসা থেকে বিয়ে, ১৯৬৪ সালে তাঁদের বিয়ে হয় । ১৯৬৫ সালে জন্ম নেয় তাঁদের ছেলে ব্র্যান্ডন লি।

এ সময়েই জন্ম নেয় ব্রুস লির চিন্তার সবচেয়ে বড় অবদান—জিৎ কুনে দো । কুংফু, বক্সিং, ফেন্সিং আর বাস্তব স্ট্রিট ফাইটের অভিজ্ঞতা মিলিয়ে তিনি বোঝেন, কোনো একক স্টাইলে আটকে থাকা অর্থহীন। জিৎ কুনে দো কোনো নির্দিষ্ট ধারা নয়, এটি ‘ফর্মহীনতার দর্শন’। পরিস্থিতি অনুযায়ী নিজেকে বদলাতে পারাই প্রকৃত শক্তি—এই উপলব্ধিই তাঁকে একজন দার্শনিক শিল্পীতে রূপ দেয় ।

হলিউডে প্রশিক্ষক
হলিউডে ব্রুস লি তখন পরিচিত নাম; কিন্তু অভিনয়ের জন্য নয়। তিনি ছিলেন তারকাদের প্রশিক্ষক। স্টিভ ম্যাককুইন, জেমস কোবার্ন, করিম আবদুল জব্বার নিয়মিত তাঁর কাছে প্রশিক্ষণ নিতেন। সে সময় এক ঘণ্টার প্রশিক্ষণের পারিশ্রমিক ছিল ২৫০ ডলার—অস্বাভাবিক বড় অঙ্ক ।

কিন্তু অভিনয়ের জগতে তিনি ছিলেন অবহেলিত। কারণ একটাই—তিনি এশিয়ান। ১৯৬৬ সালে এবিসির সিরিজ ‘দ্য গ্রিন হর্নেট’-এ ‘কেটো’ চরিত্রে অভিনয় করে দর্শকের নজর কাড়লেও মূল নায়কের স্বীকৃতি পাননি তিনি। এরপর ‘কুং ফু’ সিরিজে এশীয় চরিত্র দেওয়া হয় শ্বেতাঙ্গ অভিনেতা ডেভিড ক্যারাডাইনকে । তখনই ব্রুস বুঝে যান, নিজের পথ নিজেরই তৈরি করতে হবে ।

সিনেমার দৃশ্যে ব্রুস লি। আইএমডিবি

হংকংয়ে ফিরে ইতিহাস লেখা
হংকংয়ে প্রত্যাবর্তন হলিউডে বারবার ঠেকে গিয়ে ১৯৭০ সালের শেষ দিকে ব্রুস লি যখন হংকংয়ে ফেরেন, তখন তিনি আর কেবল একজন প্রতিভাবান মার্শাল আর্টিস্ট নন, তিনি ভেতরে–ভেতরে এক গভীর ক্ষোভ আর দৃঢ়সংকল্প বয়ে আনছিলেন। এ সময়েই তার দেখা হয় প্রযোজক রেমন্ড চোয়ের সঙ্গে, যিনি সদ্য প্রতিষ্ঠিত গোল্ডেন হার্ভেস্ট স্টুডিওকে দিয়ে হংকং চলচ্চিত্রে নতুন এক ধারা গড়তে চাইছিলেন। ব্রুস লি ও রেমন্ড চোয়ের এই হাত মেলানোই পরবর্তী কয়েক বছরে কুংফু চলচ্চিত্রের ইতিহাস বদলে দেয়। ১৯৭১ সালে মুক্তি পায় প্রথম ছবি ‘দ্য বিগ বস’ (চীনা নাম: তাং শান দা শিওং)। থাইল্যান্ডের পটভূমিতে নির্মিত ছবিটি প্রথমে খুব বড় প্রত্যাশা নিয়ে মুক্তি পায়নি; কিন্তু হলঘরে বসে দর্শকেরা যা দেখলেন, তা তাঁদের পূর্বপরিচিত কুংফু নায়কের চেনা ছক ভেঙে দিল। ব্রুস লির শরীরী ভাষা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন—অস্বাভাবিক গতি, আকস্মিক বিস্ফোরণ আর চোখেমুখে জমে থাকা আগুন। প্রথম ফ্লাইং কিকের পর থেকেই দর্শকের উচ্ছ্বাস থামেনি। বক্স অফিসে ‘দ্য বিগ বস’ হংকংয়ের আগের সব আয়ের রেকর্ড ভেঙে দেয় এবং এক রাতেই ব্রুস লিকে সুপারস্টার বানিয়ে ফেলে।

এর ঠিক পরের বছর ১৯৭২ সালে আসে ‘দ্য চায়নিজ কানেকশন’—আন্তর্জাতিকভাবে বেশি পরিচিত ‘ফিস্ট অব ফিউরি’ নামে। জাপানি দখলযুগে সাংহাইয়ের পটভূমিতে নির্মিত এই ছবিতে ব্রুস লির চরিত্র চেন ঝেন হয়ে ওঠে অপমানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের প্রতীক। ছবিটি কেবল বক্স অফিসে সফল নয়, সাংস্কৃতিক বিস্ফোরণও ঘটায়। মুক্তির পর হংকং ও তাইওয়ানে আগের আয়ের রেকর্ড ভেঙে নতুন মানদণ্ড স্থাপন করে ছবিটি। চেন ঝেনের চরিত্র এশীয় দর্শকদের মধ্যে এক অবদমিত গর্ববোধকে প্রকাশ্যে নিয়ে আসে, যা ব্রুস লিকে জনপ্রিয়তার নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দেয়। একই বছর ব্রুস লি নিজের নিয়ন্ত্রণ আরও দৃঢ় করেন ‘ওয়ে অব দ্য ড্রাগন’-এ। এই ছবির বিশেষত্ব ছিল—এখানে তিনি শুধু অভিনয় করেননি, নিজেই ছিলেন গল্পকার, চিত্রনাট্যকার ও পরিচালক। পশ্চিমা দর্শকের সঙ্গে সরাসরি সংলাপে যাওয়ার লক্ষ্যে ছবিটির গুরুত্বপূর্ণ অংশ রোমে শুট করা হয়। রোমান কলোসিয়ামে মার্কিন কারাতে চ্যাম্পিয়ন চাক নরিসের সঙ্গে ব্রুস লির চূড়ান্ত লড়াই আজও অ্যাকশন চলচ্চিত্র ইতিহাসে এক ক্ল্যাসিক দৃশ্য হিসেবে বিবেচিত। এই লড়াইয়ে কোনো অতিরিক্ত কাট, কোনো বাহুল্য কৌশল নেই—শুধু শরীর, সময় আর মানসিক দৃঢ়তার দ্বন্দ্ব। চাক নরিস নিজেই পরে বলেছেন, ব্রুসের লড়াইয়ের স্টাইল কারও পক্ষে নকল করা সম্ভব নয়, ওটা একান্তই তাঁর নিজের।

এই ধারাবাহিক সাফল্যের মধ্য দিয়ে ব্রুস লি আর কেবল হংকং বা এশিয়ার নায়ক থাকেননি। ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের নানা দেশে তাঁর ছবিগুলো ডাবিং ও পুনর্মুক্তির মাধ্যমে বিপুলসংখ্যক দর্শক টানে। ইতিহাসে প্রথমবারের মতো একজন এশীয় অভিনেতা হয়ে উঠলেন সত্যিকারের বৈশ্বিক অ্যাকশন তারকা—যাঁর উপস্থিতি বক্স অফিসের গ্যারান্টি। এ সময়েই ব্রুস লির পারিশ্রমিক আকাশচুম্বী হয়ে ওঠে। সমকালীন এশীয় সিনেমায় যা ছিল কল্পনাতীত, ব্রুস লি সেখানে চলচ্চিত্রপ্রতি নজিরবিহীন অঙ্কের পারিশ্রমিক দাবি ও আদায় করতে সক্ষম হন।

অনেক গবেষকের মতে, তিনিই প্রথম এশীয় অভিনেতা, যাঁর চলচ্চিত্রমূল্য আন্তর্জাতিক বাজারে মিলিয়ন ডলার পর্যায়ে পৌঁছানোর সম্ভাবনা তৈরি করে—যা পরবর্তীকালে ‘এন্টার দ্য ড্রাগন’-এর মাধ্যমে বাস্তবেই নিশ্চিত হওয়ার পথে ছিল। হংকংয়ে ফিরে এসে মাত্র দু-তিন বছরের মধ্যেই ব্রুস লি প্রমাণ করে দেন নায়ক হতে হলে কারও অনুমোদনের অপেক্ষা করতে হয় না। নিজস্ব ভাষা, নিজস্ব শরীর আর নিজস্ব দর্শন দিয়েও ইতিহাস লেখা যায়। এই অধ্যায়ই তাঁকে একজন সফল অভিনেতার সীমা ছাড়িয়ে নিয়ে যায় বিশ্ব সংস্কৃতির এক স্থায়ী প্রতীকে।

অকালে চলে যাওয়া
মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে হংকং ও আন্তর্জাতিক সিনেমায় অভাবনীয় সাফল্য পেলেও ব্রুস লির জীবন তখন চরম চাপে ভারাক্রান্ত। একদিকে একের পর এক ছবির শুটিং, অন্যদিকে চিত্রনাট্য লেখা, ফাইট কোরিওগ্রাফির পরিকল্পনা, প্রতিদিনের দীর্ঘ শরীরচর্চা ও নতুন কৌশলের পরীক্ষা—সব মিলিয়ে তাঁর জীবন ছিল প্রায় নিরবচ্ছিন্ন পরিশ্রমের এক চক্রে বাঁধা। অনিদ্রা তাঁর নিত্যসঙ্গী হয়ে উঠেছিল। নিজের শরীর আর মনের সীমা তিনি বারবার ঠেলে দিচ্ছিলেন আরও সামনে। ঠিক এ সময়েই তাঁর সামনে ছিল সবচেয়ে বড় লক্ষ্য—হলিউডের মূলধারার বাজারে পূর্ণ শক্তিতে প্রবেশ। সেই স্বপ্নের নাম ছিল ‘এন্টার দ্য ড্রাগন’—ওয়ার্নার ব্রাদার্সের সঙ্গে যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত প্রথম বড় কুংফু চলচ্চিত্র, যা ব্রুস লিকে একযোগে এশিয়া ও পশ্চিমের বাজারে স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠা করার কথা ছিল।

সিনেমার দৃশ্যে ব্রুস লি। আইএমডিবি

এই চাপের মধ্যেই ১৯৭৩ সালের মে মাসে একবার ডাবিংয়ের সময় ব্রুস লি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। চিকিৎসকেরা তাঁর মস্তিষ্কে সেরিব্রাল এডিমা—মস্তিষ্কে পানি জমে ফুলে ওঠার গুরুতর লক্ষণ শনাক্ত করেন। দ্রুত চিকিৎসায় সেই বার তিনি ফিরে আসেন; কিন্তু সেই ঘটনা ছিল ভবিষ্যতের এক ভয়াবহ সতর্কসংকেত। এর মাত্র দুই মাস পর, ২০ জুলাই ১৯৭৩ সালে হংকংয়ের কাউলুন টং এলাকার একটি অ্যাপার্টমেন্টে ব্রুস লির মাথাব্যথা শুরু হয়। বিশ্রামের আগে একটি ব্যথানাশক ওষুধ গ্রহণ করেন ও শুয়ে পড়েন; কিন্তু আর ওঠেননি। মৃত্যুর সময় তাঁর বয়স ছিল মাত্র ৩২ বছর।
এই অতর্কিত মৃত্যু বিশ্বজুড়ে নেমে আনে শোকের ঢেউ। হংকংয়ে তাঁর মরদেহ একনজর দেখার জন্য রাস্তায় নেমে আসেন হাজার হাজার মানুষ। শোকাহত জনতাকে সামলাতে পুলিশকে ব্যারিকেড দিতে হয়।

আরও পড়ুন

ব্রুস লির মৃত্যুর পরপরই মুক্তি পায় ‘এন্টার দ্য ড্রাগন’। ছবিটি সেই স্বপ্নই বাস্তবে পরিণত করে, যা তিনি দেখে যেতে পারেননি। বিশ্বজুড়ে শুরু হয়ে যায় অভূতপূর্ব কুংফু উন্মাদনা। পশ্চিমা দর্শকের কাছে মার্শাল আর্ট প্রথমবারের মতো মূলধারার বিনোদনে পরিণত হয়, আর ব্রুস লি হয়ে ওঠেন এমন এক কিংবদন্তি, যিনি মৃত্যুর পরও তারকাখ্যাতির শিখরে উঠতে থাকেন। পরবর্তী সময়ে টাইম ম্যাগাজিন তাঁকে বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে প্রভাবশালী ১০০ ব্যক্তির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে। তবে ব্রুস লির প্রকৃত উত্তরাধিকার কেবল সিনেমা বা বক্স অফিস সাফল্যে সীমাবদ্ধ নয়।
ব্রুস লির সবচেয়ে বড় অবদান ছিল দৃষ্টিভঙ্গিতে। তিনি মার্শাল আর্টকে দেখিয়েছেন আত্ম-অন্বেষণের ভাষা হিসেবে, যেখানে শরীর কেবল শক্তির মাধ্যম নয়; বরং চিন্তা, প্রতিবাদ আর মুক্তির প্রকাশ। একজন এশীয় হিসেবে পশ্চিমা সাংস্কৃতিক আধিপত্যের কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে নিজের শরীরকেই তিনি বানিয়েছিলেন প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের শক্তিশালী মাধ্যম।