কানে নারীকেন্দ্রিক সিনেমার জয়জয়কার

এবারের উৎসবে গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কার জয় করা বেশির ভাগই নারীকেন্দ্রিক সিনেমা। কোলাজ
মূল প্রতিযোগিতা বিভাগে এবার ছিলেন ফ্রান্সিস ফোর্ড কপোলা, আলী আব্বাসি, জ্যাক অদিয়াঁর, ক্রোনেনবার্গ, কানাডা, জিয়া জ্যাং-কির মতো হেভিওয়েট নির্মাতারা। কিন্তু সবাইকে চমকে দিয়ে শেষ পর্যন্ত স্বর্ণপাম জিতল মার্কিন নির্মাতা শন বেকারের ছবি। কেবল এটিই নয়, এবারের উৎসবে গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কার জয় করা বেশির ভাগই নারীকেন্দ্রিক সিনেমা। পুরস্কার ঘোষণার মধ্য দিয়ে গত শনিবার রাতে কান উৎসবের পর্দা নেমেছে। এএফপি, আইএমডিবি অবলম্বনে এবারের গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কারগুলো নিয়ে লিখেছেন লতিফুল হক

স্বর্ণপাম
‘আনোরা;, যুক্তরাষ্ট্র
ঠিক যেন সিন্ডারেলার গল্প। নিউইয়র্কের যৌনকর্মী আনোরা ওরফে অ্যানির পরিচয় হয় রুশ ধনকুবেরের ছেলের সঙ্গে। দ্রুতই তাঁদের সম্পর্ক গড়ায় বিয়েতে। এরপর কি সব ঠিকঠাক চলে? এ নিয়েই এগিয়েছে শন বেকারের সিনেমার গল্প। এতে তরুণ যৌনকর্মীর ভূমিকায় অভিনয় করেছেন ২৫ বছর বয়সী মার্কিন অভিনেত্রী মাইকি ম্যাডিসন।

‘আনোরা’ সিনেমার দৃশ্য
আইএমডিবি

ক্যারিয়ারের শুরুর দিকেই জটিল একটি চরিত্রে পর্দায় সফল রূপায়ণ করে সমালোচকদের প্রিয়পাত্র বনে গেছেন তিনি। সিনেমাটি নিয়ে উৎসবের প্রতিযোগিতা বিভাগের প্রধান জুরি গ্রেটা গারউইগ বলেন, ‘“আনোরা” অবিশ্বাস্য। এটি এমন একটি মানবিক চলচ্চিত্র, যা আমাদের হৃদয় ছুঁয়ে গেছে।’ ২০১১ সালের পর এই প্রথম স্বর্ণপাম জিতল যুক্তরাষ্ট্রের সিনেমা।

আরও পড়ুন

অনেক দিন ধরেই যৌনকর্মী ও পর্ন তারকাদের নিয়ে গবেষণা করেছেন শন বেকার। তাঁর সিনেমায় তাই বারবার উঠে আসে যৌনকর্মীদের গল্প; নির্মাতার আগের দুই সিনেমা ‘ট্যাঙ্গারিন’, ‘দ্য ফ্লোরিডা প্রজেক্ট’ দেখা দর্শকের তা ভালোই জানার কথা। এ প্রসঙ্গে এএফপিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে শন বলেন, ‘তাঁরা (যৌনকর্মীরা) আমাদের সবাইকে মুগ্ধ করে।’ পুরস্কারটিও এই পরিচালক উৎসর্গ করেন যৌনকর্মীদের। সঙ্গে নির্মাতাদের প্রতি আবেদন জানান চলচ্চিত্রকে বাঁচিয়ে রাখার।

স্বর্ণ পাম জিতেছে মার্কিন নির্মাতা শন বেকারের সিনেমা 'আনোরা'
রয়টার্স

শন বেকারের সঙ্গে ‘আনোরা’ প্রযোজনা করেছেন নির্মাতার স্ত্রী সামান্থা কোয়ান। গত বছর নিউইয়র্কে শুটিং হয় সিনেমাটির। ২১ মে কান উৎসবে প্রিমিয়ার হয় সিনেমাটির। প্রদর্শনীর পর ১০ মিনিট ধরে দর্শকের স্ট্যান্ডিং ওভেশন পায়। ‘আনোরা’র পুরস্কার জয় স্বাধীন ঘরানার সিনেমা নির্মাতাদের জন্যও বড় সুখবর। একই সঙ্গে পরিবেশক সংস্থা নিয়নের জন্যও। নিউইয়র্কভিত্তিক এই সংস্থার পাঁচটি সিনেমা টানা পাঁচ বছর কান উৎসবে স্বর্ণপাম জিতল—‘প্যারাসাইট, ‘তিতানে, ‘ট্রায়াঙ্গল অব স্যাডনেস’, ‘অ্যানাটমি অব আ ফল’ ও ‘আনোরা’।

গ্রাঁ প্রি
‘অল উই ইমাজিন অ্যাজ লাইট’, ভারত
সর্বশেষ ৩০ বছর কানের মূল প্রতিযোগিতা বিভাগে জায়গা করে নিয়েছিল ভারতীয় সিনেমা। এরপর জায়গা পেল এই ছবি। ২৩ মে প্রদর্শনীর পর থেকেই সমালোচকেরা উচ্ছ্বসিত ছিলেন পায়েল কাপাডিয়ার সিনেমাটি নিয়ে। বিবিসি, ভ্যারাইটি ছবিটিকে ‘জাদুকরি’ বলে অভিহিত করেছে। শেষ পর্যন্ত উৎসবের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পুরস্কার জিতল ড্রামা ঘরানার সিনেমাটি।

গ্রাঁ প্রি হাতে ভারতীয় নির্মাতা পায়েল কাপাডিয়া। ছবি: রয়টার্স

এর গল্প প্রভা ও অনু নামের দুই নার্সকে ঘিরে। ভারতের অন্য শহর থেকে কাজের সূত্রে মুম্বাই আসার পর তাঁদের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। এই বন্ধুত্বের গল্প নিয়েই এগিয়েছে সিনেমাটি। কানে পুরস্কার জয়ের পর ৩৮ বছর বয়সী নির্মাতা তাঁর সিনেমার অভিনেত্রীদের ধন্যবাদ জানান। মজা করে বলেন, ‘আশা করি কান থেকে ভারতের পরের পুরস্কারটি জিততে ৩০ বছর অপেক্ষা করতে হবে না।’

‘অল উই ইমাজিন অ্যাজ লাইট’ সিনেমার দৃশ্য
আইএমডিবি

সিনেমাটিতে অভিনয় করেছেন কানি কুশ্রুতি, দিব্যা প্রভা, ছায়া কদম, ঋধু হারুন। হিন্দি, মারাঠি ও মালয়লাম ভাষার মিশেলে নির্মিত সিনেমাটির শুটিং হয়েছে মহারাষ্ট্রের মুম্বাই ও রত্মাগিরিতে।

অনসূয়া সেনগুপ্ত
ছবি: ইনস্টাগ্রাম থেকে

এবারের কান উৎসবটা দুর্দান্ত গেছে ভারতের জন্য। এর আগে গত শুক্রবার রাতে আঁ সার্তে রিগা বিভাগে ‘দ্য শেমলেস’ সিনেমার জন্য সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার পান অনসূয়া সেনগুপ্ত।

সেরা পরিচালক
মিগুয়েল গোমেজ, পর্তুগাল
ছিলেন মূলত সিনেমা সমালোচক। ২০০০ সালে প্রথম স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনেমা ‘ক্রিসমাস ইনভেনটোরি’ দিয়ে নির্মাণে হাতেখড়ি। এরপর টানা কয়েকটি স্বল্পদৈর্ঘ্য বানান, তাঁর নির্মিত প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমা ‘দ্য ফেস ইউ ডিজার্ভ’ মুক্তি পায় ২০০৪ সালে। তাঁর অন্যান্য উল্লেখযোগ্য অন্য সিনেমার মধ্যে আছে ‘আগস্ট’ ও ‘টাবু’।

মিগুয়েল গোমেজ
রয়টার্স

নিজের ষষ্ঠ সিনেমা ‘গ্র্যান্ড ট্যুর’-এর জন্য কানে সেরা পরিচালকের পুরস্কার পেলেন গোমেজ। সিনেমার প্রেক্ষাপট ১৯৭১ সালের বার্মা। প্রেমিকাকে ফেলে এক সরকারি চাকুরের এশিয়া সফরের গল্প নিয়ে নির্মিত হয়েছে সিনেমাটি।

সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার জিতেছেন চারজন। সমাপনী দিনে ছিলেন কেবল কার্লা সোফিয়া গাসকোন। ছবি: রয়টার্স

সেরা অভিনেত্রী
আদ্রিয়ানা পাজ, কার্লা সোফিয়া গাসকোন, সেলেনা গোমেজ ও জোয়ি সালদানা, ‘এমিলিয়া পেরেজ’, ফ্রান্স, মেক্সিকো
স্বর্ণপামজয়ী ফরাসি নির্মাতা জ্যাক অদিয়াঁরের নতুন সিনেমাটি মিউজিক্যাল ক্রাইম কমেডি ঘরানার। ছবিটি মেক্সিকোর মাদক সম্রাটের, যিনি পরে নারীতে রূপান্তরিত হন। এই এমিলিয়া পেরেজের চরিত্রে অভিনয় করেন গাসকোন। সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার পাওয়া চারজনের মধ্যে কেবল গাসকোনই সমাপনী দিনে উপস্থিত ছিলেন।

‘এমিলিয়া পেরেজ’ সিনেমার অভিনয়শিল্পীরা
রয়টার্স

তিনি প্রথম ট্রান্স নারী, যিনি সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার পেলেন। পুরস্কারটি গাসকোন সংগ্রামরত ট্রান্স জনগোষ্ঠীর সব মানুষকে উৎসর্গ করেন।

সেরা অভিনেতা
জেসি প্লেমনস, ‘কাইন্ডস অব কাইন্ডনেস’, আয়ারল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র
চলচ্চিত্র উৎসবগুলোয় নির্মাতা ইয়োর্গোস লান্থিমোসের সিনেমার পুরস্কার যেন বাঁধা। এবার কানে তাঁর নতুন সিনেমা ‘কাইন্ডস অব কাইন্ডনেস’-এর অভিনেতা জেসি প্লেমনস পেলেন সেরা অভিনেতার পুরস্কার।

সেরা অভিনেতা হয়েছেন জেসি প্লেমনস
ছবি: রয়টার্স

৩৬ বছর বয়সী এই মার্কিন অভিনেতা পরিচিতি পান ড্রামা সিরিজ ‘ফ্রাইডে নাইট লাইটস’ দিয়ে। এরপর তাঁকে ‘ব্রেকিং ব্যাড’-এও দেখা যায়। ২০১৫ সালে ব্ল্যাক কমেডি সিরিজ ‘ফার্গো’ দিয়ে সমালোচকদের প্রশংসা পেতে শুরু করেন। একাধিক পুরস্কারে মনোনীত হন। ২০২১ সালের আলোচিত সিনেমা ‘দ্য পাওয়ার অব দ্য ডগ’-এর জন্য অস্কারে সেরা পার্শ্ব অভিনেতার মনোনয়ন পেয়েছিলেন। সেবার পুরস্কার পাননি, এবার কান থেকে পুরস্কার নিয়ে ঘরে ফিরলেন

হল্ফদান উলমান তন্দেল
ছবি: রয়টার্স

ক্যামেরা দ’র
হল্ফদান উলমান তন্দেল, ‘আরমান্ড’, নরওয়ে, নেদারল্যান্ডস, জার্মানি, সুইডেন
নামের সঙ্গে থাকা ‘উলমান’ উপাধি দেখে অনেকের কৌতূহল হতে পারে। তিনি কি প্রখ্যাত নরওয়েজীয় অভিনেত্রী লিভ উলমানের কিছু হন? হ্যাঁ, তিনি নির্মাতা ইঙ্গমার বার্গম্যান ও লিড উলমানের নাতিই বটে। ৩৪ বছর বয়সী এই তরুণ নির্মাতা এবার কানে ক্যামেরা দ’র পুরস্কার জিতলেন। আঁ সার্তে রিগা বিভাগে জায়গা করে নিয়েছিল তাঁর সিনেমাটি। এ পুরস্কার দেওয়া হয়, প্রথম সিনেমার নির্মাতাদের। ‘আরমান্ড’-এর গল্প স্কুলশিক্ষার্থীদের নিয়ে।

আরও যা হলো
এ ছাড়া সমাপনী দিনে ‘দ্য সিড অব দ্য স্যাক্রেড ফিগ’–এর জন্য বিশেষ জুরি পুরস্কার পেয়েছেন আলোচিত ইরানি নির্মাতা মোহাম্মদ রাসুলফ।

‘দ্য সিড অব দ্য স্যাক্রেড ফিগ’–এর জন্য বিশেষ জুরি পুরস্কার পেয়েছেন আলোচিত ইরানি নির্মাতা মোহাম্মদ রাসুলফ
রয়টার্স

আট বছরের কারাদণ্ড মাথায় নিয়ে চলতি মাসেই দেশ থেকে পালিয়ে আসার কথা জানান রাসুলফ। প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, ইরানে থাকা সিনেমাটির কলাকুশলীরা এখনো দেশটির গোয়েন্দা সংস্থার চাপের মুখে রয়েছেন। এটা তাঁকে পোড়াচ্ছে। ইরানের মানুষ ‘সর্বগ্রাসী’ শাসনব্যবস্থার মধ্যে রয়েছেন উল্লেখ করে রাসুলফ দেশটির জনগণের জন্য নিজের গভীর দুঃখ প্রকাশ করেন।

কান চলচ্চিত্র উৎসবের মূল প্রতিযোগিতা বিভাগের প্রধান জুরি গ্রেটা গারউইগের সঙ্গে বিভিন্ন বিভাগের পুরস্কারজয়ীরা
ছবি: কানের অফিশিয়াল ইনস্টাগ্রাম হ্যান্ডল

এ ছাড়া শেষ দিতে নির্মাতা জর্জ লুকাসের হাতে সম্মানসূচক স্বর্ণপাম তুলে দেন ফ্রান্সিস ফোর্ড কপোলা। চলতি বছর এ সম্মাননা আরও পেয়েছেন অভিনেত্রী মেরিল স্ট্রিপ ও জাপনের স্টুডিও জিবলি।

১৪ মে শুরু হয়েছিল এবারের কান উৎসব।