কী ঘটেছিল ৫ সেপ্টেম্বর

সিনেমার পোস্টার। ছবি: আইএমডিবি

‘এবিসি’র দিকে তাকিয়ে আছে গোটা বিশ্ব। তারা যা প্রচার করছে, সেটাই অনুসরণ করছে বিশ্বের অন্য সব গণমাধ্যম। তাই একটি ভুল করার অর্থ, লাখ লাখ মানুষের কাছে ভুল খবর চলে যাওয়া। কিন্তু মিউনিখে ঘটে চলা সহিংস ঘটনা নিয়ে জার্মানির জাতীয় গণমাধ্যম যখন প্রচার করে, সব জিম্মিকে বিমানবন্দরে নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, তখন নিজেদের দুই বিশ্বস্ত সূত্রের কাছ থেকে নিশ্চিত না হয়ে খবরটি প্রচার করতে ইতস্তত করতে থাকেন এবিসি স্পোর্টসের উচ্চপদস্থ এক কর্মকর্তা।

কিন্তু অনুষ্ঠান প্রচার বিভাগের দায়িত্বে থাকা আরেক কর্মকর্তা চান, সুখবরটি সঙ্গে সঙ্গেই প্রচারিত হোক। তাই একটি বিশ্বস্ত সূত্রের আশ্বাস পাওয়ার পর আরেকটির অপেক্ষা না করেই খবরটি তিনি প্রচার করেন। পরে ঘটনাটি নিয়ে দুই কর্মকর্তার মধ্যে ভুল-বোঝাবুঝি হলেও নিমেষেই সেটা মিটে যায়। শুরুতে সুখবর মনে হলেও সেই ঘটনাই পরে ভয়ংকর পরিণতির দিকে যায়। এ ঘটনার কারণে দারুণভাবে বাধাগ্রস্ত হয় ১৯৭২ সালের সামার অলিম্পিক। এ ঘটনা নিয়ে এবার নির্মিত হয়েছে সিনেমা ‘সেপ্টেম্বর ৫’।

জার্মানির মিউনিখে বসেছিল ১৯৭২ সালের সামার অলিম্পিকের আসর। অলিম্পিক কাভার করতে আসা অনেক গণমাধ্যমের মধ্যে এবিসি স্পোর্টসও ছিল। খেলার অনুষ্ঠান প্রচার শেষ। ভোরে খুব একটা কাজ নেই। কেউ বাসায় চলে গেছেন, কেউবা যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কেউ অফিসেই সময় কাটাচ্ছিলেন। এমন সময় হঠাৎ জোর শব্দ। সেটা যে গুলির শব্দ, বুঝতে সময় লাগল না। কিন্তু জোরালো নিরাপত্তাবেষ্টিত অলিম্পিক এলাকায় গুলির শব্দ আসে কোথা থেকে? ছড়িয়ে পড়ে আতঙ্ক।

ইতিহাসের অমানবিক এ ঘটনা ‘মিউনিখ গণহত্যা’ নামে পরিচিত। ছবি: আইএমডিবি

এরপর দক্ষতার সঙ্গে গল্প বলে যান টিম ফেলবম। দ্য কলোনি ও হেল সিনেমা দিয়ে আগেই আলোচনায় আসেন এই জার্মান তরুণ নির্মাতা।

‘সেপ্টেম্বর ৫’ দেখে শুরুতেই মনে হতে পারে, এটা জার্মানির কোনো নারীর সঙ্গে এক টেলিভিশন কর্মকর্তার প্রেমের গল্প। তা কিন্তু নয়। দারুণ রহস্য রেখে গল্প এগোতে থাকে। বলে নেওয়া ভালো, সত্য ঘটনাটি আগেই জানা ছিল। আর জানা ঘটনার সিনেমারূপ দেখার আগ্রহ খুব একটা থাকে না। এই গল্পটা সেখানে ব্যতিক্রম, যা নতুন করে বহু কিছু জানিয়েছে।

ভ্যারাইটির মতে, সামার অলিম্পিক চলার সময় ইসরায়েলি খেলোয়াড়দের থাকার ভবনটি দখল করে নেয় ফিলিস্তিনের চরমপন্থী একটি গোষ্ঠী। পরে সব ইসরায়েলি খেলোয়াড়কে জিম্মি করে এই দল। ক্রমেই জানা যায় এ ঘটনা প্রসঙ্গে। গ্রুপটির দাবি, ইসরায়েলের কারাগারে বন্দী দুই শতাধিক ফিলিস্তিনিকে ছেড়ে দিতে হবে। না হলে প্রতি ঘণ্টায় একজন করে জিম্মি খেলোয়াড়কে হত্যা করা হবে। সিনেমাটি এরপর পুরো থ্রিলার গল্পের মতো এগোতে থাকে। সত্য ঘটনা অবলম্বনে ডকুড্রামা স্টাইলে নির্মিত সিনেমাটি বর্তমানে ভক্তদের আগ্রহের কেন্দ্রে রয়েছে। আইএমডিবি রেটিং ৭.১। ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে গত বছর উদ্বোধনী সিনেমা ছিল সেপ্টেম্বর ৫।

সিনেমায় এবিসি স্পোর্টসের ব্যস্ত গণমাধ্যমকর্মীরা। ছবি: আইএমডিবি

সিনেমাটি গণমাধ্যমকর্মীদের মনে করিয়ে দেয়, সবার আগে খবর প্রকাশের প্রতিযোগিতা গণমাধ্যমের কাজ নয়, তার কাজ বস্তুনিষ্ঠ তথ্য তুলে ধরা। কারণ, এর সঙ্গে অনেক ঘটনা জড়িয়ে থাকে, যা ডেকে আনতে পারে ভয়ংকর পরিণতি। এবিসি স্পোর্টস নিজস্ব পদ্ধতিতে সবার আগেই দর্শককে নতুন নতুন খবর দিতে থাকে, কিন্তু এর মধ্য দিয়ে এটাও সিনেমায় বলা হয়, সোর্স কখনো কখনো সত্য না-ও বলতে পারে। কখনো সেটা হয়তো যাচাই করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। আবার অনেক সময় কীভাবে কোনো দেশ বা গোষ্ঠী গণমাধ্যমকে ব্যবহার করে, সেটাও সিনেমায় নিখুঁতভাবে উঠে এসেছে।

টান টান উত্তেজনার মানবিক এ ঘটনার মধ্যে পরিচালক জিইয়ে রেখেছিলেন সাসপেন্স। গোলাগুলি শুরু হলে সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা খুঁজে বের করেন শব্দ কোথা থেকে আসছে।

তারপর সেই ভবনের মানচিত্র নিয়ে বসেন। সেখানে ইসরায়েলের কতজন খেলোয়াড় রয়েছেন, সেটা বের করে। তাঁদের ছবি-পরিচয়সহ সবকিছু মুহূর্তের মধ্যেই হাতের নাগালে চলে আসে। তাঁদের মধ্যে কার সাক্ষাৎকার তাঁদের কাছে রয়েছে, সেটাও বের করতে সময় নেন না।

সিনেমায় তুলে ধরা হয়েছে সাংবাদিকসহ পুরো টিমের দায়িত্বশীল আচরণ
ছবি: আইএমডিবি

শুধু তা-ই নয়, দর্শকদের জন্য বিভিন্ন স্থান থেকে ক্যামেরা তাক করে রাখে জিম্মি করা ভবনটির দিকে। ভবনের মধ্যে কী হচ্ছে, সেটাও কায়দা করে দেখানোর চেষ্টা করেন গণমাধ্যমকর্মীরা। সেই সময় খেলার খবরের বাইরে জিম্মির ঘটনা নিয়ে অনবরত খবর প্রকাশ করে টেলিভিশনটি আরও বেশি করে দর্শক মনোযোগের কেন্দ্রে থাকে। তাদের দায়িত্ব যে আরও বেড়ে গেছে, সেটাও দর্শকদের মনে করিয়ে দেয়।

ইতিহাসের অমানবিক এ ঘটনা ‘মিউনিখ গণহত্যা’ নামে পরিচিত। জার্মানি এ ঘটনাকে তাদের বড় ব্যর্থতা হিসেবে মেনে নিয়েছিল। সেই ঘটনা নিয়ে সিনেমা বানানোর আগে পরিচালক দিনের পর দিন গবেষণা করেছেন। ব্যবহার করেছেন এবিসির কাভার করা সেই সময়ের ফুটেজ। সেই ফুটেজের সঙ্গে মিল রেখেই সিনেমার কালার, লাইট অ্যাডজাস্ট করা হয়েছে। ক্যামেরা চালনা, কালার গ্রেডিং দর্শকদের নিয়ে যায় সেই ১৯৭২ সালে।

অভিনয়শিল্পী পিটার সার্সগার্ড, জন মাগারো, বেন চাপলিন, লিয়োনি বেনিশচসহ পার্শ্বচরিত্রদের অসাধারণ অভিনয় দর্শকদের আরও বেশি করে উত্তেজনার মধ্যে নিয়ে যায়। আবদ্ধ রুমের মধ্যে একটা গল্প কীভাবে টান টান উত্তেজনাপূর্ণ করে তোলা যায়, সেটার দারুণ উদাহরণ হয়ে থাকবে সিনেমাটি। এই জন্য পুরোটা প্রশংসা পাবেন পরিচালক টিম ফেলবাম।

টিম এর আগে একাধিক গণমাধ্যমে জানিয়েছিলেন, তাঁরা এবিসির সেই টিমের সঙ্গে দীর্ঘদিন কাটিয়েছেন। কীভাবে ঘটনার সূত্রপাত, সেই মুহূর্তে স্টেশনের মধ্যে কী পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, সেগুলো নিয়ে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করেন। সেভাবেই ইতিহাস থেকে সিনেমার চিত্রনাট্য লিখেছেন ও প্রোডাকশন ডিজাইন করেছেন। তবে সিনেমাটি বিতর্ক যেন না তৈরি করে, সেটাই চেয়েছেন। তারপরও কানাডার টরন্টো চলচ্চিত্র উৎসবের আয়োজকেরা বিতর্ক এড়াতে শেষ পর্যন্ত প্রদর্শনী থেকে সরে আসেন।