বয়ঃসন্ধিকাল আর ‘নিষিদ্ধ’ প্রেমের গল্প

‘গার্লস উইল বি গার্লস’–এর দৃশ্য। আইএমডিবি

হিমালয়ের কোলে এক শৈলশহরের আবাসিক স্কুলের চৌহদ্দিতে বলা গল্প। বোর্ডিং স্কুল নিয়ে দুনিয়ার নানা প্রান্তে নানা ধরনের সিনেমা হয়েছে। ঘটনা, টেনশন আর নস্টালজিয়া-যোগে যেগুলোর বেশির ভাগই উতরে যায়। তাই চলতি বছর সানড্যান্স উৎসবে দুই পুরস্কার পাওয়া ‘গার্লস উইল বি গার্লস’ নিয়ে প্রত্যাশা ছিল, ভারতীয় সমালোচকদের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা শুচি তালাতির ছবিটিকে নিয়ে আরও আগ্রহী করে তুলেছিল; কিন্তু দেখার পর সেটা আর মিলল কই! বরং মনে পড়ে সেই কবে বানানো ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘তিতলি’র কথা।

একনজরে
সিনেমা: ‘গার্লস উইল বি গার্লস’
ধরন: কামিং অব এজ ড্রামা
পরিচালক: শুচি তালাতি
অভিনয়ে: প্রীতি পাণিগ্রাহী, কানি কুশ্রুতি ও কেশব বিনয় কিরণ
দৈর্ঘ্য: ১১৮ মিনিট
স্ট্রিমিং: অ্যামাজন প্রাইম ভিডিও

মীরা ক্লাসে ফার্স্ট গার্ল। সব ঠিকঠাকই চলছিল। তবে গল্প গতি পায় শ্রীনিবাস আসার পর। বাবার বদলির চাকরির সুবাদে দুনিয়ার নানা প্রান্তের স্কুলে পড়েছে সে। বিদেশ থেকে এসে সটান ভর্তি হয়েছে মীরার স্কুলেই। এরপর যা হয়, অবধারিতভাবেই মীরা আর শ্রীনিবাসের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা হয়। মীরার মা অনিলা মেয়ের পড়াশোনা নিয়ে সিরিয়াস, বস্তুত মীরার পরীক্ষার জন্য এখানে এসেছেন তিনি। মীরার মা সহজেই বুঝে যান, মেয়ে প্রেমে পড়েছে। বাড়িতে ডেকে পাঠান শ্রীনিবাসকে। মীরা-শ্রীনিবাসের একটু প্রেম, যৌন আকাঙ্ক্ষা, দ্বিধা মিলিয়ে চলছিল গল্প আর দশটা কামিং-এজ ঘরানার সিনেমায় যেমন হয় আরকি।

মুশকিল হয় যখন শ্রীনিবাসের সঙ্গে মীরার মায়েরও ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়! এরপর মা-মেয়ের সম্পর্কের টানাপোড়েন নিয়ে এগিয়ে যায় গল্প।

আরও পড়ুন

‘গার্লস উইল বি গার্লস’-এর সবচেয়ে ইতিবাচক দিক এর অভিনয়, সিনেমাটোগ্রাফি, সাউন্ড ডিজাইন। মীরা চরিত্রে প্রীতি পাণিগ্রাহী দুর্দান্ত। স্কুলশিক্ষার্থীর চরিত্রে প্রথম সিনেমাতেই বিশ্বাসযোগ্য পারফরম্যান্স উপহার দিয়েছেন তিনি।

‘গার্লস উইল বি গার্লস’–এর পোস্টার। আইএমডিবি

মানসিক দ্বন্দ্ব, যৌন আকাঙ্ক্ষা, মায়ের সঙ্গে টানাপোড়েনের দৃশ্যগুলো তিনি পর্দায় তুলে ধরেছেন যথেষ্ট মুনশিয়ানার সঙ্গে। কানি কুশ্রুতি, কেশব বিনয় কিরণসহ বাকি চরিত্রের পাত্রপাত্রীরাও ঠিকঠাক। জিহ-ই পেংয়ের ক্যামেরায় হিমালয়ঘেঁষা শৈলশহরও হাজির আলাদা চরিত্র হিসেবে।

বয়ঃসন্ধিকালীন মনস্তত্ত্ব, যৌন আকাঙ্ক্ষা ভারতীয় সিনেমায় সেভাবে উঠে আসে না, কিন্তু এ ছবিতে বিষয়টি এসেছে দারুণভাবে। এটুকু পড়লে আপনার হয়তো মনে হতে পারে, ঠিকই তো আছে। বিনোদনমূলক সিনেমা হিসেবে দেখার জন্য ‘গার্লস উইল বি গার্লস’ খারাপ না; কিন্তু একটু তলিয়ে ভাবলেই বোঝা যাবে শুচি তালাতির চিত্রনাট্য আর নির্মাণে যথেষ্ট ফাঁক আছে। এর অনেকগুলোই সিনেমার মূল দর্শকের পরিপন্থী।

‘গার্লস উইল বি গার্লস’–এর দৃশ্য। আইএমডিবি

আবাসিক স্কুলের কড়া শিক্ষিকা মনেপ্রাণে লালন করেন পরিচিত সেই পুরুষতান্ত্রিক অনুশাসন। তাদের মতে, অপ্রীতিকর যেকোনো পরিস্থিতি এড়াতে ছাত্রীদেরই তো উচিত নিজেদের পোশাকের বিষয়ে মনযোগী হওয়া! শিক্ষক চান না এসব বিষয় নিয়ে ছাত্রদের সঙ্গে তর্ক করে ঝামেলা বাড়াতে। পুরুষতান্ত্রিকতাকে থাপ্পড় মারতে এ ধরনের বহু চর্চিত, ক্লিশে দৃশ্য না রাখলেও পারতেন। অবশ্য স্কুলের ওই শিক্ষিকার চরিত্রটি নিজেরই তো বহুবার হিন্দি সিনেমায় দেখা। এ ধরনের চরিত্র কতবার যে পর্দায় এসেছে! নির্মাতা অবশ্য জানিয়েছেন, এই সিনেমার গল্প তিনি লিখেছেন নিজের স্কুলজীবনের প্রেরণায়। তা তিনি নিজের স্কুলে যদি একই জিনিস দেখে থাকেন তাহলে আর কী করা যাবে।

মীরা ও তার মা অনিলা—পুরুষতান্ত্রিক সমাজে দুই প্রজন্মের দুই নারী। মেয়ের পরীক্ষার সময় মা এসে থাকেন মীরার শহরে। যেন মীরার পড়াশোনার ক্ষতি না হয়। কিন্তু অনিলার আসল ভয় অন্যত্র। মেয়ের ফলাফল খারাপ হলে, দোষ হবে মায়ের। স্বামীর কাছে হেনস্তা হওয়ার আতঙ্কেই তটস্থ তিনি। তাঁর এই শঙ্কাকে কয়েকটি দৃশ্যে দেখিয়েছেন নির্মাতা, যা আরোপিত মনে হওয়া অস্বাভাবিক নয়।

‘গার্লস উইল বি গার্লস’–এর দৃশ্য। আইএমডিবি

অনিলা মনোযোগ চায়। স্বামীর কাছ থেকে দূরে একঘেয়ে জীবন থেকে বেরিয়ে আসতে চায় সে। নিজের অজান্তেই মেয়ের মনে অশান্তি সৃষ্টি করে অনিলা। মীরা-শ্রীনিবাস-অনিলার ত্রয়ী সম্পর্ক একটা পর্যায়ে ছবির মূল বিষয় হয়ে ওঠে। বড় ঝামেলাটা এখানেই বাধে।

এখানে বেশ কিছু জায়গায় বাস্তবতাবিবর্জিত দৃশ্য দেখিয়েছেন নির্মাতা, যা সিনেমা জেনেও পর্দায় দেখতে অবিশ্বাস্য লাগে। অনিলা যেভাবে অনায়াসে শ্রীনিবাসকে নিজের বিছানায় ঘুমাতে দেয়, সেটা এতটাই অবিশ্বাস্য যে নির্মাতার সততা নিয়েও প্রশ্ন জাগে।

‘গার্লস উইল বি গার্লস’–এর দৃশ্য। আইএমডিবি

বেশি বয়সী নারীদের প্রতি আলাদা আকর্ষণের কথা প্রাথমিক আলাপে মীরাকে জানিয়েছিল শ্রীনিবাস। সিনেমা যত এগোতে থাকে, মনে হয় নির্মাতা যেন সেটা প্রমাণেই যুদ্ধে নেমেছেন। তাই ভালো শুরুর পরও মেয়ের প্রেমিকের সঙ্গে মায়ের সম্পর্কের জটিলতা দেখাতে গিয়ে খেই হারিয়েছেন নির্মাতা। ইন্দো–ফরাসি প্রযোজনা ‘গার্লস উইল বি গার্লস’, তারকা দম্পতি রিচা চাড্ডা আর আলী ফজলের প্রযোজনা সংস্থা পুশিং বাটন স্টুডিওজের প্রথম নির্মাণও। তবে ছবিটি নিয়ে যতটা প্রশংসা, দেখার পর মনে হয় সেই বহুল চর্চিত কথাটিই—‘আরও ভালো হতে পারত’।

আরও পড়ুন

ঋতুপর্ণ ঘোষকে তাই মনে না পড়ে উপায় কী। ২০০২ সালে ভারতের আরেক শৈলশহরের প্রেক্ষাপটে নির্মিত কাছাকাছি বিষয়ের সিনেমাটি যে ‘গার্লস উইল বি গার্লস’-এর চেয়ে বেশি ছাপ ফেলতে পেরেছে, সেটা নিশ্চয়ই এতক্ষণে বুঝে গেছেন। না হলে মুক্তির ২২ বছর পরে আবার ‘তিতলি’র কথা কেন!