রহস্য আর সাসপেন্সের কারিগর হিচকক, আজ তাঁর জন্মদিন
আলফ্রেড হিচকক যে অস্কার পাননি, তার জন্য অস্কার পুরস্কারটাই লজ্জা পাবে, হিচকক নন। বিশ্ব চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবে যাঁদের সমীহ করে, তাঁদের মধ্যে অবধারিতভাবেই হিচকক একজন। আজ তাঁর জন্মদিন। ১৮৯৯ সালের ১৩ আগস্ট লন্ডনে এক রোমান ক্যাথলিক পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন।
হিচকককে নিয়ে বলার মতো কত কিছুই যে আছে! অন্তত এক ডজনেরও বেশি ক্ল্যাসিক ছবি থেকে তাঁর সেরা তিনটি বেছে নেওয়া সহজ নয়। এখানে চলচ্চিত্রপ্রেমীর রুচিকেই প্রাধান্য দেওয়া ভালো। কারণ, একেকজনের কাছে একেকটা সিনেমা একেক কারণে ভালো লাগবে।
গত শতাব্দীর আশির দশকে আমাদের কৈশোরে বাংলাদেশ টেলিভিশনে ‘আলফ্রেড হিচকক প্রেজেন্টস’ নামের একটি সিরিজ দেখানো হতো। পৃথিবীর নামকরা গল্পগুলো থেকে ছোট ছোট চিত্রনাট্যে থাকত তার বয়ান। আমরা মুগ্ধ হয়ে দেখতাম। একটা কাহিনির কথা তো এখনো মনে আছে। এক ভদ্রলোক শুধু পড়তে পছন্দ করতেন। ভাবতেন, আহা! পৃথিবীতে যদি সবকিছু ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পর শুধু বই আর তিনি থাকতেন! তাঁর এই বইপ্রীতি কেউই সুনজরে দেখত না। কিন্তু একদিন ঘুম থেকে উঠে তিনি দেখেন, তাঁর মনোবাসনা পূর্ণ হয়েছে। সারা পৃথিবীতে রয়েছে শুধু বই আর তিনি। খুশির আতিশয্যে তিনি যখন বিভোর, তখন হঠাৎ তাঁর চশমাটি চোখ থেকে খুলে পড়ে যায়। চশমা ছাড়া তিনি কিছুই দেখতে পেতেন না। চশমা খুঁজতে গিয়েই তিনি পা দিয়ে মাড়িয়ে ফেলেন চশমাটা।
কী ভয়ংকর অনুভূতির জন্ম দিয়েছিল ছবিটা, তা ভাবলে এখনো শিউরে উঠতে হয়।
অনেকগুলো ছবি থেকে তিনটি ছবি বেছে নিতে বললে আমি ‘ভার্টিগো’, ‘স্পেলবাউন্ড’ আর ‘সাইকো’কে বেছে নেব। যদিও এসব ছবি দেখার অনেক আগেই হিচককের ‘রেবেকা’, ‘বার্ড’ ছবিগুলোও দেখেছিলাম এবং দেখে নান্দনিক খিদেও মিটেছিল, কিন্তু হিচককের এই তিন ছবি আমাকে আরও বেশি তৃপ্তি দিয়েছিল।
‘স্পেলবাউন্ড’ কিন্তু হতবাক করে দেওয়ার মতোই ছবি। ১৯৪৫ সালে তৈরি এই ছবি দেখলে মনে হবে, এ রকম একটি ছবি দেখার জন্য অপেক্ষা করা যায় দীর্ঘদিন। গ্রেগরি পেক আর ইনগ্রিড বার্গম্যানের যুগলবন্দী এই ছবি। মনস্তাত্ত্বিক রহস্য ঘরানার এই ছবিতে একজন ভালো মনস্তত্ত্ববিদ হিসেবে ইনগ্রিড বার্গম্যানকে দেখা যায়। কন্সট্যান্ট পিটারসন তাঁর নাম। সেখানে একজন ডাকসাইটে চিকিৎসাবিজ্ঞানী হিসেবে আবির্ভাব ঘটে গ্রেগরি পেকের। কিন্তু গ্রেগরি পেক জানেন না, তিনি সেই লোক নন। তিনি আসলে জন ব্যালেন্টাইন। কন্সট্যান্ট জেনে যান ব্যালেন্টাইনের আসল পরিচয়। এরপর নিজের ঠিকানা কন্সট্যান্টকে দিয়ে উধাও হয়ে যান ব্যালেন্টাইন। কীভাবে রহস্যের উন্মোচন হয়, তা দেখার পর যে–কেউ বলবে, এ একটা সিনেমা বটে! হ্যাঁ, মনে করিয়ে দেওয়া দরকার, এই ছবির স্বপ্নের দৃশ্যে আপনারা চিত্রশিল্পী সালভাদর ডালিকে খুঁজে পাবেন। এই বিরাট দৃশ্যটি এ ছবির এক অনন্য সম্পদ। এটা দেখলে মনে পড়ে যেতে পারে সত্যজিৎ রায়ের ‘নায়ক’ ছবিতে উত্তরকুমারের স্বপ্নদৃশ্যটির কথাও।
‘ভার্টিগো’ হিচককের তৈরি অনবদ্য এক ছবি। ১৯৫৮ সালে তিনি এ ছবি নির্মাণ করেছিলেন। সান ফ্রান্সিসকো পুলিশ বিভাগের একজন গোয়েন্দা ছিলেন জন ফার্গুসন (জেমস স্টুয়ার্ট)। কিন্তু উচ্চতাভীতির জন্য তাঁর চাকরি চলে যায়। এরপর তাঁর ধনাঢ্য বাল্যবন্ধু গ্যাভিন এলস্টারের সঙ্গে দেখা হলে সেই বন্ধু এক অদ্ভুত কাজের দায়িত্ব দেয় জনকে। তাঁর স্ত্রী নিজেকে অন্য মানুষ মনে করে এবং সে আত্মহত্যা করতে পারে, এ রকম সন্দেহ থাকায় তাঁকে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব দেওয়া হয় জনকে। ম্যাডেলিন এলস্টার চরিত্রে দারুণ অভিনয় করেছেন কিম নোভাক। কাহিনি যে কোন দিক দিয়ে কোন দিকে গড়ায়, তা ছবির শেষ দৃশ্যের আগে বোঝার উপায় নেই। এটুকু বলে রাখি, কাজ করতে গিয়ে জন প্রেমে পড়ে যায় ম্যাডেলিনের, কিন্তু সেটাই এই ছবির মূল বিষয় নয়।
১৯৬০ সালে হিচককের তৈরি ‘সাইকো’ ছবিটি যিনি দেখেছেন, তিনিই হয়েছেন বাকরুদ্ধ। ছবিটি বক্স অফিসে আনে অসামান্য সাফল্য। সমালোচকেরাও প্রশংসায় মুখর হয়ে বলেন, এমন ছবিও হয়! এ ছবির বাঁকে বাঁকে ভাবনার বদল ঘটেছে। যে সুন্দরী ম্যারিয়ন ক্রেনকে (জেনেট লে) শুরুতে মনে হতে পারত ছবির নায়িকা, তাকেই কিছুক্ষণ পর মনে হবে ভিলেন। তাঁর পেছনে গোয়েন্দা লেগেছে। কোথায় গেল সে? কোথায় তার গাড়িটা? বোন লিলা ক্রেস (ভেরা মাইলস) বোনকে খুঁজতে খুঁজতে চলে আসে এক পান্থনিবাসে। সেখানেই দেখা হয় নরম্যান বেটসের (অ্যান্থনি পারকিনস) সঙ্গে। এ রকম অমায়িক মানুষ খুব কমই দেখা যায়। তারপর কী হয়, সেটা রহস্যই থাকুক। সবকিছু বলে দিলে সিনেমা দেখার আনন্দ আর থাকে না। এ ছবিতে একটি স্নানের দৃশ্য আছে, যার তুলনীয় দৃশ্য খুঁজে পাওয়া কঠিন।
(লেখাটি পুনঃপ্রকাশিত)