সেরা পরিচালকদের চোখে কিংবদন্তি আকিরা কুরোসাওয়া

আকিরা কুরোসাওয়াআইএমডিবি

‘প্রতিদিনকার একঘেয়েমির মধ্যে তখন সিনেমা আমাকে যে বৈচিত্র্য এনে দিত, সিনেমা দেখায় আমি যে আনন্দ পেতাম, তা আর কোথাও পেতাম না। তাই সিনেমা আমি প্রাণভরে উপভোগ করতাম। ছোটবেলায় দেখা অনেক ছবির বিশেষ বিশেষ অংশ আমার স্মৃতিতে আজও অম্লান হয়ে আছে।’ আত্মজীবনীতে লিখেছেন তিনি। চলচ্চিত্রের ইতিহাসে সেরা চলচ্চিত্রকারদের তালিকা করতে গেলে প্রথম দিকে তাঁর নাম আসবেই। তিনি আকিরা কুরোসাওয়া। আজ তাঁর জন্মদিন। জাপানের এ কিংবদন্তি নির্মাতা সিনেমার চিত্রভাষায় যে অবদান রেখেছেন, তা এককথায় অতুলনীয়।
কুরোসাওয়া নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। তিনি ছিলেন একই সঙ্গে পরিচালক, চিত্রনাট্যকার, চলচ্চিত্র সম্পাদক ও প্রযোজক। ১৯১০ সালের ২৩ মার্চ জাপানের টোকিওর এক সিনেমাভক্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ছোটবেলা থেকেই প্রচুর ছবি দেখার সুযোগ পেয়েছেন, দেখেছেন এবং এটা তিনি বেশ উপভোগও করছেন। সিনেমা দেখার পাশাপাশি ছোটবেলা থেকেই তাঁর ঝোঁক ছিল আঁকাআঁকিতে। স্কুলের পড়াশোনা শেষে ছবি আঁকার প্রতি তাঁর আগ্রহ ক্রমে বাড়তে থাকে এবং ১৭ বছর বয়সেই চিত্রকর হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। চলচ্চিত্রজগতে তাঁর পথচলার শুরু সহকারী পরিচালক হিসেবে ১৯৩৫ সালে।

ওই বছর তিনি চলচ্চিত্র পরিচালক ইয়ামাসানের সহকারী হিসেবে কাজ শুরু করেন এবং এ কাজের মাধ্যমে তিনি তাঁর প্রতিভা মেলে ধরতে সক্ষম হন। পরপর কয়েকটি ছবিতে সহকারী পরিচালকের কাজ করার পর ১৯৪১ সালে দুটি চিত্রনাট্য লিখে পুরস্কার লাভ করেন। একই সময়ে জাপানের নবগঠিত চলচ্চিত্র স্টুডিও তোহা কোম্পানির প্রধান পরিচালকের পদ লাভ করেন।

আবেল গাঁস, জন ফোর্ড, হাওয়ার্ড হকস, জর্জ স্টিভেন, ফ্র্যাংক কাপরা, উইলিয়াম ওয়াইলার প্রমুখ চলচ্চিত্রকারের কাজ আকিরা কুরোসাওয়ার অন্যতম অনুপ্রেরণার উত্স। কিন্তু তিনি কাউকে অনুকরণ করতেন না। আকিরা কুরোসাওয়া ছবি নির্মাণ করতেন একেবারেই নিজস্ব ঢঙে। তাঁর প্রতিটি ছবির স্বকীয়তা বিশেষভাবে চোখে পড়ার মতো।
১৯১০ সালের ২৩ মার্চ জাপানের টোকিওর এক সিনেমাভক্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তিনি
আইএমডিবি

এই কোম্পানির ব্যানারে পরিচালক হিসেবে তাঁর অভিষেক ঘটে। ছবির নাম ‘সুগাতা সানশিরো’। মুক্তি পায় ১৯৪৩ সালে। প্রথম ছবিতেই পরিচালক হিসেবে আকিরা কুরোসাওয়ার প্রতিভার প্রমাণ পাওয়া যায়। ছবিটি একই সঙ্গে জনপ্রিয়তা পায় এবং বোদ্ধা-সমালোচকদের প্রশংসা কোড়ায়। এরপর শুধুই এগিয়ে চলা। বিশ্ব চলচ্চিত্রে আকিরা।
আকিরা কুরোসাওয়া অর্ধশত বছরের বেশি সময় চলচ্চিত্রজগতে সক্রিয় থেকে ৩১টির মতো ছবি নির্মাণ করেন। আরও ৩০টি ছবির চিত্রনাট্য তাঁর লেখা। তাঁর হাতে নির্মিত হয়েছে ‘রশোমন’, ‘ইকিরু’, ‘সেভেন সামুরাই’, ‘থ্রোন অব ব্লাড’, ‘ইওজিম্বো’, ‘দারসু উজালা’, ‘র‍্যান’, ‘কাগেমুশা’র মতো অসাধারণ সব চলচ্চিত্র।

প্রায় সব কটি মর্যাদাকর চলচ্চিত্র পুরস্কার জিতেছে কুরোসাওয়ার ছবি। ১৯৫১ সালের ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে ‘রশোমন’পেয়েছিল গোল্ডেন লায়ন পুরস্কার। ১৯৫৪ ও ১৯৫৯-এর বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কার পান কুরোসাওয়া। ১৯৭৬ সালে ‘দারসু উজালা’ পায় অস্কারে সেরা বিদেশি ছবির পুরস্কার। ১৯৮০-তে কান চলচ্চিত্র উৎসবে ‘কাগেমুশা’জেতে পাম ডিওর। ১৯৮১-তে ‘কাগেমুশা’র জন্য সেরা পরিচালক হিসেবে কুরোসাওয়া জেতেন বাফটা পুরস্কার। ১৯৮৭-তে বাফটা পায় ‘র‍্যান’। ১৯৯০ সালে কুরোসাওয়াকে দেওয়া হয় সম্মানসূচক অস্কার। এ ছাড়া অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মানে ভূষিত হয়েছেন তিনি।

ছবি নির্মাণের টাকা সংগ্রহের জন্য একসময় তিনি টিভিতে অভিনয়ও করেছেন। ১৯৫২ সালের পর থেকে তাঁর সব ছবির সম্পাদনা তিনি নিজেই করেন। তাঁর রচিত চিত্রনাট্যে অন্যান্য চলচ্চিত্রকারের নির্মিত ছবির সংখ্যা ২২টির মতো। বিশ্ব চলচ্চিত্র জগতের মাইলফলক, আকিরা কুরোসাওয়ার অসাধারণ সৃষ্টি রশোমন মুক্তি পায় ১৯৫০ সালে। ছবিটি ১৯৫১ সালে ভেনিস চলচ্চিত্র উত্সবে শ্রেষ্ঠ ছবির পুরস্কার লাভ করে।
তাঁর প্রতিটি ছবির স্বকীয়তা বিশেষভাবে চোখে পড়ার মতো
আইএমডিবি

শুধু পুরস্কার দিয়ে কুরোসাওয়ার মাপ বোঝা দুষ্কর। তাঁরই সঙ্গে সেরার তালিকায় স্থান পাওয়া আরও নির্মাতারা তাঁকে অনেক ক্ষেত্রেই চলচ্চিত্রের শিক্ষক মনে করতেন। কুরোসাওয়ার মাত্র একটি ছবি দেখেছিলেন ইতালীয় নির্মাতা ফেদেরিকো ফেলিনি। ‘সেভেন সামুরাই’ দেখে তিনি বলেছিলেন, ‘একজন চলচ্চিত্রস্রষ্টা কেমন হওয়া উচিত, কুরোসাওয়া তার জীবন্ত দৃষ্টান্ত।’

আরেক ইতালীয় নির্মাতা বের্নার্দো বের্তুলিসি বলেছিলেন, ‘কুরোসাওয়ার ছবি ও ফেলিনির “লা ডলসে ভিটা” আমাকে চলচ্চিত্র নির্মাতা হতে প্রেরিত করেছে।’ ‘টুয়েলভ অ্যাংরি ম্যান’খ্যাত আমেরিকান নির্মাতা সিডনি লুমেট বলেছিলেন, ‘ছবি বানানোর ক্ষেত্রে কুরোসাওয়া কখনোই আমাকে অনুপ্রাণিত করেননি, কেননা কখনোই মনে হয়নি, আমি তাঁর মতো বোধ ও দর্শন ধারণ করার যোগ্য।’

আকিরা কুরোসাওয়া বিশ্বের অনেক মহান সাহিত্যিকের নাটক ও উপন্যাস নিয়ে কাজ করেছেন। তাঁদের মধ্যে উইলিয়াম শেক্‌সপিয়ার, ফিওদর দস্তয়ভস্কি ও ম্যাক্সিম গোর্কি অন্যতম।
আকিরা কুরোসাওয়া অর্ধশত বছরের বেশি সময় চলচ্চিত্রজগতে সক্রিয় থেকে ৩১টির মতো ছবি নির্মাণ করেন
আইএমডিবি

আরেক কিংবদন্তি নির্মাতা সুইডেনের ইঙ্গমার বার্গম্যান নিজের ছবি ‘দ্য ভার্জিন স্প্রিং’ নিয়ে বলেছিলেন, ‘আমি এখন খোলাখুলিই বলতে চাই, আমার ছবিটিকে একটি বিকৃতি হিসেবে দেখা উচিত। এটি কুরোসাওয়ার একটি বাজে অনুকরণ।’ আমেরিকান নির্মাতা মার্টিন স্করসেসে বলেছেন, ‘সারা দুনিয়ার চিত্রনির্মাতাদের ওপর তাঁর (কুরোসাওয়ার) প্রভাব এতই গভীর যে তাঁর সঙ্গে আর কারও তুলনা চলে না।’
আমেরিকান নির্মাতা ফ্রান্সিস ফোর্ড কপোলা বলেছেন, ‘একটি ব্যাপার কুরোসাওয়াকে অন্যদের থেকে আলাদা করে দেয়। তিনি একটি বা দুটি মাস্টারপিস বানাননি। তিনি বানিয়েছেন আটটি মাস্টারপিস!’

আমেরিকান নির্মাতা স্টিভেন স্পিয়েলবার্গ যা বলেছেন, তা-ই বোধ হয় কুরোসাওয়াকে এককথায় প্রকাশের সর্বোচ্চ পরাকাষ্ঠা। স্পিয়েলবার্গ বলেছেন, ‘কুরোসাওয়া হচ্ছেন আমাদের সময়ের চলচ্চিত্রের শেক্‌সপিয়ার।’

বিশ্বের অনেক পরিচালক তাঁর কাজে অনুপ্রাণিত ও প্রভাবিত। তাঁর নির্মিত বেশ কয়েকটি ছবি হলিউড, বলিউডসহ পৃথিবীর অনেক দেশে পুনর্নির্মিত (রিমেক) হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে সেভেন সামুরাই-এর কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। এর হলিউড সংস্করণ হচ্ছে দ্য ম্যাগনিফিসেন্ট সেভেন ও বলিউড সংস্করণ শোলে।
চলচ্চিত্রে বিশেষ অবদানের জন্য তিনি ১৯৯০ সালে সম্মানসূচক একাডেমি অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন
আইএমডিবি

এন্টারটেইনমেন্ট উইকলি কর্তৃক নির্বাচিত সর্বকালের সেরা পরিচালকদের মধ্যে আকিরা কুরোসাওয়ার অবস্থান ষষ্ঠ। শ্রেষ্ঠ ৫০ জন চলচ্চিত্রকারের মধ্যে তিনি একমাত্র এশীয় ও আমেরিকানদের বাইরে তাঁর অবস্থান সবার ওপরে। মহান এই শিল্পী ১৯৯৮ সালের ৬ সেপ্টেম্বর জাপানের টোকিওতে মারা যান।
(প্রতিবেদনটির কিছু অংশ ২০১৭ সালে প্রথম আলো বিনোদনে আকিরা কুরোসাওয়ার জন্মদিনে প্রকাশিত ফিচার থেকে নেওয়া)