চরকির হয়ে কান চলচ্চিত্র উৎসবে

৩৫ হাজারের বেশি চলচ্চিত্রপ্রেমী ও চলচ্চিত্র পেশাজীবী ফ্রান্সের সমুদ্রতীরবর্তী শহর কানে সমবেত হয়েছেন।

মুজিব: দ্য মেকিং অব আ নেশন–এর পোস্টার

রেলস্টেশন থেকে পাঁচ মিনিটের হাঁটাপথ; তাহলেই পালে দে ফেস্টিভ্যাল ভবন, কান চলচ্চিত্র উৎসবের প্রাণকেন্দ্র। ভবনটার দিকে যত এগোচ্ছি, ততই উত্তেজনা বাড়ছে। কেননা, এটাই ফ্রান্সে আমার প্রথম কান চলচ্চিত্র উৎসবে আসা।

চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে সারা জীবনই আকাঙ্ক্ষা ছিল কানে আসব, সব নির্মাতারই হয়তো সেটা থাকে। আমার সেই স্বপ্নের সঙ্গে এবার যুক্ত হয়েছে চরকি। চরকির প্রতিনিধি হয়ে এবার কানে এসেছি।

চরকিতে যেহেতু সারা পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষার সিনেমা বাংলা ভাষায় পরিবেশন করি, তাই আমার এই উৎসবে আসার প্রধান উদ্দেশ্য হলো পরিবেশকদের সঙ্গে কথা বলা, আন্তর্জাতিক যোগাযোগ গড়ে তোলা, বিশ্ব চলচ্চিত্রের সঙ্গে সংযোগ তৈরি। একই সঙ্গে কোন দিকে যাচ্ছে বিশ্ব চলচ্চিত্রের চলতি হাওয়া, সেটাও বোঝা। আমি মনে করি, চরকিকে সমৃদ্ধ করতে এগুলো সহযোগিতা করবে। সেই জায়গা থেকে আমার দায়িত্বটা এবার অনেক বেশি।

খানিক বাদে অ্যাক্রেডিটেশন কার্ডের লাইনে দাঁড়ালাম। আমার পালা এলে নাম বলতেই তারা বলল, ‘আর ইউ ফ্রম চরকি?’ এই প্রথম চরকির নাম কানে উচ্চারিত হলো। আমার কাছে অন্য রকম এক অনুভূতি।

পালে দে ফেস্টিভ্যালের দিকে যেতে যেতে দেখি আশপাশে হেঁটে-চলে বেড়াচ্ছেন সিনেমাপ্রেমী মানুষ, পরিচালক, প্রযোজক, পরিবেশক, সারা দুনিয়ার মানুষ। সবার কাছে ফেস্টিভ্যাল ব্যাজ। ব্যাজগুলো দেখে আমার ভেতরে অদ্ভুত এক উত্তেজনা হলো, আর একটু পর আমিও ব্যাজটা পাব।

সামান্য পথ, তারপরও পালে দে ফেস্টিভ্যাল ভবনে হেঁটে যেতে যেতে ক্লান্ত হয়ে পড়লাম। আসলে ভিসা পাওয়ার পর থেকে দুদিন ধরে অর্থাৎ ১৯ মে সকাল থেকে দৌড়ের ওপরেই আছি।

পাম দ’রের স্থাপনার পাশে এলভিসের নাচের মুদ্রায় শিল্পী এরল প্রয়ার
ছবি: রয়টার্স

এমিরেটসের ফ্লাইটে দুবাই নেমেছি। নেমেই আবার খুব দ্রুত প্যারিসের কানেক্টিং ফ্লাইট ধরতে হয়েছে। সেখানে নামার পর আবার দূরের আরেকটা বিমানবন্দরে গিয়ে অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটে নিসে আসছি। সেখান থেকে আবার বাসে করে কান। দীর্ঘ যাত্রায় স্বভাবতই ভীষণ ক্লান্ত। কিন্তু সব ক্লান্তি ছাপিয়ে আমার মধ্যে যে উত্তেজনা কাজ করছে, তা হচ্ছে উৎসবের আনন্দ।

খানিক বাদে অ্যাক্রেডিটেশন কার্ডের লাইনে দাঁড়ালাম। আমার পালা এলে নাম বলতেই তারা বলল, ‘আর ইউ ফ্রম চরকি?’ এই প্রথম চরকির নাম কানে উচ্চারিত হলো। আমার কাছে অন্য রকম এক অনুভূতি।

১৭ মে বাংলাদেশ সময় রাত ১১টায় ৭৫তম কান চলচ্চিত্র উৎসবের পর্দা ওঠে। উদ্বোধনী সিনেমা ফাইনাল কাট প্রদর্শনীর মধ্য দিয়ে শুরু হয় এবারের আসর। ২০ মে আমি এসে যোগ দিয়েছি। গত তিন দিনে এখানে অনেক কিছু হয়ে গেছে। যেগুলো আমি গণমাধ্যমের খবর থেকে দেখেছি, জেনেছি।

এবারে উৎসবে বাংলাদেশ থেকে আমাদের অনেক সাংবাদিক ভাই, সসন্তান মোস্তফা সরয়ার ফারুকী ও নুসরাত ইমরোজ তিশা, আবু শাহেদ ইমনসহ আরও অনেকে এসেছেন। এর মধ্যেই ফারুকী ভাই তাঁর পরবর্তী সিনেমা নো ল্যান্ডস ম্যান–এর প্রধান চরিত্র জনপ্রিয় অভিনেতা নওয়াজুদ্দিন সিদ্দিকীর জন্মদিনের নৈশভোজে অংশ নিয়েছেন।

বাংলাদেশের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র হিসেবে তারেক মাসুদের মাটির ময়না ২০০২ সালের ১৫ মে ৫৫তম কান চলচ্চিত্র উৎসবের ডিরেক্টরস ফর্টনাইটে প্রদর্শিত হয়। এরপর গত বছর আবদুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ পরিচালিত রেহানা মরিয়ম নূর ৭৪তম আসরের আঁ সার্তেঁ রি‍গায় নির্বাচিত হয়, যা কানে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের সবচেয়ে বড় পাওয়া।

পাবলো পিকাসোর ভাস্কর্য
ছবি: প্রথম আলো

এ বছর প্রতিযোগিতা বিভাগে আমাদের সিনেমা নেই, তবে উৎসবে আমাদের উপস্থিতি আছে। মার্শ দ্যু ফিল্মের স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র বিভাগে নুহাশ হুমায়ূনের মশারি আছে। বাণিজ্যিক শাখায় শ্যাম বেনেগাল পরিচালিত মুজিব: দ্য মেকিং অব আ নেশন সিনেমাটির ট্রেলার মুক্তি পেয়েছে।

করোনা মহামারিতে ২০২০ সালে এই উৎসব অনুষ্ঠিত হয়নি। আর ২০২১-এ খুব সীমিত পরিসরে বসেছিল এই আসর। ২০২২-এর আসরের দিকে তাই এবার সবার নজর। ৩৫ হাজারের বেশি চলচ্চিত্রপ্রেমী ও চলচ্চিত্র পেশাজীবী ফ্রান্সের সমুদ্র তীরবর্তী শহর কানে সমবেত হয়েছেন। লালগালিচা আর নানা আড়ম্বরপূর্ণ আয়োজনে পরিচালক, তারকা, প্রযোজকদের উপস্থিতি সেই কথাই জানিয়ে দিয়েছে। গত কয়েক দিনে কানের রেড কার্পেটে বিশ্বের বড় তারকারা হেঁটেছেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন মার্কিন অভিনেতা টম ক্রুজ, বলিউডের ঐশ্বরিয়া রাই বচ্চন, দীপিকা পাড়ুকোনসহ আরও অনেকে।

পাশেই দেব্যুসি নামের আরেকটা সিনেমা হল। পালে দে ফেস্টিভ্যাল ভবনের সালি বুনুয়েল প্রেক্ষাগৃহেও সিনেমা দেখানো হয়। এবার ভারতীয় চলচ্চিত্রকে আলাদা করে সম্মান জানানো হয়েছে, মার্শ দ্যু ফিল্মের ভেতরে সত্যজিৎ রায়, সুচিত্রা সেনসহ ভারতীয় সিনেমা কিংবদন্তিদের ফিচার করা হয়েছে। তাঁদের বড় বড় ব্যানার শোভা পাচ্ছে।
কানে এবার ভারতীয় চলচ্চিত্রকে আলাদা করে সম্মান জানানো হয়েছে
ছবি: প্রথম আলো

ফেস্টিভ্যাল ভবন

মূলত তিনটি বড় বড় ভবনজুড়ে ফেস্টিভ্যাল সাইট। মূল প্রতিযোগিতার সিনেমাগুলো দেখানো হয় গ্র্যান্ড থিয়েটার লুমিয়ারে। আর রেড কার্পেটে তারকাদের হাঁটাহাঁটিও সব এখানেই হয়।

মাঝখানের ভবনটি হলো মেইন ফেস্টিভ্যাল প্যালেস। সেখানে আছে মার্শ দ্যু ফিল্ম, মানে ফিল্ম মার্কেটের অসংখ্য স্টল। সারা পৃথিবীর বড় বড় চলচ্চিত্র প্রযোজক ও পরিবেশকেরা এখানে আসছেন। এখানে সবার সঙ্গে নেটওয়ার্কিং তৈরি করাই আমার মূল লক্ষ্য, যাতে করে এখান থেকে আমি চরকির জন্য কনটেন্ট বা সিনেমা নিতে পারি।

পাশেই দেব্যুসি নামের আরেকটা সিনেমা হল। পালে দে ফেস্টিভ্যাল ভবনের সালি বুনুয়েল প্রেক্ষাগৃহেও সিনেমা দেখানো হয়। এবার ভারতীয় চলচ্চিত্রকে আলাদা করে সম্মান জানানো হয়েছে, মার্শ দ্যু ফিল্মের ভেতরে সত্যজিৎ রায়, সুচিত্রা সেনসহ ভারতীয় সিনেমা কিংবদন্তিদের ফিচার করা হয়েছে। তাঁদের বড় বড় ব্যানার শোভা পাচ্ছে।

ইন্টারন্যাশনাল প্যাভিলিয়নে ব্রাজিলিয়ান পরিচালকদের সঙ্গে লেখক
ছবি: প্রথম আলো

পিকাসোর বাড়ি

হঠাৎ এক দাওয়াত পেলাম পাবলো পিকাসোর গ্রামে। সরয়ার ভাই ও সাংবাদিক ভাইয়েরা মিলে নৈশভোজের দাওয়াত। গ্রামের ভেতরেই একটা বাঙালি রেস্তোরাঁ আছে। সেজান ভাইয়ের রেস্তোরাঁ। তাঁদের আতিথেয়তায় সেখানে বাংলা খাবার খেয়ে মুগ্ধ হলাম। তারপর পিকাসোর বাড়ির সামনে অনেক ছবি তুলেছি। অদ্ভুত ছিল এই রাতটা।

এ আর রহমানের লে মাস্ক দেখতে বসতে হয় বিশেষ চেয়ারে
ছবি: প্রথম আলো

উৎসব কার্যক্রম

কানে আমার দ্বিতীয় দিনের শুরুতেই উৎসবে একটু ঘোরাঘুরি করলাম। তিনজন পরিবেশকের সঙ্গে বৈঠক হলো। কীভাবে তাঁদের সিনেমা চরকিতে দেখাতে পারি, সে বিষয়ে আলোচনা চলল। পরে আমাদের টিম চরকির সঙ্গে অনলাইনে মিটিংয়ের শিডিউল ঠিক করলাম। তারপর রাতে আবার হোটেল বদলালাম।

মূল উৎসব এলাকার বাইরেও অনেক সিনেমা হলে উৎসবের ছবি দেখানো হয়।

নতুন যে হোটেলে উঠেছি, সেটার নাম কিরিয়াদ। এই হোটেলের পাশে সিনিউম নামে বড় একটা মাল্টিপ্লেক্স আছে। আমার মূলত উদ্দেশ্য ঘুম থেকে উঠেই এই হলগুলোতে সিনেমা দেখে ফেলা। সিনেমা দেখে পরে দুপুরের দিকে আবার চলে যাই মূল উৎসব চত্বরে।