জাফর পানাহি এক নির্ভীক চলচ্চিত্রকার

জাফর পানাহি
জাফর পানাহি

যে কজন ইরানি চলচ্চিত্রকার বদলে দিয়েছেন ইরানি চলচ্চিত্রজগত্, তৈরি করেছেন ‘নবতরঙ্গ’; যাঁদের নির্মিত চলচ্চিত্র আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র অঙ্গনে দখল করে নিয়েছে বিশেষ স্থান, তাঁদের অন্যতম জাফর পানাহি। ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে ইরানের আরেক বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার আব্বাস কিয়ারোস্তামির সহকারী ছিলেন। ১৯৯৫ সালে মুক্তি পায় তাঁর প্রথম ফিচার ফিল্ম দ্য হোয়াইট বেলুন। ছবিটির চিত্রনাট্য লিখেছিলেন স্বয়ং কিয়ারোস্তামি। প্রথম ছবিতেই বাজিমাত। ছবিটি কান চলচ্চিত্র উত্সবে জিতে নেয় ‘গোল্ডেন পাম’ পুরস্কার। ১৯৯৭ সালে মুক্তি পাওয়া তাঁর দ্য মিরর যেন প্রচলিত সিনেমার সংজ্ঞাই পাল্টে দেয়। ২০০০ সালে দর্শককে উপহার দেন আরেক মাস্টারপিস দ্য সার্কেল। ২০০৩ সালে ইরানে তোলপাড় সৃষ্টি করা ছবি ক্রিমসন গোল্ড, ২০০৬ সালে ইরানি চলচ্চিত্রের আতশবাজি অফসাইড। এ পর্যন্ত এসে থামতে হয়েছে পানাহিকে। আসলে তাঁকে থামিয়ে দেওয়া হয়েছে। ২০১০ সালের ডিসেম্বরে ইরান সরকার ছয় বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে নির্ভীক এ চলচ্চিত্র নির্মাতাকে। শাস্তির তালিকা এখানেই শেষ নয়, আগামী ২০ বছরে ছবি পরিচালনা, চিত্রনাট্য, গল্প, নাটক, স্মৃতিকথা এমনকি ডায়েরি লেখা—কোনো কাজই করতে পারবেন না তিনি! এ ছাড়া দেশ-বিদেশের গণমাধ্যমকে সাক্ষাত্কার প্রদান ও দেশ ত্যাগের ক্ষেত্রেও জারি করা হয়েছে নিষেধাজ্ঞা। আদতে তাঁর হাত-পা একপ্রকার বেঁধেই ফেলা হয়েছে। জাফর পানাহির অপরাধ কি? ইরান সরকার অপরাধ হিসেবে দেখিয়েছে, তিনি নাকি সে দেশের ‘প্রথাবিরোধী’ প্রচারণা ও চলচ্চিত্রের মাধ্যমে সরকারবিরোধীদের ‘উসকে’ দিচ্ছেন। কর্তৃপক্ষের ভাষায়, ‘তিনি ইসলামি প্রজাতন্ত্রের বিরুদ্ধে রটনায় যুক্ত’! কঠোর বাধা-নিষেধের মধ্যেই নির্মিত হয় ইরানের চলচ্চিত্র। এ কারণে সেখানকার অনেক নির্মাতাকে হামেশাই সরকারের রোষানলে পড়তে হয়। তবে পানাহির এমন ‘শাস্তি’র ঘটনা যেমন দুঃখজনক, তেমনি বিরল বৈকি। পানাহির শাস্তির বিরুদ্ধে সারা বিশ্বেই প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। কিন্তু ইরান সরকার এ ব্যাপারে একেবারেই নির্বিকার। তাঁর সব ছবিই ইরানি সমাজের নানা বিষয়ে সরাসরি বা অনুচ্চভাবে সমালোচনামূলক। পানাহির নির্মাণকৌশল দুর্দান্ত, কাব্যিক (পোয়েটিক), আইরোনি, দৃশ্যগুলো বেশ দীর্ঘ কিন্তু হূদয়গ্রাহী, সুর সংযোজনা শক্তিশালী। চরিত্রগুলো বাস্তবের সঙ্গে মিশে যায় অনায়াসে। তাঁর ছবিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী ইতালির সিনেমার ‘নিও-রিয়ালিজম বা নয়া বাস্তবতাবাদে’র প্রভাব স্পষ্ট। তিনি নিজেও অনেকবার বলেছেন, ভিত্তোরিও ডি সিকার দ্য বাইসাইকেল থিফ তাঁকে ভীষণ প্রভাবিত করেছে। জাফর পানাহি সেই চলচ্চিত্রকার, যিনি রুপালি পর্দায় তুলে ধরেন মানবতা, জেন্ডার সাম্য ও ব্যক্তিস্বাধীনতার পুঙ্খানুপুঙ্খ চিত্র। তাঁর ছবি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় প্রচলিত সমাজব্যবস্থার নানা অসংগতি। ফিল্ম জার্নাল রিভার্স শর্টকে দেওয়া এক সাক্ষাত্কারে বলেছিলেন, ‘আমি এই সমাজে বাস করি। চারপাশে যা দেখি আর যা আমাকে ব্যক্তিগতভাবে প্রভাবিত করে, আমার কাজের সমস্ত উপাদান তা থেকেই আসে।’

কেউ কেউ বলেন, তিনি নাকি ‘অ্যাক্টিভিস্ট ফিল্মমেকার’। এর জবাবে পানাহি বলেন, ‘নিজেকে একজন সামাজিকভাবে দায়বদ্ধ চলচ্চিত্রনির্মাতা মনে করি, রাজনৈতিক এজেন্ডাধারী কেউ না। আমার ছবি আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাসের প্রতিফলন ঘটায়। ছবির চরিত্ররা সবাই সেই ব্যক্তিগত বিশ্বাসের রূপক।’ আর এখানেই যত ভয় শাসকগোষ্ঠীর। এ কারণেই হয়তো জাফর পানাহির ছবি শেল হয়ে বেঁধে সমাজপতিদের বুকে। ফলে শেষ তিনটি ছবি দ্য সার্কেল, ক্রিমসন গোল্ড ও অফসাইড নিজভূমেই হয় নিষিদ্ধ। স্বদেশে নিষিদ্ধ হলে কী, তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে নানা উপায়ে তা ছড়িয়ে পড়েছে গোটা বিশ্বে! চলচ্চিত্রকার হিসেবে বিশ্বের অনেক মর্যাদাবান পুরস্কারই উঠেছে তাঁর হাতে। কারাবরণের আগে আদালতে বেদনা-ভারাক্রান্ত মনে বলেছিলেন, ‘তেহরান চলচ্চিত্র জাদুঘরে বিভিন্ন উত্সবে জেতা জাফর পানাহির পুরস্কারগুলোর জন্য যতটুকু জায়গা ছাড়া হয়েছে, সেটা তাঁর জন্য নির্ধারিত কারাপ্রকোষ্ঠের তুলনায় অনেক বড়।’ পানাহি যখন বাড়িতে অন্তরীণ ছিলেন, তখন তাঁকে নিয়ে দিজ ইজ নট অ্যা ফিল্ম নামে একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেছিলেন তাঁরই সহপরিচালক মোজতাবা মিরতাহমাসব। পরিচালক হিসেবে তিনি পানাহির নামও দিয়েছিলেন ছবিটিতে। এ প্রামাণ্যচিত্রের শেষ দৃশ্যে দেখা যায়, পানাহি বাড়ি থেকে বের হচ্ছেন। তাঁকে বাধা দিয়ে পেছন থেকে বলা হচ্ছে—‘মি. পানাহি, বাইরে যাবেন না। তারা (পুলিশ) ক্যামেরাসহ আপনাকে দেখে ফেলতে পারে।’

সাহসী এ ইরানি চলচ্চিত্রনির্মাতার জন্মদিন আজ। ১৯৬০ সালের ১১ জুলাই ইরানের মিয়ানে হতে নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম। মাত্র ১০ বছর বয়সেই চলচ্চিত্রজগতের সঙ্গে পরিচিতি ঘটে তাঁর। ওই বয়সেই দুম করে আট মিলিমিটারে নির্মাণ করেন একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। পরবর্তী সময়ে সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে অংশ নেন ইরান-ইরাক যুদ্ধে। এরপর তেহরান কলেজ অব সিনেমা অ্যান্ড টেলিভিশনে চলচ্চিত্র পরিচালনা বিষয়ে পড়াশোনা শেষে পেশাদার নির্মাতা হিসেবে যাত্রা শুরু। এবারও হয়তো একটা পানসে জন্মদিন কেটে যাবে কারাপ্রকোষ্ঠে। বুক চিরে বেরিয়ে আসবে দীর্ঘশ্বাস। ভক্ত, অনুরাগীদের প্রত্যাশা—শাসকগোষ্ঠীর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে, সব নিষেধাজ্ঞার বেড়াজাল ফুঁড়ে ভবিষ্যতেও তিনি উপহার দেবেন দুর্দান্ত, কালজয়ী সব ছবি। শুভ জন্মদিন নির্ভীক চলচ্চিত্রকার জাফর পানাহি।