সব রেকর্ড ভেঙে দিল ‘ডেমন স্লেয়ার’

বক্স অফিসের সব রেকর্ড ভেঙে দিয়ে সবচেয়ে বেশি আয়ের ছবিতে পরিণত হয়েছে ‘ডেমন স্লেয়ার’ছবি: সংগৃহীত

‘পিশাচ বধ’ বা ‘ডেমন স্লেয়ারে’ নামের কমিকস বইয়ের প্রথম খণ্ড ২০১৬ সালে প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই জাপানে এটা জনপ্রিয়তা লাভ করতে শুরু করে। ‘পিশাচ বধ’–এর কাহিনি বইটি ইতিমধ্যে ২১টি খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। এর প্রতিটিতে আছে একসূত্রে গাঁথা ভিন্ন গল্প। গল্প আবর্তিত হয়েছে প্রায় এক শ বছর আগে তাঞ্জিরো কামাদো নামের এক বালকের দানবকে বধ করায় চালানো অভিযানকে ঘিরে। পিশাচের দল পৃথিবীতে নেমে এসে মানুষকে মেরেকেটে সাফ করে দিতে শুরু করলে বালকের পরিবারের সবইকে সেই হামলার শিকার হতে হয়। তবে একমাত্র বোন নেজুকো সেই ধ্বংসযজ্ঞের হাত থেকে বেঁচে যায়। তবে বোনটিও পিশাচের দলে ভিড়ে গিয়ে পিশাচ হয়ে যায়। এরপর বালক তার সমবয়সীদের নিয়ে একটি দল গড়ে তুলে পিশাচ বধে লিপ্ত হয়। বোনকে উদ্ধারের জন্য অভিযান শুরু করে।

গত রোববার পর্যন্ত এই একটি ছবি থেকে আয় হয়েছে মোট ৩ হাজার ২৪৭ কোটি ইয়েন
ছবি: সংগৃহীত

খুব অল্প কথায় এই হলো ‘ডেমন স্লেয়ার’–এর কাহিনির রূপরেখা। তবে জনপ্রিয় সেই কমিকস নিয়ে কার্টুন ছবি তৈরি করায় আনিপ্লেক্স ইঙ্ক এবং তোহো কোম্পানি যৌথভাবে উদ্যোগ নেওয়ার সময় উদ্যোক্তারা ধারণা করতে পারেননি কতটা জনপ্রিয় এই ছবি হয়ে উঠতে পারে। ছবিটি জাপানে মুক্তি পাওয়ার দুই মাসের সামান্য কম সময়ের মধ্যে এটা এখন বক্স অফিসের সব রেকর্ড ভেঙে দিয়ে সবচেয়ে বেশি আয়ের ছবিতে পরিণত হয়েছে।

কার্টুন ছবি অবশ্য কমিকস বইয়ের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে তৈরি করা হয়নি। বরং একক একটি খণ্ডে ‘মুগেন ট্রেন: দ্য মুভি’ নামের ছবিতে রেলের যাত্রীদের একে একে পিশাচের খপ্পরে পড়ার হাত থেকে উদ্ধারে বালক ও তার দলের চালিয়ে যাওয় সংগ্রামকে দেখানো হয়েছে। জাপানি শব্দ ‘মুগেন’–এর অর্থ হচ্ছে অনন্ত। ফলে অনন্তযাত্রার সেই রেলে যাত্রীদের একে একে পিশাচের খপ্পরে পড়া এবং পিশাচদের বিরুদ্ধে বালকের দলের নানা রকম অভিযানের বর্ণনা কার্টুন ছবিতে তুলে ধরা হয়েছে। কমিকস সিরিজের লেখক হচ্ছেন কিওহারু গোতোগে। এর আগে টেলিভিশন সিরিজ আকারে দেখানো ছবি বড় প্রেক্ষাগৃহের জন্য ভিন্নভাবে পরিচালনা করেছেন আনিমে বা কার্টুন ছবির পরিচালক হারুও সোতোজাকি।

এই ছবি মানুষকে আশার কথা শোনাচ্ছে
ছবি: সংগৃহীত

গত রোববার পর্যন্ত এই একটি ছবি থেকে আয় হয়েছে মোট ৩ হাজার ২৪৭ কোটি ইয়েন বা আনুমানিক ৩১ কোটি ৩০ লাখ ডলার। এই হিসাব জাপানে হচ্ছে বক্স অফিসের আগের সব রকম রেকর্ড ভেঙে দেওয়া। এত দিন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি আয়ের বক্স অফিস রেকর্ড ছিল কার্টুন ছায়াছবির আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত বিখ্যাত পরিচালক হায়াও মিয়াজাকির তৈরি ‘স্পিরিটেড এওয়ে’ ছবিটির দখলে। এই সিনেমা আয় হয়েছিল ৩ হাজার ১৬৮ কোটি ইয়েন।

‘পিশাচ বধ’ যে নতুন রেকর্ড গড়তে চলেছে, সেই ইঙ্গিত প্রথম পাওয়া গিয়েছিল ছবিটি মুক্তি লাভের মাত্র ১০ দিনের মাথায় ১ হাজার কোটি ইয়েন আয়ের সীমা এটা অতিক্রম করে যাওয়ার সময়। জাপানে চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এত কম সময়ে ১ হাজার কোটি ইয়েন আয় অন্য আর কোনো ছবি থেকে হয়নি। এরপর নভেম্বর মাসের ৩০ তারিখে আয়ের দিক থেকে দ্বিতীয় স্থানে থাকা ‘টাইটানিক’কে এটা অতিক্রম করে যায়। এখন মুক্তি লাভের মাত্র দুই মাসের কম সময়ে ১ নম্বরে এটা উঠে এসেছে। কতটা দ্রুত এই সাফল্য সেটাও হচ্ছে চমকপ্রদ। মিয়াজাকির ছবির তিন হাজার কোটি ডলার আয়ের সীমানা অতিক্রম করে যেতে যেখানে সময় লেগেছে ২৫৩ দিন, ‘মুগেন ট্রেন’ মাত্র ৫৯ দিনে সেই রেকর্ড ছুঁয়ে যায়।

মুক্তি লাভের মাত্র দুই মাসের কম সময়ে ১ নম্বরে এটা উঠে এসেছে
ছবি: সংগৃহীত


জাপানের কার্টুন চলচ্চিত্র অনুরাগীদের পাশাপাশি সার্বিকভাবে ছায়াছবির ভক্তরা এটাকে এ রকম এক চমকপ্রদ সাফল্য হিসেবে দেখছেন, করোনাভাইরাস মহামারিকে কেন্দ্র করে নানা রকম সতর্কতা জাপানে চলতে থাকা সত্ত্বেও চলচ্চিত্র অনুরাগীদের যেটা সিনেমা হলে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। শুধু তা–ই নয়; করোনাভাইরাসের কারণে সংকটাপন্ন অবস্থায় থাকা জাপানের অর্থনীতির জন্যও এই দুর্দিনে এটা নিয়ে এসেছে সুখবর।

‘পিশাচ বধ’ কমিকস সিরিজ এ পর্যন্ত ১৪টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে এবং বইটি বিশ্বের ৩৩টি দেশ ও ভূখণ্ডে পাওয়া যাচ্ছে। অন্যদিকে ছায়াছবির বেশ কয়েকটি ভাষায় ডাবিংয়ের কাজ এখন দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলেছে এবং ২০২১ সালের শুরুর দিকে এর ইংরেজি সংস্করণ যুক্তরাষ্ট্রের হলে মুক্তি পাওয়ার কথা। এর আগে অবশ্য দেশের বাইরে তাইওয়ানে এটা প্রথম মুক্তি পায়। যুক্তরাষ্ট্রের পর ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ছবিটি দেখানোর পরিকল্পনা করছেন এর পরিবেশক ও প্রযোজকেরা। জাপানের চলচ্চিত্রশিল্পের জন্য এর মধ্য দিয়ে করোনার এই সময়েও বিশাল অঙ্কের আয়ের পথ তৈরি হয়ে যাবে বলে অনেকের ধারণা, কেননা অনলাইন প্রচারের কল্যাণে বিশ্বের অনেক দেশের লোকজনই এই ছবি সম্পর্কে ইতিমধ্যে জেনে গেছেন এবং অনেকেই এটা দেখার অপেক্ষায় আছেন।

কার্টুন ছবি অবশ্য কমিকস বইয়ের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে তৈরি করা হয়নি
ছবি: সংগৃহীত

‘পিশাচ বধ’ কেন এই সময়ে এতটা জনপ্রিয় হতে পেরেছে, তা নিয়ে অবশ্য একাধিক ধারণা এখন জাপানে বিরাজমান থাকতে দেখা যায়। অনেকেই বলছেন এর কাহিনির গঠন মানুষের এই সময়ে কাটাতে হওয়া জীবনের সঙ্গে অনেকটা মিলে যাচ্ছে। করোনার থাবা থেকে মুক্তিপ্রত্যাশী মানুষ বালক তাঞ্জিরো কামাদোর চালানো অভিযানের মধ্যে নিজেদের স্বপ্ন পূরণ হওয়া দেখছেন। এ কারণেই সিনেমা হলগুলোতে এতটা ভিড় করছেন তারা। অন্যরা অবশ্য একতরফাভাবে সেই যুক্তি মেনে নিতে নারাজ, যদিও এর পুরোপুরি বিরোধিতা তারা করছেন না।

এদের অনেকে বলছেন ছবির জনপ্রিয়তার উৎস কমিকস সিরিজের মধ্যেই নিহিত ছিল। ছবিটি তৈরি হওয়ার অনেক আগে থেকেই ‘ডেমন স্লেয়ার’ সিরিজ জাপানে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং এখন এই করোনার সময়ে বিনোদনের সুযোগ অনেকটা সংকুচিত হয়ে আসায় মানুষ সিনেমা হলের দিকে আবারও ঝুঁকে পড়তে শুরু করেছেন। তৃতীয় আরেকটি দল আনিমে বা কার্টুন ছবির সার্বিকভাবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠার যুক্তি তুলে ধরে বলছেন, ওসামু তেজুকা থেকে শুরু করে হায়াও মিয়াজাকি হয়ে যে পথ ধরে জাপানে কার্টুন ছবি এগিয়ে চলেছে, তারই একটি প্রত্যাশিত ফলাফল হচ্ছে ‘মুগেন ট্রেন’–এর বক্স অফিস রেকর্ড ভেঙে ফেলা।

‘মুগেন ট্রেন’–এর বক্স অফিস রেকর্ড ভেঙে ফেলা
ছবি: সংগৃহীত

তবে যে দলের অবস্থান যেমনই হোক না কেন, সবাই মোটামুটি যে একটি বিষয়ে একমত। আর তা হলো, এই ছবি মানুষকে আশার কথা শোনাচ্ছে। সেই আশা যে প্রতিবন্ধকতা যত বড়ই হোক না কেন, মানুষের পক্ষে তা অতিক্রম করে যাওয়া সম্ভব। আর এখানেই মনে হয় ‘মুগেন ট্রেন’–এর সবচেয়ে বড় সাফল্যের দেখা পাই আমরা। যে সাফল্য আমাদের বলছে হেরে যাওয়ার আগেই হার মেনে নিতে নেই। আর এই বার্তাই জাপানের মানুষদের এখন শোনাচ্ছে তাঞ্জিরো কামাদো নামের এক ভার্চ্যুয়াল বালক।