‘আজকে তোর সঙ্গে ঘুমাব।’
আব্বুর কথা শুনে এত চমকে উঠলাম যে আরেকটু হলেই ফোনটা হাত ফসকে পড়ে যেত নিচে। ভুলে কোথায় লাইক-টাইক পড়ে গেল কি না কে জানে! আব্বু বলে কী!
‘আমার সঙ্গে ঘুমাবে মানে?’
ধপ করে বিছানার ওপর বেঢপ একটা বালিশ ফেলে বসল আব্বু। হাত দিয়ে খুব জোরে জোরে দু-তিনবার চাপড়ে দিল বালিশটা। তারপর চশমাটা পাশে রেখে কাত হয়ে শুয়ে বলল, ‘লাইটটা নিভিয়ে দিস।’
‘আরে, তুমি সত্যি সত্যি আমার এখানে ঘুমাবে নাকি?’
ঝট করে উঠে বসল আব্বু। পরীক্ষায় খারাপ করলে ঠোঁট দুটো সরু করে যেভাবে আমার দিকে তাকায় আব্বু, ঠিক সেভাবে তাকিয়ে বলল,
‘বারবার প্রশ্ন করছিস কেন? আমি কি প্রশ্নোত্তর পর্ব চালু করেছি? যা বলছি তা-ই কর। নইলে বালিশে যেমন চাপড় দিলাম, একটু পর তোর গালে তেমন কিছুর অস্তিত্ব টের পাবি।’
‘আর করব না।’ আমতা আমতা করে বললাম আমি।
‘লাইট নিভা।’ আবার শুয়ে বলল আব্বু।
উঠে লাইট নিভিয়ে দিলাম আমি। আবার বিছানার কাছে এলাম। বালিশের পাশে ইয়ারফোনটা রেখেছিলাম, নিতে হবে।
‘তোর মা দিন দিন অসহ্য হয়ে উঠছে।’ ফোঁস ফোঁস করে বলল আব্বু। প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করল, কিন্তু কিছু জিজ্ঞেস করলেই আব্বু রেগে যাবে। চুপ করে রইলাম।
‘না বুঝে অযথা চেঁচামেচি করার অভ্যাস তার গেল না। কোনো দিন যাবেও না। আর্জেন্টিনার প্রত্যেকটা সাপোর্টার এ রকম। খেলার কিছু বোঝে না, খালি সেভেন আপ, সেভেন আপ! তোর মা আর্জেন্টিনা সাপোর্ট করে—এটা আগে জানলে বিয়েই করতাম না!’
ইয়ারফোনটা আটকে আছে আব্বুর বালিশের তলায়। বালিশটা না ওঠালে বের করা কঠিন। কিন্তু এখন উঠতে বললে হাউকাউ করে উঠবে আব্বু। আমি ইয়ারফোনের তার ধরে ধীরে ধীরে টানতে লাগলাম। আব্বুর একক বক্তৃতা চলছে তখনো।
‘আরে ভাই, একটা দল জিততে পারে না, সেটা নিয়ে কথা বলা যাবে না? বাক্স্বাধীনতা নাই আমার? এটা কেমন স্বৈরাচারী আচরণ?’
‘আসলেই তো! এটা কেমন কথা?’ মিনমিন করে বললাম আমি।
‘এই তো তুই বুঝেছিস।’ আব্বু প্রায় লাফ দিয়ে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে একটানে ইয়ারফোনটা বের করে ফেললাম বালিশের তলা থেকে।
‘যেমন দল, তার তেমন সাপোর্টার!’ আব্বুর কণ্ঠে ঝাঁজালো সুর, ‘তোর মায়ের সেই একই রেকর্ড! বলে, এ সংসারে এসে কী পেলাম? কিছুই পেলাম না। শুনে আমি অত্যন্ত ভদ্রভাবে, বিনয়ের সুরে বললাম, সাপোর্ট করো আর্জেন্টিনা, কিছু পাবে কী করে, বলো? ওরাও তো এ সংসারে…মানে খেলার মাঠে কিছু পায় না। ব্যস, তোর মা যা-তা বলা শুরু করল। আমিও এক কাপড়ে বেরিয়ে এলাম।’
‘এক কাপড়ে বেরিয়ে এলাম মানে?’
‘মানে বেডরুম থেকে সোজা তোর ঘরে চলে এলাম। ব্রাজিল–আর্জেন্টিনার সমর্থক এক ঘরে থাকতে পারে না। নেভার। তোর মায়ের সঙ্গে আমার সম্পর্ক শেষ।’
‘কী বলো?’
‘মানে ফাইনালে জয়লাভ করার আগপর্যন্ত। আর্জেন্টিনাকে কড়া জবাব দেওয়ার আগ আমাদের মুখ দেখাদেখি বন্ধ। কঠোর শাটডাউন।’
ব্রাজিলের ওপরে তো কোনো দল হয় না। কিন্তু ভাবো, ফাইনালের দিন আমাদের তো আম্মুর কাছেই যেতে হবে, টিভি তো বেডরুমেই।
‘আব্বু, বাংলাদেশের জনসংখ্যা আর তোমাদের ছেলেমানুষি প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। সামান্য খেলা নিয়ে তোমরা যা করছ! কাল খাবার টেবিলে সেভেন আপ দেখে তুমি রাগ করে ভাত রেখে উঠে গেলে। আজ আবার এই ঘরে ঘুমাতে এসেছ। এসব কী?’
‘লাইট জ্বালা।’
‘কেন?’
‘অন্ধকারে তোর গালে চড় মারলে জায়গামতো বসবে না। বাতি জ্বালা, ঠিকমতো দেখে মারি।’
আমি চুপ করে রইলাম। সহিংস আচরণ! লকডাউনে অনেকেই মারমুখী হয়ে উঠেছে। এর কারণ স্ট্রেস! আর কিছু না।
‘এটাকে তুই সামান্য খেলা বলছিস?’ ধমকে উঠল আব্বু, ‘সেই ১৯১৯ সালে রিও ডি জেনিরোতে শিরোপ উঁচিয়ে ধরেছিল ব্রাজিল। তারপর থেকে শুরু…এই ২০১৯ সালেও শিরোপা জিতল কে? ব্রাজিল…।’
কানে ইয়ারফোন গুঁজে দিলাম আমি। কোপা আমেরিকার ইতিহাস শোনার কোনো আগ্রহ আমার নেই। দ্রুত এখান থেকে বেরোতে হবে আমাকে। হঠাৎ মাথায় একটা বুদ্ধি এল। কান থেকে ইয়ারফোন নামিয়ে বললাম, ‘ব্রাজিলের ওপরে তো কোনো দল হয় না। কিন্তু ভাবো, ফাইনালের দিন আমাদের তো আম্মুর কাছেই যেতে হবে, টিভি তো বেডরুমেই।’
‘আর্জেন্টিনার সমর্থকের পাশে বসে আমরা খেলা দেখব, এটা হতে পারে না।’
‘তো কী করবা? তোমার তো টিভি নাই।’
‘টিভি কিনব। হেহ্, কী ভেবেছিস তুই? কালই টিভি অর্ডার দিয়ে দেব। ডিসকাউন্ট চলছে এখন। আচ্ছা, কাল কেন? এখনই তো অর্ডার দিতে পারি। লাইট জ্বালা।’
আমি বাতি জ্বালিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলাম। খুব ভালো লাগছে।
ডাইনিংয়ে গিয়ে কল দিলাম রিমাকে। অনেকক্ষণ ধরে কল দিচ্ছিল আমার ফোনে। ধরেই গর্জে উঠল রিমা, ‘অ্যাই, তুমি কান্তার ছবিতে লাভ দিলা কেন?’
‘কোন ছবি? নাহ্, কী বলো? কখন?’
’১০ মিনিট আগে। ও ছবি দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তুমি লাভ দিছ।’
সেরেছে! বোধ হয় আব্বুর কথায় চমকে উঠে ভুলে লাভ রিঅ্যাক্টে চাপ পড়ে গেছে! কী বিপদ!
‘ইয়ে আমি দিই নাই, আব্বু দিয়েছে।’
‘কী?’
‘মানে আব্বু হঠাৎ এসে ফোনটা কেড়ে নিয়েছিল তো, মনে হয় চাপ পড়ে গেছে।’
‘কত মিথ্যা কথা যে তুমি বলো! ইতালির জার্সি কিনেছ?’
‘অবশ্যই। তুমি কিনতে বলেছ, না কিনে পারি? আর আমি তো ছোটবেলা থেকে ইতালির সাপোর্টার।’
‘জার্সি পরে ছবি পাঠাও এখনই। ফাইনালের দিন আমরা দুজন ইতালির জার্সি পরা ছবি ফেসবুকে স্টোরি দেব। ওকে?’
‘অবশ্যই। ইতালিই জিতবে এবার ইউরোতে।’
আমি বহু কষ্টে খুশি চেপে রাখলাম। যাক, এবার আমার ঘরে একটা টিভি আসবে। ইটস কামিং হোম! ইতালির জার্সিটা খুলে শুয়ে পড়লাম।
এমন সময় আম্মু এসে জিজ্ঞেস করল, ‘কিরে, তুই জার্সি পরে কী করিস এখানে?’
‘ওই রিমার সঙ্গে ইউরো নিয়ে কথা বলছিলাম।’
‘এত রাতে?’
‘ইউরোর খেলা তো রাতেই হয়। তা ছাড়া আব্বু তখন থেকে শুধু ব্রাজিল এই ব্রাজিল সেই বলে যাচ্ছে। কেমন লাগে, বলো?’
‘তোর আব্বু দিন দিন অসহ্য হয়ে উঠছে। না বুঝে অযথা চেঁচামেচি করার অভ্যাস তার গেল না। কোনো দিন যাবেও না। ব্রাজিলের প্রত্যেকটা সাপোর্টার এ রকম। খেলার কিছু বোঝে না, খালি ট্রফি ট্রফি! ব্রাজিল সাপোর্ট করে—এটা আগে জানলে বিয়েই করতাম না!’
রিমা আবার কল দিচ্ছে। আমি কেটে দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। আম্মু বলল, ‘আজকে সে কত বাজেভাবে অপমান করেছে আমাকে, জানিস? বলে, তোমার ছেলেটার কথা ভাবো। বেচারা দুনিয়ার কত কিছু দেখল, একটা মহামারি পর্যন্ত দেখে ফেলল, অথচ আর্জেন্টিনাকে কোনো দিন কোনো ট্রফি জিততে দেখল না। এই কথা বলার পর তার সঙ্গে থাকা যায়? তুই বল!’
‘এই কথা বললে তো থাকা কঠিন।’
‘আমিও একদম বের করে দিয়েছি। ফাইনালের আগে মুখ দেখাদেখি বন্ধ! তুই যা, ঘুমিয়ে পড়।’
রিমার সঙ্গে কথা শেষ করে ঘুমাতে গেলাম আমি। বিছানায় উঠতেই আব্বু ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বলল, ‘টিভি অর্ডার দিয়েছি। ফাইনালের আগেই দিয়ে যাবে বলল।’
আমি বহু কষ্টে খুশি চেপে রাখলাম। যাক, এবার আমার ঘরে একটা টিভি আসবে। ইটস কামিং হোম! ইতালির জার্সিটা খুলে শুয়ে পড়লাম। বালিশের নিচে খুব যত্ন করে রেখে দিয়েছি ইংল্যান্ডের জার্সি। কেউ জানুক আর না জানুক, আমি তো জানি আমার প্রিয় দল কোনটা!