ইউক্রেনের পাগলা ইভান ও আমাদের খোলা ম্যানহোল

আঁকা: রাজীব

অর্থ আর নীতি ব্যাপার দুটি পরস্পর বিরোধী, তা তো সবাই জানে। কারণ, আমার আশপাশে যারা আছে, মোটামুটি সবাই নীতি বিসর্জন দিয়ে অর্থের পেছনে ছুটছে। আর আমি তো অর্থের পেছনে ছোটার পাশাপাশি বন্ধুদের পেছনেও ছুটছি। কারণ, তাদের কাছে আমি টাকা পাই, একইভাবে আমার কাছেও টাকা পায় অনেকে। পুরোপুরি একটা চক্র।

এই চক্র নিয়েই বছর কয়েক আগে একটা গল্প বলেছিল আমার ইউক্রেনীয় বন্ধু অ্যালেক্স (বাংলাদেশি বন্ধুদের সঙ্গে তো টাকাপয়সা ছাড়া কথা হয় না, তাই সে সময় বিদেশি বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলতাম)। অ্যালেক্স হচ্ছে দরজার ওপাশে থাকা মানুষের মতো, নক না করলে নিজে থেকে কিছু বলে না। আমিই সেদিন বলেছিলাম, ‘অ্যালেক্স, তোমার দেশের গল্পটল্প বলো না!’

অ্যালেক্স গল্প বলা শুরু করল। ইউক্রেনের এক ছোট্ট শহরের গল্প (শহর ছোট্ট হলেও নামটা বিশাল, এত বিশাল যে ভুলেই গেছি)। সেই শহরের এক ট্রাকচালক ইভান। লোকে যাকে ডাকে পাগলা ইভান নামে। পাগলের মতো ট্রাক চালাত সে, ট্রাকের সামনে কিছু পড়লে স্রেফ উড়িয়ে দিত। ট্রাকের ইঞ্জিনের মতোই গরম তার মাথা। সেদিনও মাথাটা খুব গরম ছিল ইভানের। সকালেই সে আবিষ্কার করেছে, ফেসবুকে যে মেয়েটার পেছনে সে অনেক দিন থেকেই ঘুরঘুর করছে, ওটা আসলে তারই এক পরিচিত ট্রাকচালকের ফেক আইডি!

রাগের চোটে প্রচণ্ড গতিতে ট্রাক চালাচ্ছিল ইভান। হঠাৎ রাস্তার মাঝখানের ম্যানহোলের সামনে একটা লোক আচমকা উঠে দাঁড়াল। বিদ্যুতের বেগে ব্রেক কষল ইভান, কিন্তু এড়াতে পাড়ল না। ট্রাকের ধাক্কায় তিন হাত দূরে ছিটকে পড়ল লোকটা। মুহূর্তে লোক জমে গেল। ধরাধরি করে হাসপাতালে নিয়ে গেল লোকটাকে, ইভান তখন হাওয়া!

লোকটা এই শহরেরই একজন পয়োনিষ্কাশনকর্মী। বিকেলে বাড়ি যাওয়ার কথা ছিল তার, কিন্তু এত বড় ট্রাকের ধাক্কায় সে সরাসরি কোমায় চলে গেল। সহকর্মীর এই অবস্থায় বেপরোয়া চালকের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠল পয়োনিষ্কাশনকর্মী সমিতি। আন্দোলন থেকে ঘোষণা এল, চালককে গ্রেপ্তার করার আগ পর্যন্ত তারা কেউ কাজ করবে না। এবং সত্যি সত্যি কাজ বন্ধ করে দিল তারা।

তবে পয়োনিষ্কাশনকর্মীদের এই আন্দোলনকে পাত্তাই দিলেন না শহরের মেয়র। চিকেনফ্রাই খেতে খেতে তিনি ভাবলেন, ‘এরা আর কী এমন করবে! ঠিক হয়ে যাবে কদিন পর।’ কিন্তু হলো না। দিনের পর দিন চলে গেল, আন্দোলন থামল না। এদিকে পুরো শহর ময়লা-আবর্জনায় ভরে গেছে। টেকা যাচ্ছে না দুর্গন্ধে। এক সকালে মর্নিংওয়াক করতে গিয়ে দুর্গন্ধে জ্ঞান হারালেন মেয়রের স্ত্রী। তখন সবার টনক নড়ল।

বিচারকের নির্দেশে পাগলা ইভানকে খুঁজে বের করে ঢোকানো হলো জেলে।
এবার খেপে গেল পরিবহন মালিক-শ্রমিক সমিতি। সঙ্গে সঙ্গে সব ধরনের যানবাহন চালানো বন্ধ করে দিল তারা। তাদের এক দাবি, ইভানকে ছেড়ে না দিলে গাড়ি চলবে না। পরিবহন ধর্মঘট।

মেয়র পড়লেন উভয় সংকটে। এদিকে যানবাহন না চলায় শহরে সবজি, মাংসসহ অন্যান্য পণ্য সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেল। সুযোগ বুঝে সবজি-মাংস বিক্রেতারা সবকিছুর দামও বাড়িয়ে দিল। মাছ, মাংস, সবজি—সবকিছুর দাম বেড়ে গেল দ্বিগুণ, তিন গুণ। বাজারের ব্যাগ নিয়ে ঘুরছে সবাই, কিন্তু কিছুই কিনতে পারছে না। কী একটা অবস্থা।

আঁকা: রাজীব

টিভিতে কর্তৃপক্ষের নীরব ভূমিকা নিয়ে খবর আর টক শো হচ্ছে। বক্তারা তীব্র সমালোচনা করছেন মেয়রের। দেখে-শুনে মেয়রের মেজাজও গেল খারাপ হয়ে, একেবারে পাগলা ইভানের মতো। মেয়র ভাবলেন, এভাবে চলতে দেওয়া যায় না। রাস্তায় বসা এসব বাজারের চাঁদা নিয়েই তো আমি খাই, বাজার না থাকলে তো আমার খাওয়াই বন্ধ হয়ে যাবে। অতএব, আগে খাদ্য সমস্যার সমাধান করে নিই, তারপর দেখা যাবে কোথাকার কোল্ড ড্রিংস কোথায় গিয়ে গড়ায়! তিনি ম্যাজিস্ট্রেট পাঠালেন বিভিন্ন বাজারে, যে বেশি দাম রাখবে, তাকেই যেন জরিমানা করা হয়।

ম্যাজিস্ট্রেটও সঙ্গে সঙ্গে হাজির হলেন সবচেয়ে কাছের বাজারে। গিয়ে স্ট্রেট জরিমানা করলেন কয়েকজন মাংস-সবজি ব্যবসায়ীকে। ব্যস, তারাও খেপে গেল। স্বাধীন দেশে তারা কি ইচ্ছামতো দাম রাখতে পারবে না? এটা আবার কোন বিচার? ফলে দোকানের ঝাঁপ বন্ধ করে রাস্তায় নেমে তারা ঘোষণা দিল, অনির্দিষ্টকালের জন্য মাছ-মাংস-সবজি সব বিক্রি বন্ধ।

ফল হলো আরও ভয়াবহ। একে একে বন্ধ হতে লাগল শহরের রেস্তোরাঁগুলো। খাবার নেই, ওরা বেচবেটা কী? শুধু এসির বাতাস খাওয়ার জন্য তো আর কেউ টাকা দেবে না! তারচেয়ে দোকান বন্ধ রাখাই ভালো, অন্তত বিদ্যুতের বিলটা কমবে। অথচ এই রেস্তোরাঁগুলোই ছিল শহরের প্রাণ, বিনোদনের একমাত্র জায়গা। মানুষ এখানে এসে সময় কাটাত, সুখ-দুঃখের কথা বলত।

রেস্তোরাঁ বন্ধ, যানবাহন নেই, মানুষ ঘর থেকে বের হওয়া বন্ধ করে দিল। তখনই ঘটল বড় দুর্ঘটনা। এত দিন কেউ বাসায় দীর্ঘক্ষণ থাকেনি। ফলে কার বউ প্রতিবেশীর সঙ্গে প্রেম করছে কিংবা কার স্বামী প্রেম করছে সহকর্মীর সঙ্গে—এসব নিয়ে কথা বলারও সময় হয়নি কারও। এত সব অরাজকতার মধ্যে এসব বিষয়ও মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। রীতিমতো গৃহযুদ্ধ হওয়ার মতো অবস্থা!

আঁকা: রাজীব

এই পর্যায়ে আমি আর চুপ থাকতে পারলাম না। বলেই ফেললাম, ‘কী আশ্চর্য, এত কিছু হচ্ছে, সাধারণ মানুষ কিছু বলছে না কেন?’
‘আরে, সাধারণ মানুষ বলবে কীভাবে? পয়োনিষ্কাশনকর্মী থেকে শুরু করে দোকানমালিক সবার মধ্যে ঐক্য আছে। আছে সংগঠন। শুধু সাধারণ মানুষেরই কোনো ঐক্য নেই, সংগঠনও নেই। তারা রোজ বাসে চেপে অফিসে যায়, বসের ঝাড়ি খায়। ঝাড়ি দিতে হলে বড়জোর দেয় বাসের হেলপারকে। হেলপার পাল্টা ঝাড়ি দিলে মাথা নিচু করে বাড়ি ফিরে স্ত্রী বা স্বামীর ঝাড়ি খায়। তারা কিছু বলবে? কোনো দিনও না।’

তো যাহোক, পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাচ্ছিল, এমন সময় সেই পয়োনিষ্কাশনকর্মী হঠাৎ কোমা থেকে জেগে উঠে বলল, ‘আমি এখানে কেন? আমার কী হয়েছে?’
পরের ঘটনাগুলো খুব দ্রুত ঘটল। লোকটা বেঁচে গেছে—এই খবর শুনে ধর্মঘট প্রত্যাহার করল সবাই। লোকটাও ধীরে ধীরে সুস্থ হতে শুরু করল। অতঃপর সবাই সুখে-শান্তিতে বসবাস করতে লাগল।

‘অদ্ভুত গল্প!’ বললাম আমি। এমন গল্প জীবনেও শুনিনি। ‘সত্যি, তোমরা তো অদ্ভুত একটা দেশে থাকো। আমাদের দেশে কখনোই এমন কিছু ঘটে না। আচ্ছা, একটা প্রশ্ন। লোকটার জন্য শহরে কত কিছু ঘটে গেল। সে রাস্তায় ম্যানহোলের ওখানটায় কী করছিল?’
‘কেন, ম্যানহোলের ঢাকনাটা ঠিকঠাক আছে কি না, তা চেক করছিল।’
‘এ জন্যই এই অবস্থা। আমাদের দেশে ম্যানহোলের ঢাকনা নিয়ে কেউ চিন্তাই করে না। খোলা পড়ে থাকে দিনের পর দিন। এখন মনে হচ্ছে, ওটা খোলা থাকাই ভালো। নইলে আমাদের এখানেও এমন ঝামেলা হতো।’
আমার কথায় বিস্মিত হওয়ার ইমো দিল অ্যালেক্স। জবাবে একটা হাসিমুখের ইমো দিলাম আমি। এর মানে ভালোও হতে পারে, খারাপও হতে পারে। অ্যালেক্স বোধ হয় প্রথমটাই ধরে নিয়েছে।