টিকা নোয়ায়, বাহে, ভ্যাকসিন নিছি...

বিধিনিষেধের আগে গ্রামে এসেছি। এসেই আবিষ্কার করলাম, করোনার টিকা নিয়ে এদিকে রূপকথার মতো গুজব চালু হয়ে গেছে! একেক রূপকথার (কিংবা গুজবের) আবার একেক সংস্করণ। প্রতি এক কিলোমিটার পরপর পথের বাঁকের মতো গল্পের মূল কাহিনি বদলে যাচ্ছে। সব শুনেটুনে মনে হচ্ছে, করোনার টিকা এ দেশে এসে ‘আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে’ পড়ে গেছে! এবং এই টিকাকে শরীরে ধারণ করা নিয়ে সে কী নাটক! পুরো গ্রাম যেন বিরাট নাট্যশালা! এই নাটক কিংবা রূপকথাগুলো থেকে বাছাই করা কয়েকটি বলছি, শুনুন...

আঁকা: তুলি

সকালে ঘুম ভাঙল চিৎকার-চেঁচামেচির শব্দে। বের হয়ে দেখি, বিরাট জটলা। গ্রামে কেউ মারা গেলে সাধারণত এ রকম দেখা যায়। ঘটনা হলো, কাকা আজ টিকা নিতে যাচ্ছেন। তাঁকে ঘিরে রেখেছে জনা পঞ্চাশেক প্রতিবেশী। কাকার কাকি, মানে আমার দাদি কাঁদো কাঁদো স্বরে বলছেন, ‘বাবা, সবার সাথে কথা কয়া যা রে! সবার আশীর্বাদ নিয়া যা। আর ফিরি আসপার পাইস নাকি, কায় জানে! যাওয়ার সময় বাপ–মায়ের চিতাটা দেখি যাইস একবার!’

কথা শেষ না করেই শাড়ির আঁচল মুখে দিয়ে কান্না চেপে রাখেন দাদি। প্রতিবেশী দর্শকদের মধ্যে কিছু নারীও সম্ভবত আবেগাক্রান্ত হয়ে মুখে আঁচল চাপা দিলেন! তারস্বরে কেঁদে উঠল এক শিশু। মাথার ওপর দিয়ে কা কা করে উড়ে গেল একটা কাক।

এখানেই শেষ নয়। কাকা তাঁর মেয়েকে ফোন করে ডুকরে কেঁদে ওঠার মতো করে বললেন, ‘মা রে, টিকা নিবার গেনু।’

খানিকক্ষণের নীরবতা। গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোল একসময়, ‘নাতি দুইটাক দেখি রাখিস!’ বলেই ফোনটা কেটে দিলেন কাকা।

আমি এই নাটক টেনে আরও খানিকটা লম্বা করার বদ মতলব নিয়ে বললাম, ‘কাকা, কথা শেষ? আরেকবার ফোন দিয়ে বলেন যে কোনো ভুল হলে যেন মাফটাফ করে দেয়।’

কাকা আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ফোনে মেয়ের নম্বর ডায়াল করতে যাচ্ছিলেন। আমি বিস্ময়মাখা মুখে বললাম, ‘কী সব পাগলামি শুরু করছেন! তাড়াতাড়ি যান তো। শুধু একটা ইনজেকশন দেবে, তা নিয়ে কত কাণ্ড।’

কাকা নিরীহ চাহনি দিয়ে টিকা নিতে গেলেন।

২.

আঁকা: তুলি

বাজার থেকে বাড়িতে আসার পথে এক চাচাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘চাচা, টিকা নিছেন?’

চাচা আলতো করে পানের পিক ফেলে বললেন, ‘টিকা নোয়ায়, বাহে, ভ্যাকসিন নিছি।’

পাশ থেকে এক ছোট ভাই শয়তানি করে বলল, ‘চাচা, তোমরা তো কামের কাম করি ফালাইছেন! টিকা নিলেও করোনা হওয়ার চান্স থাকে। ভ্যাকসিন নিলে আর কোনো চান্স নাই। সারা জীবন ফকফকা। করোনার বাপেরও শক্তি নাই তোমাক আর ধরে। তোমরা এলা করোনার চাইতেও শক্তিশালী।’

এতটুকু শুনেই চাচার মুখ খুশিতে জ্বলজ্বল করে উঠল। থুতনির মাস্কটা খুলে বললেন, ‘তাইলে বাহে, এই মাক্স পরি আর কী হইবে? এমনিতেও পরির মন না চায়, ইয়াক ফ্যালে দিম, নাকি?’

আমরা একেবারে আর্তনাদের মতো করে উঠলাম, ‘করেন কী করেন কী! এতক্ষণ তো বাহে মজাক করছি। মাস্ক পরেন, মাস্ক পরেন। টিকা বা ভ্যাকসিন নিলেও মাস্ক ছাড়া যাইবে না।’

চাচা বিরস মুখে জায়গার মাস্ক জায়গায় রেখে দিলেন।

৩.

আঁকা: তুলি

ওই চাচার সঙ্গে পরদিন আবার দেখা।

চাচা: বাবা, তুই ভার্সিটি পাস দিছিস। তাই তোক একটা কথা কবার চাং।

আমি: ভ্যাকসিন দেওয়ার পর বিয়ের শখ জাগিল নাকি, বাহে?

চাচা: ধুর, বাহে! তোর চাচি শুনলে গুড়ি মারি মোর কোমর ভাঙি দিবে।

আমি: তাইলে?

চাচা: মোক বুঝি নকল ভ্যাকসিন দিছে!

আমি: কাম সারি ফালাইছে!

চাচা: হয়, বাবা। সত্যিই!

আমি: কেমন করি বুঝলেন?

চাচা: মোর তো কিছুই হয় নাই।

আমি: কিছু হয় নাই মানে?

চাচা: গ্রামের কাও কাও কইলে, ভ্যাকসিন না নেন, বাহে! ভ্যাকসিন নিলে মরি যাইবেন! তবু মোর ব্যাটাটার জোরাজুরিতে নিনু। সবাই কয়, ভ্যাকসিন দিবে গরুক ইনজেকশন দেওয়া সিরিঞ্জ দিয়া। টিভিত নাকি দেখাইছে। যায়া দেখি, ছোট্ট একনা ইনজেকশন। তারপর সবাই কইলে, ভ্যাকসিন নিলে সারাদিন পাতলা পায়খানা হইবে। বমি হইবে। মাথা ঘুরি পড়ি যাইম। যে হাতত ইনজেকশন দিবে, সেই হাত নাকি সাতদিন নড়বারে পাবান নং। কিছুই তো হইলে না। মনে হয় দুই নাম্বার ভ্যাকসিন দিছে!

আমি: (নির্বাক)

৪.

গ্রামের চায়ের দোকানের আলাপ তো জগদ্বিখ্যাত। সেদিন সন্ধ্যায় দেখি, এক চাচা টিকার খারাপ দিক নিয়ে গালিগালাজ করতে করতে রীতিমতো মুখের ফেনা তুলে ফেলছেন। বাংলার সমৃদ্ধ শব্দভান্ডার থেকে এমন সব শব্দ চয়ন করছেন যে এখানে লিখতে সাহসে কুলাচ্ছে না! পরদিন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে টিকাগ্রহীতাদের সারিতে মাস্ক পরা এক লোককে দেখে মনে হলো চিনি উহারে।

: আরে চাচা, আপনি? কালকে যে টিকা নিয়া লেকচার দিলেন?

: আর কইস না, ভাতিজা! ভ্যাকসিন নেওয়ার শুনলে মানুষ উল্টাপাল্টা কতা কয়। কয়, তুই বুঝি বড় কোনো পাপ কচ্ছিস। তারপর কয়, কী রে, মরণোক এত ভয় পাইস? তুই এত ভিতু? কও তো ভাতিজা, এগুলা সহ্য করা যায়? তাই ওই বুদ্ধি...।

(আমি নিশ্চিত, ড. দীনেশচন্দ্র সেন আজ বেঁচে থাকলে গ্রামেগঞ্জে ঘুরে ঘুরে এই কাহিনিগুলো সংগ্রহ করে একটা ‘করোনা গীতিকা’ প্রকাশ করতেন। বইটা ক্ল্যাসিকের মর্যাদাও পেয়ে যেত হয়তো!)