দুই ভাবির এক মাথাব্যথা

আঁকা: জুনায়েদ আজিম চৌধুরী

বিকেলবেলা। অখণ্ড অবসরে তিনতলার ‘বি’ ইউনিটের ভাবি এলেন দোতলার ‘সি’ ইউনিটের ভাবির কাছে। ইতস্তত হাতে দোরঘণ্টি বাজালেন। একবার, দুবার। দোতলার ভাবি চোখ রাখলেন দরজার পিপহোলে। বিরক্ত হলেন খানিকটা। সেটা আড়াল করেই দরজা খুলে দিলেন।
দরজা খুলতেই তিনতলার ভাবির কণ্ঠে অনুযোগ, ‘কী ব্যাপার ভাবি, আমাদের কথা দেখি ভুলেই গেলেন! সেই কবে একবার বাসায় এসেছিলেন, তারপর তো আর ও-মুখো হননি!’
দোতলার ভাবিও অভিনয় কম জানেন না, ‘কী যে বলেন, ভাবী! আপনাদের কথা কি ভুলতে পারি? আসলে প্রতিদিনই মনে হয় যাই, কিন্তু এদিককার ঝামেলাই শেষ হয় না। আসেন আসেন, ভেতরে আসেন।’
সোফায় না বসে খাটে বসলেন তিনতলার ভাবি। চারপাশে একবার দৃষ্টি বুলিয়ে নিলেন। হঠাৎ কিছু একটা মনে পড়ার ভঙ্গিতে বললেন, ‘ভাবি, আপনার ছেলেটাকে অনেক দিন ধরে দেখছি না; কোথাও বেড়াতে-টেড়াতে গেছে নাকি?’
কিছুটা অপ্রস্তুত মনে হলো দোতলার ভাবিকে। খানিকক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর কাঁদো কাঁদো স্বরে বললেন, ‘কী আর বলব, ভাবি! সবই কপাল! ছেলেটার জন্যই তো আজ এ অবস্থা! আত্মীয়স্বজন কারও কাছে মুখ দেখাতে পারছি না।’
: কী হয়েছে ওর, ভাবি?
: আপনাকে তো ভাবি কাছের মানুষ মনে করি। আপনার কাছে বলতে বাধা নেই। ছেলেটা অ্যাডিক্টেড হয়ে গেছে!
চমকে উঠলেন তিনতলার ভাবি, ‘কী বলেন, ভাবি! এত ভালো ছেলেটা...’
এবার আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না দোতলার ভাবি। ছলছল চোখে শেলফে সাজানো ছেলের পাওয়া মেডেল আর ট্রফিগুলোর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘বললাম না ভাবি, সবই কপাল। এত লক্ষ্মী ছেলে আমার। ফাইভে আর এইটে ট্যালেন্টপুল। এসএসসিতে গোল্ডেন পাওয়ার পর ওর আব্বুকে জড়িয়ে ধরে এমন কান্না করেছিল! নামকরা কলেজে ভর্তি হলো। প্রথম কয়েক মাস ঠিকই ছিল। তারপর বন্ধুবান্ধবের পাল্লায় পড়ে...’

কিছুটা দম নিলেন তিনতলার ভাবি। তারপর খুব যেন গোপন কথা, এমনভাবে বলতে লাগলেন, ‘আমার ছেলেটারও একই অবস্থা, ভাবি! কারও কাছেই কিছু বলতে পারছি না।

দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনতলার ভাবি, ‘কবে থেকে এমন হলো?’
: দুই মাস থেকে দেখছি প্রায়ই রাত জাগে। একা একা হাসে, কথা বলে। জড়ানো কণ্ঠে এমন অদ্ভুতভাবে কথা বলে! ঘোরের মধ্যে ওর আব্বু আর আমাকে ‘হায় বাডি’ বলে ডাকে! কারণে অকারণে যখন-তখন খালি মুড়ি খাওয়ার কথা বলে।
: ডাক্তার-টাক্তার দেখাননি?
: অনেক চেষ্টা করেছি বুঝিয়ে-সুঝিয়ে একজন সাইকিয়াট্রিস্ট দেখানোর জন্য। রাজি হয়নি। বলে, ডাক্তার দেখাতে হবে না। ও নিজে থেকেই আস্তে আস্তে সব ছেড়ে দেবে। কয়েকবার আমার মাথা ছুঁয়েও বলল। কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না, ভাবি!
: এখন কোথায় আছে ও?
: ওর আব্বুর কথা তো জানেনই। ছেলের চিন্তায় চিন্তায় নিজেই অসুখ বাঁধিয়ে বসল। পরিচিত অনেক জনের সাথে কথা বলেছে। শেষে অফিসের এক কলিগ একটা পুনর্বাসন কেন্দ্রের ঠিকানা দিলেন। বললেন, খুবই নাকি কেয়ার করে ওরা। এখন সেখানেই আছে। এখন পুরোপুরি সুস্থ হওয়ার পথে। দোয়া করবেন, ভাবি! কদিন পরে নিয়ে আসব।
এবার বেশ খানিকটা আশান্বিত মনে হলো তিনতলার ভাবিকে, ‘অবশ্যই ভাবি! দোয়া তো করবই। আপনার কাছে এসে বিরাট উপকার হলো।’ কিছুটা দম নিলেন তিনতলার ভাবি। তারপর খুব যেন গোপন কথা, এমনভাবে বলতে লাগলেন, ‘আমার ছেলেটারও একই অবস্থা, ভাবি! কারও কাছেই কিছু বলতে পারছি না। কী যে কষ্টের মধ্যে আছি! ভাবি, প্লিজ, পুনর্বাসন কেন্দ্রটার ঠিকানাটা একটু আমাকে দেন!’
পরদিন তিনতলার ভাবিকে দেখা গেল ছেলেকে নিয়ে পুনর্বাসন কেন্দ্রে যাচ্ছেন। কম কাঠখড় পোড়াতে হয়নি ছেলেকে রাজি করাতে। দুই ঘণ্টা পর পুনর্বাসন কেন্দ্রে যখন পৌঁছালেন, সাইনবোর্ডটা দেখে মনে বয়ে গেল একরাশ প্রশান্তির বাতাস। নামফলকে জ্বল জ্বল করছিল লেখাটা—‘নবজীবন ফেসবুকাসক্ত পুনর্বাসন কেন্দ্র’!