ফেরিওয়ালা কেন ঘুণে ধরা নষ্ট সমাজ কিনতে চাইলেন না?

কোলাজ: একটু থামুন

পাড়ার নীরবতা ভেঙে হঠাৎ হ্যান্ডমাইকের তীব্র আওয়াজ। হোম অফিসে এ যেন একটার সঙ্গে আরেকটা ফ্রি অফার। আগে চিৎকার করে কাজ চালালেও ইদানীং ফেরিওয়ালাদের মধ্যে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে হ্যান্ডমাইক! স্বাভাবিক কণ্ঠে কথা বললেই যেখানে কানের পর্দা ফেটে যাওয়ার উপক্রম, সেখানে এই যন্ত্রের যন্ত্রণা কাঁহাতক আর ভালো লাগে!

‘পুরাতন নষ্ট ল্যাপটপ, নষ্ট আইপিএসের ব্যাটারি, নষ্ট মনিটর বিক্রি করতে পারেন!’ ফেরিওয়ালার এই আহ্বান শুনে মনে মনে তাঁকে ডেকে বললাম, ‘ভাই, নষ্ট সমাজ নেবেন?’ মনে মনে তাঁর উত্তর ভেবে নিলাম এভাবে, ‘না ভাই, ওসব কিনে বিক্রি করা যায় না। তার চাইতে কোনো পুরাতন বা নষ্ট জিনিস থাকলে দেন। যেটা বেইচা দুইটা ট্যাকা লাভ করতে পারুম!’

ঘুণে ধরা নষ্ট সমাজ, নষ্ট বিবেক, নষ্ট মন্যুষত্ব—এসবের চাইতে ভাঙারির যখন মূল্য বেশি, তখন এই সমাজ নিয়ে আমরা কী করব? আমরা কি এই সমাজ চেয়েছিলাম? (রীতিমতো বাণী দিয়ে ফেললাম! হা হা হা!)

ফেরিওয়ালার কথা বলতে বলতে সিরিয়াস কথায় চলে গিয়েছিলাম। আবার ফেরিওয়ালার কাছে ফিরে যাই। মানে তাঁদের কথায় আরকি। সাতসকাল থেকেই শুরু হয় নানান ফেরিওয়ালার আনাগোনা। ফেরিওয়ালার এসব ঘ্যানঘ্যানানিতে চারতলায়ও যখন টেকা দায়, তখন ভাবলাম, একটু মজা করা যাক। ফেরিওয়ালা যেটা বলবেন তার একটা উত্তর দিয়ে দেব অন্ত্যমিলসহ। যেমন ভাবা তেমন কাজ। প্রথমে এলেন ছাই বিক্রেতা। চিৎকার করে বললেন, ‘ছাই লাগবে ছাই...’।

আমি মনে মনে উত্তর দিলাম এভাবে, ‘ছাইয়ের দরকার নাই!’

মনে মনে একটা হাসি দিয়ে আবার কাজে মনোযোগ দিলাম। একটু পরই আরেকজন এলেন, ‘শাক লাগব শাক...’।

মনে মনে বললাম, ‘লাগব না, থাক!’

বাহ্, নিজের প্রতিভায় নিজেকেই পুরস্কার দিতে মন চাইল। যেভাবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কিংবা সংগঠন সাহিত্য পুরস্কার দেয়, সে রকম আরকি!

ছবি: আনিস মাহমুদ

এরপর এলেন ডাব বিক্রেতা, ‘ডাব আছে ডাব...’।

আমি বিড়বিড় করে বললাম, ‘চিল্লাইস না, বাপ!’

দিলটা কচি ডাবের পানি খাওয়ার শান্তিতে তৃপ্ত হয়ে উঠল। ঘণ্টাখানেক কোনো সাড়াশব্দ নেই। আমিও খানিকটা চিন্তিত হয়ে পড়লাম। কিসের বিক্রেতা আসবে আর তার সঙ্গে কী অন্ত্যমিল দেব! খুব একটা অপেক্ষা করতে হলো না। আওয়াজ এল, ‘এই আদা, রসুন, পেঁয়াজ...’।

আমার মুখে হাসির ঝিলিক। মনে মনে বললাম, ‘তোমাকে ডাকছে কে আজ?’

বাহ্, চমৎকার মিলে গেল! কোরবানির জন্য দা–বঁটি ধারের একটা ব্যাপক আয়োজন চলে। তবে ঈদুল আজহা চলে গেছে। তারপরও দা–বঁটি তো আর বসে নেই। তাই বসে নেই দা–বঁটি ধার দেনেওয়ালা। তিনি হাঁক দিলেন, ‘দা–বঁটি ধাররররর...’।

আমি বারান্দা থেকে ডেকে বললাম, ‘ভাই টাকা ধার দেন?’

তিনি বললেন, ‘না, স্যার। আমরা তো উল্টা টাকা ধার লই! ধারদেনা কইরাই তো চলতাছি!’

আপনারা কি বিরক্ত হলেন? মানে এই দা–বঁটি ধার দেওয়া লোকটার কথায় অন্ত্যমিলসহ উত্তর নেই কেন, সেটা ভেবে। আরে ভাই, সবকিছুতে অন্ত্যমিল থাকতে হবে কেন? পড়তে পড়তে আপনাদের অভ্যাস হয়ে গেছে না? হা হা! মজা করলাম। শ্যামল চন্দ্র বলেছেন, ‘সি ইউ, নট ফর মাইন্ড’!

দুপুরের দিকে এলেন মাছ বিক্রেতা। এই যে অন্ত্যমিল মেলাতে গিয়ে মাঝেমধ্যে গোঁজামিল দিতে হয়, সেটা টের পেলাম তখনই! মাছওয়ালার গলা শুনলাম, ‘ইলিশ আছে বড় ইলিশ...’।

আমি বললাম, ‘তোর ইলিশ তুই গিলিস।’

নাহ্, এটাতে কেমন একটা অপমান লুকিয়ে আছে! হলো না। ওই যে একটু আগে বললাম—গোঁজামিল। এবার সেটার আশ্রয় নিলাম, ‘ইলিশ আছে বড় ইলিশ, চুপ থাকেন ভাই, লাগে পিলিশ!’

খেয়াল করেছেন নিশ্চয়ই, এখানে ইলিশের সঙ্গে মিল দেওয়ার জন্য ‘পিলিজ’কে ‘পিলিশ’ বলে ফেললাম। এর আগে আরেক জায়গায় গোঁজামিল দিয়েছিলাম, সেটাও নিশ্চয়ই খেয়াল করেছেন। ‘ডাব’–এর অন্ত্যমিলে ‘বাপ’ বলেছিলাম। তো আপনি পাস মার্ক দিলে উতরে যাব। কাব্যে খানিকটা স্বাধীনতা না থাকলে কীভাবে চলবে, বলুন? আজ স্বাধীনতা, বিশেষ করে বাক্‌স্বাধীনতার বড্ড...! (এবার আর পুরো বাণীটা দিতে পারলাম না! বোঝেনই তো...!)

যাহোক, এত বাকবাকুমের দরকার কী! বিকেলের কথা বলি। বিকেলে এলেন এক ফল বিক্রেতা। বাসার সামনে থেকে যেন তিনি নড়বেনই না! সারাক্ষণ বলেই যাচ্ছেন, ‘এই আনারস, এই আম...’।

আমি বিরক্ত হয়ে মনে মনে বললাম, ‘বলি ব্যাটা একটু থাম!’

ছবি: প্রথম আলো

না, এবার আমাকেও থামতে হবে মনে হচ্ছে! কারণ, এই বিভাগের নামই তো ‘একটু থামুন’। থামার আগে কলার ভ্যান হাজির। দিন শেষে মেজাজও একটু চড়া। ফেরিওয়ালা চিৎকার দিলেন, ‘কলা আছে কলা...’।

আমি বললাম, ‘ধইরা দিমু ডলা!’

বলে মনে মনে নিজেই হেসে দিলাম। এই ডলা দেওয়ার বিষয়টা জনপ্রিয় সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের কাছে শেখা। তাঁর নাটক দেখে ‘ডলা’র বিষয়টা পরিষ্কার হয়েছে আমার কাছে...হায় হায়! আমি তো হোম অফিস করছি! অফিসের জরুরি কাজ ফেলে এসব কী করছি! আজকের মতো মুকেশ আম্বানি থুক্কু রতন টাটা...ধুর কী বলতে কী বলি...টা টা!