সাবেক নাকি প্রাক্তন—কোনটা ব্যবহার করব?

শব্দের রয়েছে বিচিত্র অর্থ, বিচিত্র রকম প্রয়োগ। অনেক ক্ষেত্রে এক শব্দ একাধিক অর্থে প্রয়োগ হয়; অনেক ক্ষেত্রে একাধিক শব্দের একই রকম অর্থ থাকে; অনেক ক্ষেত্রে মূল অর্থ ছাপিয়ে ভিন্ন অর্থ প্রধান হয়। কিছু অর্থ, কিছু প্রয়োগ আবার অভিধান সমর্থন করে না। শব্দের উৎস, অর্থ আর প্রয়োগ বৈচিত্র্য নিয়ে আমাদের এ আয়োজন...

সৈয়দ ঘণ্টন বিশেষ প্রয়োজনে গ্রামে গেলেন। প্রতিবছর শীতে একবার করে বাড়িতে যান। গত শীতে করোনার কারণে যেতে পারেননি। ইচ্ছা ছিল, এবার শীতের শেষ দিকে বাড়িতে যাবেন। কিন্তু কাজটা জরুরি বলে তাঁকে আগেভাগেই যেতে হলো।

গ্রামের হেডস্যার খবর পেয়ে সৈয়দ ঘণ্টনের সঙ্গে দেখা করতে এলেন। হেডস্যার বয়সে প্রবীণ; তবে এখনও লাঠি ছাড়া এ-গ্রাম ও-গ্রাম ঘুরে বেড়ান। ঢাকা থেকে তাঁর কোনো ছাত্র আসার খবর পেলে ছুটে আসেন। সৈয়দ ঘণ্টন শুধু তাঁর ছাত্র নয়, কৃতী ছাত্রদের একজন। তাই ঘণ্টনের আসার খবর পেয়ে আর দেরি করেননি। বাড়ির বাইরে থেকে হাঁক দিয়ে বললেন, ‘কই, কে আছ? ...অভিধানটা এসেছে শুনলাম!’

কোলাজ: একটু থামুন

স্কুলজীবনে সৈয়দ ঘণ্টন অভিধান হাতে ঘুরে বেড়াতেন। হেডস্যার তাই তখন থেকেই তাঁকে অভিধান বলে ডাকেন।

ঘণ্টনের চাচা এগিয়ে গিয়ে হেডস্যারকে নিয়ে এলেন। তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়েছে। ফলে উঠানে একটা কাঠের চেয়ার দেওয়া হলো। সেখানে হেডস্যার আয়েস করে বসলেন। সৈয়দ ঘণ্টন মুখ কাঁচুমাচু করে চেয়ারের পাশে এসে দাঁড়ালেন। সালাম দিয়ে বললেন, ‘স্যার, ভালো আছেন?’

কথা বলার সময় সৈয়দ ঘণ্টনের গলা কাঁপছিল। যতই হোক, একসময়ের হেডস্যার। যখন তিনি স্কুলে এসে ঢুকতেন, ছাত্ররা সব ভয়ে কুঁকড়ে যেত। কখনো কাউকে মারতেন না। তবু তাঁকে সবাই ভয় পেত। সৈয়দ ঘণ্টন স্কুল থেকে বের হয়েছেন তা–ও ২৪–২৫ বছর হয়ে গেল। তবে, এখনও স্যারের সামনে এলে গলা শুকিয়ে যায়। হেডস্যার ঘণ্টনের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কী রে! এখনও আগের মতো আছিস দেখছি। আমি বাঘ না ভালুক?’

সৈয়দ ঘণ্টন কোনো জবাব না দিয়ে হেডস্যারের দিকে তাকানোর চেষ্টা করেন। স্যার হেসে বলেন, ‘তুই এসেছিস শুনে দৌড়ে এলাম। তা এখনো আগের মতো অভিধান মুখস্থ করিস নাকি?’

সৈয়দ ঘণ্টন কখনো অভিধান মুখস্থ করতেন না। তবে তাঁর হাতে অভিধান দেখে স্কুলের সবাই মনে করত, তিনি বুঝি সব পড়া বাদ দিয়ে শুধু অভিধান মুখস্থ করেন। সৈয়দ ঘণ্টন অবশ্য ওসব আলোচনায় না গিয়ে বললেন, ‘স্যার, আবার কষ্ট করে আসতে গেলেন কেন? আপনি বললেই তো আমি আপনার সঙ্গে দেখা করে আসতাম।’

হেডস্যার হাসতে হাসতে বললেন, ‘এখন তোরা ব্যস্ত মানুষ। শুনেছি, শহরে যারা চাকরি করে, তাদের দম ফেলারও সময় হয় না। আবার গ্রামেও আসিস দু–এক দিনের জন্য। আমিও আর হেডমাস্টার নেই। প্রাক্তন হয়েছি ১০ বছরের বেশি হলো। এর মধ্যে আমি যদি তোদের কাছে ছুটে আসি, তবে সমস্যা কোথায়?’

কোলাজ: একটু থামুন

সৈয়দ ঘণ্টনের ছোট চাচা এতক্ষণ ধরে চুপ করে কথা শুনছিলেন। তিনি হেডস্যারের কথার সূত্র ধরে বললেন, ‘স্যার, আপনি প্রাক্তন বললেন কোন অর্থে? কথাটা সাবেক হবে না?’

‘প্রাক্তন হবে না কি সাবেক হবে, তা তোমার ভাতিজা—এই জীবন্ত অভিধান থাকতে আমাকে জিজ্ঞেস করো কেন?’ বলে হেডস্যার তাকান ঘণ্টনের দিকে। ছোট চাচা এবার সরাসরি ঘণ্টনের দিকে প্রশ্ন ছোড়েন, ‘আমি তো জানি, কথাটা সাবেক হবে। যেমন আমাদের গ্রামের সাবেক চেয়ারম্যান ইসমাইল মোল্লা। একইভাবে হেডস্যার নিজেকে প্রাক্তন বললে ভুল হবে না?’

কথা বলার মতো পছন্দসই বিষয় পেয়ে সৈয়দ ঘণ্টন মজা পান। বলেন, ‘পুরাতন বা আগের বোঝাতে হেডস্যার প্রাক্তন বলেছেন। এতে কোনো ভুল নেই।’

‘তাহলে কি সাবেক বললে ভুল হবে?’ ছোট চাচা বেশ অবাক হন।

‘সাবেক বললেও সমস্যা নেই। দুটো শব্দের একই অর্থ। সাবেক শব্দটা আরবি আর প্রাক্তন শব্দটা সংস্কৃত।’

ছোট চাচা ঘরের দাওয়া থেকে একটা মোড়া নিয়ে হেডস্যারের সামনে বসতে বসতে বললেন, ‘মুসলমান হিসেবে আমাদের তাহলে সাবেক বলা উচিত। প্রাক্তন না।’

কোলাজ: একটু থামুন

সৈয়দ ঘণ্টন দেরি না করে বললেন, ‘চাচা, এ প্রসঙ্গে একটা ইতিহাস বলি। পাকিস্তান রাষ্ট্র পৃথক হওয়ার দুই বছর পরে, ১৯৪৯ সালে পূর্ববঙ্গ সরকার একটা ভাষা কমিটি গঠন করে। এ কমিটি বাংলা ভাষার লিপি ও বানান নিয়ে নতুন কিছু প্রস্তাব করেছিল। তারা বাংলা ভাষার শব্দ নিয়েও কিছু কথা বলে। তাদের প্রস্তাবে মৃত্যুবরণের বদলে ইন্তেকাল শব্দ ব্যবহার করতে বলা হয়েছে। একইভাবে বিস্ময়ের বদলে তাজ্জব, আবার ঋণ শোধের বদলে কর্জ আদায় ব্যবহার করতে বলা হয়েছে।’

‘এতে সমস্যা কোথায়?’ ছোট চাচা বিষয়টা ঠিকমতো বুঝে নিতে চান। সৈয়দ ঘণ্টন বলেন, ‘চাচা, শব্দের কোনো ধর্ম নেই। ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করা মানে এই নয়, আমরা খ্রিষ্টানদের শব্দ ব্যবহার করছি। আবার আরবি শব্দ ব্যবহার করা মানে এই নয়, মুসলমানদের শব্দ ব্যবহার করছি।’

হেডস্যারও মনোযোগ দিয়ে কথাগুলো শুনছিলেন। তিনি তাঁর প্রিয় ছাত্রকে সতর্ক করে বললেন, ‘প্রাক্তন বলতে কিন্তু পুনর্জন্মও বোঝায়!’

‘আপনি ঠিকই বলেছেন, স্যার,’ সৈয়দ ঘণ্টন আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে হেডস্যারের চোখের দিকে তাকান, ‘তবে, যে অর্থে সাবেক প্রধান শিক্ষক বলা যায়, একই অর্থে প্রাক্তন প্রধান শিক্ষকও বলা যায়।’

তারিক মনজুর: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন