ইউরোপীয় ইউনিয়নের যাত্রা শুরু

ইউরোপীয় ইউনিয়নের পতাকা
ছবি: রয়টার্স

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ–পরবর্তী পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সহযোগিতা বৃদ্ধির আকাঙ্ক্ষা থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন গড়ে ওঠে। ধীরে ধীরে তা আবির্ভূত হয় বিশ্বের বৃহত্তম আঞ্চলিক জোট হিসেবে। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো নিজেদের মধ্যে শান্তি, মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রচার করে। এ ছাড়া এটি বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী বাণিজ্যিক জোটগুলোর মধ্যে একটি।

১৯৫৭ সালের ২৫ মার্চ পশ্চিম ইউরোপের ছয়টি দেশের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যা ‘রোম চুক্তি’ নামে পরিচিত। এ চুক্তির ফলে ‘ইউরোপীয় কয়লা ও ইস্পাত সম্প্রদায়’ বর্ধিত হয়ে ‘ইউরোপীয় অর্থনৈতিক সম্প্রদায়’ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। একই দিনে আরেকটি চুক্তির মাধ্যমে ‘ইউরোপীয় আণবিক শক্তি সম্প্রদায়’ গঠিত হয়। ১৯৬৭ সালে নতুন একটি চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে এই তিনটি সম্প্রদায়কে একত্রিত করে গঠন করা হয় ‘ইউরোপীয় সম্প্রদায়’। এ সময়ের মধ্যে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ সম্প্রদায়টিতে যোগ দিতে থাকে।

১৯৯২ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি নেদারল্যান্ডসের ম্যাসত্রিহিতে ‘ইউরোপীয় সম্প্রদায়’–এর সদস্যদের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যা ‘ম্যাসত্রিহিত চুক্তি’ নামে পরিচিত। ১৯৯৩ সালের ১ নভেম্বর এ চুক্তি কার্যকরের মধ্য দিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে। তখন ১২টি দেশ ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য ছিল। দেশগুলো হলো ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি, আয়ারল্যান্ড, স্পেন, পর্তুগাল, ইতালি, গ্রিস, ডেনমার্ক, লুক্সেমবার্গ, বেলজিয়াম ও নেদারল্যান্ডস। এখন ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য রাষ্ট্রের সংখ্যা ২৭।

ম্যাসত্রিহিত চুক্তিতে বিভিন্ন দেশের মন্ত্রীদের স্বাক্ষর
ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস

ম্যাসত্রিহিত চুক্তির মাধ্যমে একটি শক্তিশালী ইউরোপীয় সংসদ ও একটি কেন্দ্রীয় ইউরোপীয় ব্যাংক তৈরি করা সম্ভব হয়েছিল। এ চুক্তি ইউরো নামে একটি একক ইউরোপীয় মুদ্রা প্রতিষ্ঠার ভিত্তি স্থাপন করেছিল, যা চালু হয় ১৯৯৯ সালে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৭টি দেশের মধ্যে ১৯টি দেশ তাদের সরকারি মুদ্রা হিসেবে ইউরো ব্যবহার করে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন সাতটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কাজ করে। এগুলো হলো ইউরোপীয় কাউন্সিল, ইউরোপীয় কমিশন, ইউরোপীয় পার্লামেন্ট, ইউরোপীয় ইউনিয়নের মন্ত্রিপরিষদ, ইউরোপীয় কোর্ট অব জাস্টিস, ইউরোপীয় সেন্ট্রাল ব্যাংক ও ইউরোপীয় কোর্ট অব অডিটরস। জোটের অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অনেক কিছুই এ প্রতিষ্ঠানগুলোর একক সিদ্ধান্তে পরিচালিত হয়।

ইউরোপে গণতন্ত্র, শান্তি ও মানবাধিকার প্রচারের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১২ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়ন শান্তিতে নোবেল পুরস্কার লাভ করে। ইউরোপীয় ইউনিয়নকে শান্তিতে নোবেল দেওয়ার কারণ হিসেবে নোবেল কমিটির ভাষ্য ছিল, ‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের উন্মাদনা ও মরণখেলার পর ইউরোপ নতুন করে গড়ে উঠেছে। আজ জার্মানি ও ফ্রান্সের মধ্যে যুদ্ধের কথা চিন্তাও করা যায় না। ইউরোপীয় ইউনিয়ন গঠনের মধ্য দিয়ে আন্তরিক ইচ্ছা, পারস্পরিক বিশ্বাস ও আস্থা অর্জনের মাধ্যমে ঐতিহাসিক শত্রুতা ভুলে দেশগুলো একে অপরের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হয়ে উঠেছে।’

২০১১ সালের এই ছবিকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ‘পারিবারিক ছবি’ বলা চলে
ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস

২০১৬ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া ‘ব্রেক্সিট’–এর বিষয়ে গণভোট অনুষ্ঠিত হলে যুক্তরাজ্যের ৫২ শতাংশ নাগরিক এর পক্ষে ভোট দেন। ২০২০ সালের ৩১ জানুয়ারি ব্রেক্সিট কার্যকর হয়। ব্রেক্সিট কার্যকর হওয়ার পর থেকে যুক্তরাজ্যের অর্থনীতিতে নাজুক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। সম্প্রতি লিজ ট্রাস প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার মাত্র দেড় মাস পরই ব্যর্থতার অপবাদ নিয়ে পদত্যাগ করলে আবারও ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগ দেওয়ার দাবিতে উত্তাল হয়ে ওঠে লন্ডনের রাজপথ।