ভালোবাসা যত বড়, জীবন তত বড় নয়

অলংকরণ: আরাফাত করিম

নামের প্রথম অক্ষর ‘শ’। তাহলে কি শম্পা? না শর্মিলা? নাকি শুমি?

ধুর! সুমি তো লিখতে হয় দন্ত্য স দিয়ে।

তাহলে?

ধ্যাৎ, সরাসরি না দেখে প্রেমে পড়াটাই ভুল হয়েছে। স্বগতোক্তি করে ছেলেটি।

‘ফেসবুকে পরিচয়, প্রেমের অভিনয় করে যুবকের সর্বস্ব লুটে নিল প্রেমিকারূপী প্রতারক’—কয়েক দিন আগেই এ রকম একটি খবরের লিংক ফেসবুকে পোস্ট করে কাছের চার বন্ধুকে ট্যাগ করেছিল সে।

আর আজ, তার নিজেরই ‘তারে আমি চোখে দেখিনি, ফেসবুকেতে দেখেছি, দেখতে দেখতে আস্তে আস্তে তারই প্রেমে পড়েছি...’ টাইপ অবস্থা।

কিন্তু হোক না মাত্র দেড় মাসের পরিচয়, তাই বলে আসল নামটাও বলবে না? ফেসবুকের বিভিন্ন পণ্য বিক্রির পেজগুলো তো অন্তত ইনবক্সে দাম বলে, এই মেয়ে সেটাও বলেনি। শুধু বলেছে, তার নামের আদ্যক্ষর ‘শ’।

২.

‘নেম’ দেখে নয়, ছেলেটি প্রেমে পড়েছিল ‘ফ্রেম’ দেখে!

মেয়েটিকে ‘পিপল ইউ মে নো’তে দেখেই সামনাসামনি দেখার ইচ্ছেটা জেগেছিল। কিচ্ছেটা তারপর থেকে শুরু!

‘অচেনা আমি’ নামের মেয়েটির প্রোফাইল ফ্রেমের ছবিটা সুন্দর। তবে সৌন্দর্যের বিষয়ে একটা আদর্শ মেনে চলে ছেলেটি। সেটি হলো—সৌন্দর্য আপেক্ষিক। আজীবন আক্ষেপ করতে হয় বাহ্যিক সৌন্দর্যের প্রেমে পড়লে। আর শুধু বাহ্যিক সৌন্দর্য বিচার করে বিয়ে করলে তো গল্প শেষ! বাকি জীবনে হবে শুধু নালিশ আর বিচার-সালিস। সাক্ষী থাকবে বিছানা-বালিশ!

কিন্তু ভেতরের সৌন্দর্য কীভাবে আবিষ্কার করা সম্ভব?

ভাবতে ভাবতে ফেসবুকে দেখা একটা উক্তির কথা মনে পড়ে গিয়েছিল, ‘বাইরের সৌন্দর্য নয়, ভেতরের সৌন্দর্যই আসল। তাই, দেখে-শুনে-বুঝে বাছাই করুন পছন্দের আন্ডারগার্মেন্টস!’

কথা সত্য! তাই ‘ফ্রেম দেখে প্রেমে পড়া’ হলেও অন্য দশটি ছেলের মতো ইনবক্সে ‘বন্ধু হতে চাই’জাতীয় বিজাতীয় ‘হ্যাংলামি’ বা ‘পাগলামি’ সে করেনি।

কাব্য করে লিখেছিল—

অচেনা মেয়েটাকে চিনতে চাই

বিশ্বাসের দামে কিনতে চাই!

মিনিট না পেরোতেই রিপ্লাই পেয়েছিল—ওয়াও, কী দারুণ লেখেন আপনি! একেবারে ঠুস করে প্রেমে পড়ে যাওয়ার মতো!

ছেলেটি রিপ্লাই দেয়, আমি তো ঠুস হয়েই গেছি!

এরপর...দিনরাত দুজনের টুং আর টাং! টাং আর টুং!

মেয়েটি জানত না, কাব্য-কথাগুলো ফেসবুকে পাওয়া এক লেখকের উক্তি থেকে মেরে দিয়েছিল ছেলেটি।

ছেলেটি জানত না, মেয়েটির আসল নাম।

মেয়েটি বলেছিল, যেদিন আমাদের প্রথম দেখা হবে, সেদিনই আমি আমার আসল নাম বলব।

আর ছেলেটি বলেছিল, তত দিন আমি তোমাকে ‘ভালোবাসা’ বলেই ডাকব।

৩.

ইনবক্সিংয়ের (মানে ইনবক্সে কথা–চালাচালি আর কী!) কয়েক মাস পেরিয়ে গেছে।

আজ ভালোবাসা দিবস। ওদের প্রথম দেখা হবে।

ফেব্রুয়ারি মাসের শুরু থেকেই কথাসাহিত্যের চেয়ে ব্যথাসাহিত্য নিয়ে দুজনের টুং-টাং, টাং-টুং বেশি হয়। অতঃপর পারস্পরিক সম্মতিক্রমে প্রথম দেখার ক্ষণ উপস্থিত।

কী হয়! কী হবে! ছেলেটির বারবার শুধু ওই নিউজটার কথাই মনে পড়ে—ফেসবুকে পরিচয়, তারপর প্রেমের অভিনয় করে...।

অবশ্য নিউজ-ট্যাগানো (মানে ট্যাগ করা হয়েছিল যাদের) সেই চারজন ‘বিপদের বন্ধু’ অভয় দিয়ে বলেছে, ‘চিন্তা করিস না দোস্ত, আমরা মাস্ক পরে আশপাশেই থাকব। কোনো প্রতারক, ছলনাময়ী তোর কিচ্ছু করতে পারবে না!’

বন্ধুদের কথা শুনে মাথার চুল চুলকাতে চুলকাতে ফেসবুকে পাওয়া আরেকটি উক্তি মনে পড়ে যায় ছেলেটির, ‘মানুষ ভালোবাসার কাছে ফেরে না, ফেরে সত্যের কাছে।’

আজ সে কোন সত্যের মুখোমুখি হতে যাচ্ছে!

৪.

রেস্তোরাঁর দরজা দিয়ে ঢুকে টিয়া রঙের শাড়ি পরা মেয়েটিকে দেখেই হার্টের একটা বিট মিস হয়ে গেল। একে শুধু ‘ভালোবাসা’ বলে ডাকলে অন্যায় করা হবে। ডাকতে হবে ‘ভালোবাসা সীমাহীন’!

রেস্তোরাঁর ভেতরে, তিনটা টেবিল পেছনে বসা সেই চারজন ট্যাগানো বন্ধু আড়চোখে দেখল, দুজন মুখোমুখি বসেছে। হাসছে। কথা বলছে। একসময় দুজনের মধ্যে উপহার বিনিময় হলো। খাওয়াদাওয়া হলো। সবশেষে বিদায় নেওয়ার জন্য উঠে দাঁড়াল ওরা দুজন। 

সঙ্গে সঙ্গে চার বন্ধুর মাস্কে ঢাকা মুখের হাসি উধাও হয়ে গেল। এক বন্ধু ফিসফিস করে বলল, ‘একি দেখছি! ভালোবাসা যত বড়, জীবন তত বড় নয়।’

দ্বিতীয়জন বলল, ‘হুঁ, জীবনের চেয়ে ওই মেয়েটি কমপক্ষে ৬ ইঞ্চি লম্বা হবে।’

তৃতীয়জন বলল, ‘এই প্রেম আজই শেষ।’

চতুর্থজন (দৈনিক গতকাল পত্রিকার রিপোর্টার) আফসোস করে বলল, ‘ভেবেছিলাম ফেসবুকে পরিচয়, প্রেমের নামে যুবকের সর্বস্ব লুটে নিল প্রতারক প্রেমিকা—এই শিরোনামে একটা নিউজ লিখব। হলো না...’

ওদের এসব ফিসফিসানির মধ্যেই
জীবন নামের ছেলেটি, শর্বরী নামের মেয়েটির হাত ধরে হাসতে হাসতে রেস্তোরাঁ থেকে
বেরিয়ে গেল।

প্রতি বৃহস্পতিবার প্রথম আলোর মূল পত্রিকার ভেতর প্রকাশিত হচ্ছে বিশেষ রম্য পাতা—কথাcom। লেখা পাঠাতে পারেন আপনিও: [email protected]