বর্তমান বিশ্বে সামরিক, অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে চীনের অবস্থান অনেক সুসংহত। চীনের এই শক্তিশালী অবস্থানের পেছনে আছে কমিউনিস্ট পার্টির দূরদর্শী ও দক্ষ নেতৃত্ব। চীনের কমিউনিস্ট পার্টির নাম বললে যাঁর নাম প্রথমেই বলতে হয়, তিনি মাও সে–তুং। মার্কিন সহায়তাপুষ্ট শাসক চিয়াং কাইশেকের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিনের সংগ্রামে জয়লাভের মধ্য দিয়ে তিনি ১৯৪৯ সালের ১ অক্টোবর বেইজিংয়ের তিয়েনআনমেন চত্বরে পিপলস রিপাবলিক অব চায়না প্রতিষ্ঠা করে চীনে কমিউনিস্ট শাসনের ঘোষণা দেন।
১৮৯৩ সালে মাও সে–তুং–এর জন্মের সময় চীনে চলছিল চিং রাজবংশের দুর্দশাগ্রস্ত শাসন। মাওয়ের জন্ম সম্ভ্রান্ত ও সচ্ছল কৃষক পরিবারে হলেও তখন চীনের অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল খুবই করুণ। আট বছর বয়সে মাও গ্রামের স্কুলে ভর্তি হন, সেখানে প্রাথমিক শিক্ষা শেষে মাও হুনান প্রদেশের রাজধানী চাংশায় গিয়ে মাধ্যমিক শিক্ষাজীবন শুরু করেন। তখন চীনে চিং রাজবংশবিরোধী আন্দোলন শুরু হলে মাও কিছুদিনের জন্য আন্দোলনে যোগ দেন। ১৯১৮ সালে তিনি স্নাতক সম্পন্ন করে বেইজিংয়ে চলে যান এবং বেইজিং বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারিক লি দাজাওয়ের সহকারী হিসেবে কাজ শুরু করেন।
লি ছিলেন প্রাথমিক চীনা কমিউনিস্টদের একজন। লির বিপ্লবী চিন্তাভাবনা দ্বারা প্রভাবিত হন মাও সে–তুং। একসময় মাও হাতে পান মার্ক্সবাদী চিন্তাধারার বইপত্র। এরপর মার্ক্সবাদী হিসেবে বেশ পরিচিত হয়ে ওঠেন তিনি রাজনৈতিক মহলে এবং ১৯২১ সালে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
১৯২৭ সালে কুয়োমিনটাং দলের চেয়ারম্যান ও চীনের প্রেসিডেন্ট চিয়াং কাইশেক কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি সহিংস হয়ে উঠলে মাও সে–তুং কৃষকদের নিয়ে বিপ্লবী বাহিনী গঠন করেন, যা একসময় ‘রেড আর্মি’ নামের পরিচিত হয়ে ওঠে। এই বাহিনীকে শক্তিশালী করার মধ্য দিয়ে মাও ১৯৩০ সালে তাঁর নিয়ন্ত্রণাধীন দক্ষিণ-পশ্চিম জিয়াংজি অঞ্চলে সোভিয়েত রিপাবলিক অব চায়না সরকার গঠন করেন।
১৯৩৪ সালে জিয়াংজি প্রদেশের বেশ কিছু অঞ্চল মাওয়ের অধীন চলে আসে। চিয়াং কাইশেক প্রায় ১০ লাখ সৈন্য পাঠান রেড আর্মিকে দমন করার জন্য এবং তারা জিয়াংজি প্রদেশের পার্বত্য অঞ্চলে রেড আর্মিকে ঘিরে ফেলে। তখন রেড আর্মি সেখান থেকে কৌশলে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়।
১৯৩৭ সালে জাপান চীন আক্রমণ করলে চিয়াং কাইশেক জাপানের কাছে বেইজিংসহ বেশ কিছু অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। তখন তিনি কমিউনিস্টদের সঙ্গে সন্ধি স্থাপন করেন এবং কমিউনিস্ট ও কুয়োমিনটাং বাহিনী একসঙ্গে জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের পরাজয়ের মধ্য দিয়ে চীন জাপানের দখলকৃত অঞ্চল ফিরে পায়। এরপর আবার চীনে রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। মাও সে–তুং তাঁর কৌশলী নেতৃত্বের মাধ্যমে কুয়োমিনটাং বাহিনীকে পরাজিত করেন এবং ১৯৪৯ সাল নাগাদ পুরো চীন দখল করতে সক্ষম হন।
মাও সে–তুং আমৃত্যু কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্ব দিয়েছেন। তবে বিপ্লবী হিসেবে তিনি সফল হলেও রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে তাঁর ছিল অনেক ব্যর্থতা। তাঁর আদর্শ অনেকটা জটিল ও বিতর্কিত হলেও এখনো চীনে তাঁর আদর্শ গ্রহণ করা হয় এবং তাঁকেই বলা হয় আধুনিক চীনের রূপকার।