ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী হত্যাকাণ্ড

ইন্দিরা গান্ধী
ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা বিদেশি ব্যক্তিটি ইন্দিরা গান্ধী। তিনি যুদ্ধরত বাংলাদেশের এক কোটির বেশি শরণার্থীকে আশ্রয়, খাদ্য ও চিকিৎসা দিয়েছেন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র সরবরাহ ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছেন। বিভিন্ন দেশে গিয়ে চেয়েছেন বাংলাদেশের পক্ষে সমর্থন। একপর্যায়ে নিজের দেশকে প্রত্যক্ষভাবে সেই যুদ্ধে জড়িয়েও ফেলেছেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের অকৃত্রিম এই বন্ধু ১৯৮৪ সালের আজকের এই দিনে তাঁর দুই দেহরক্ষীর গুলিতে প্রাণ হারান।

ইন্দিরা গান্ধী ছিলেন ভারতের তৃতীয় এবং এখন পর্যন্ত একমাত্র নারী প্রধানমন্ত্রী। স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ব্রিটিশ শাসনের অধীনে বিদ্যমান বহু ধর্মীয়, জাতিগত এবং সাংস্কৃতিক উপদলের মধ্য থেকে একটি ঐক্যবদ্ধ জাতি গঠনের চেষ্টা করেছিলেন। ১৯৬৪ সালে তাঁর মৃত্যুর দুই বছর পর কন্যা ইন্দিরা গান্ধী ক্ষমতায় আসেন। ইন্দিরাকেও বাবার মতো একই সমস্যার বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়েছিল। বিরোধীরা ইন্দিরা গান্ধীকে কর্তৃত্ববাদী বলে সমালোচনা করলেও ব্যাপক সামাজিক কর্মসূচির কারণে তিনি দারুণ জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। ১৯৬৬ থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন তিনি। ১৯৭৩ সাল থেকে তাঁর জনপ্রিয়তা হ্রাস পেতে থাকে। ১৯৭৫ সালে এলাহাবাদ হাইকোর্ট চার বছর আগে ঘটে যাওয়া নির্বাচনে সরকারি সম্পদ ব্যবহারসহ কিছু অভিযোগে তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করেন এবং তাঁর সংসদ সদস্যপদ বাতিলের পাশাপাশি ছয় বছরের জন্য সরকারি পদে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে মন্ত্রিপরিষদ জরুরি অবস্থা জারির সুপারিশ করলে রাষ্ট্রপতি জরুরি অবস্থা জারি করেন, যা ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত কার্যকর থাকে। এরপর ১৯৮০ সালের নির্বাচনে বিপুল জনপ্রিয়তা নিয়ে ইন্দিরা গান্ধী আবার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন।

১৯৭৭ সালের নির্বাচনের পর ভারতের পাঞ্জাব রাজ্যে শিখপ্রধান অকালি দলের নেতৃত্বাধীন একটি জোট ক্ষমতায় আসে। এই দলে ভাঙন ধরাতে এবং শিখদের মধ্য থেকে জনসমর্থন আদায় করতে ইন্দিরা গান্ধী রক্ষণশীল ধর্মীয় নেতা জার্নেল সিং ভিন্দ্রানওয়ালাকে দায়িত্ব দেন। পরবর্তী সময়ে ভিন্দ্রানওয়ালা নিজেই অকালি দলে যোগ দেন। ভিন্দ্রানওয়ালার নেতৃত্বে এই দলের একটি অংশ শিখদের জন্য স্বাধীন রাষ্ট্রের দাবি জানায় এবং তাঁরা উগ্রপন্থার দিকে ঝুঁকে পড়েন। ১৯৮২ সালে ভিন্দ্রানওয়ালা ২০০ জন সশস্ত্র বিদ্রোহীকে নিয়ে স্বর্ণমন্দির চত্বরের একটি অতিথিশালায় ঘাঁটি স্থাপন করেন। ১৯৮৩ সালের মধ্যে স্বর্ণমন্দির চত্বর শিখ বিদ্রোহীদের দুর্গে পরিণত হয়। তাঁরা মন্দিরে লাইট মেশিনগান ও সেমি অটোমেটিক রাইফেলসহ বিভিন্ন অস্ত্র জড়ো করতে থাকেন।

বেশ কয়েকবার আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর ১৯৮৪ সালের জুন মাসে ইন্দিরা গান্ধীর নির্দেশে ভারতীয় সেনাবাহিনী ট্যাংক ও ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ভিন্দ্রানওয়ালা ও তাঁর অনুগতদের সরিয়ে দেওয়ার জন্য স্বর্ণমন্দির চত্বরে অভিযান চালায়। এই অভিযানের সাংকেতিক নাম ছিল ‘অপারেশন ব্লু স্টার’। পুরো দিন ও রাত ধরে চলা অভিযানে প্রায় চার শ শিখ বিদ্রোহী ও কয়েক জন তীর্থযাত্রী নিহত হন। মন্দিরের ভেতর থেকে জার্নেল সিং ভিন্দ্রানওয়ালার মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়।

স্বর্ণমন্দিরে অভিযানের পর গোয়েন্দা সংস্থাগুলো প্রধানমন্ত্রীর ওপর হামলার আশঙ্কা প্রকাশ করেছিল এবং প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন থেকে সব শিখ নিরাপত্তাকর্মীকে সরিয়ে নেওয়ার সুপারিশ করেছিল। সুপারিশটি ইন্দিরা গান্ধীর টেবিলে পৌঁছালে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন।

১৯৮৪ সালের ৩১ অক্টোবর সকালে ইন্দিরা গান্ধী বাসভবন থেকে বাইরে বের হলে তাঁর দুই শিখ দেহরক্ষী বিয়ন্ত সিং ও সতবন্ত সিং ইন্দিরা গান্ধীকে মোট ২৮টি গুলি করেন। অন্য নিরাপত্তাকর্মীরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই দুই দেহরক্ষী খুব দ্রুত এ ঘটনা ঘটান। গুলি করার পর বিয়ন্ত সিং আর সতবন্ত সিং নিজেদের অস্ত্র মাটিতে ফেলে দেন এবং বলেন, ‘আমাদের যা করার ছিল সেটা করেছি, এবার তোমাদের যা করার করো।’ ইন্দিরা গান্ধীকে অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট ফর মেডিকেল সায়েন্সে নিয়ে যাওয়া হয়। বেলা আড়াইটার দিকে ইন্দিরা গান্ধীকে মৃত ঘোষণা করা হয় এবং সরকারি প্রচারমাধ্যম সন্ধ্যা ছয়টায় তাঁর মৃত্যুর খবর প্রচার করে।

ইন্দিরা গান্ধীকে হত্যার পর নয়াদিল্লিতে দাঙ্গা শুরু হয়। এ দাঙ্গায় তিন হাজারের বেশি শিখ ধর্মাবলম্বী নিহত হয়। ইন্দিরা গান্ধীর পুত্র রাজীব গান্ধী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন। তিনিও ১৯৯১ সালে এক আত্মঘাতী বোমা হামলায় নিহত হন।