আয়ারল্যান্ডের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বিবাহবিচ্ছেদ অনুমোদন

১৯৯৫ সালে ডাবলিনে বিবাহবিচ্ছেদের বিপক্ষে জনসমাগম
ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিবাহবিচ্ছেদ বা তালাকের মতো ঘটনা যেন একেবারে পান্তাভাত। বাংলা সিনেমার কথাই ধরুন। স্বামী হয়তো বলে বসলেন, ‘এক তালাক...দুই তালাক...তিন তালাক...!’ ব্যস, সিনেমায় যিনি স্ত্রীর ভূমিকায়, তিনি তিন তালাকের কথা শুনে মূর্ছা গেলেন! সিনেমার দৃশ্য হলেও বাস্তবতা কিন্তু অনেকাংশেই এ রকম। তবে আয়ারল্যান্ডের মতো দেশে বিবাহবিচ্ছেদ মোটেও ছেলেখেলা ছিল না। দেশটির ইতিহাসে উচ্চ আদালত প্রথমবারের মতো বিবাহবিচ্ছেদ অনুমোদন করেন ১৯৯৭ সালে!

১৯৯৫ সালে একটা গণভোটে আয়ারল্যান্ড তাদের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বিবাহবিচ্ছেদকে আইনগতভাবে বৈধতা দেয়। ওই রায়ের পর দেশটিতে প্রথম বিবাহবিচ্ছেদ কার্যকর হয় ১৯৯৭ সালের ১৭ জানুয়ারি। বিবাহবিচ্ছেদের রায় দেওয়া হয়েছিল একজন গুরুতর অসুস্থ ব্যক্তির পক্ষে, যিনি তাঁর নতুন সঙ্গীকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কেন এত দেরিতে বিবাহবিচ্ছেদ আইনগতভাবে বৈধতা পেল ইউরোপের দেশ আয়ারল্যান্ডে?

আয়ারল্যান্ডের কোনো রাষ্ট্রীয় ধর্ম নেই, তবে দেশটি ক্যাথলিকপ্রধান। আয়ারল্যান্ডের সংবিধানেও ক্যাথলিক মতবাদ ছড়িয়ে আছে নানাভাবে। আইরিশ জনজীবনে গির্জাগুলোর প্রভাব বেশ শক্তিশালী। ফলে সেখানে বিবাহবিচ্ছেদকে সোজা বাংলায় ‘মহাপাপ’ হিসেবেই দেখা হতো। ইতালিও ক্যাথলিকপ্রধান দেশ, তবে সেখানে বিবাহবিচ্ছেদ বৈধতা পেয়েছিল সেই ১৯৭০ সালে। আয়ারল্যান্ডে বিবাহবিচ্ছেদকে বৈধতা দেওয়ার জন্য আন্দোলনকারীদের কম কাঠখড় পোড়াতে হয়নি। ১৯৩৭ সাল থেকে আইরিশ সংবিধান বিবাহবিচ্ছেদ নিষিদ্ধ করে বিশেষভাবে। তবে ১৯৮৬ সালে আইরিশ সরকার বিবাহবিচ্ছেদ নিয়ে গণভোটের আয়োজন করে। তখন সাংবিধানিক সংশোধনীর বিপক্ষে ভোট দেন ৬৩ দশমিক ৫ শতাংশ জনগণ। এরপর আইনগতভাবে বিচ্ছেদ অনুমোদনের আইন পাস হয় ১৯৮৯ সালে, কার্যকর হয় আরও অনেক পরে।

১৯৯৪ সালে আয়ারল্যান্ডে সরকার গঠন করে মধ্যপন্থী প্রগতিশীল দলগুলোর জোট ‘রেইনবো কোয়ালিশন’। সরকার ক্ষমতায় আসার পর আবারও বিবাহবিচ্ছেদের নিয়ম পরিবর্তনের জন্য গণভোটের আয়োজন করে তারা। তবে তা নাকচ করে দেন পোপ দ্বিতীয় জন পল ও মাদার তেরেসা। আর ওই গণভোটেই পরিষ্কার হয় যে আয়ারল্যান্ডের গির্জাগুলো বিবাহবিচ্ছেদের বিপক্ষে।

যা হোক, পরবর্তী সময়ে গির্জাগুলো স্বীকার করে নেয়, গণভোটের পক্ষে ভোট দেওয়া ক্যাথলিকদের জন্য পাপ নয়। তবে শেষ পর্যন্ত ১৯৯৫ সালের গণভোটে বিবাহবিচ্ছেদের পক্ষে ভোট পড়ে ৫০ দশমিক ৩ শতাংশ, ৪৯ দশমিক ৭ শতাংশ মানুষ পোষণ করে ভিন্নমত।

১৯৯৫ সালে আয়ারল্যান্ডে বিবাহবিচ্ছেদের পক্ষে প্রচারণা
ছবি: সংগৃহীত

১৯৯৫ সালের রায়ে একটা শর্ত ছিল। সেখানে বলা হয়, আয়ারল্যান্ডে কমপক্ষে চার বছর ধরে বিচ্ছিন্ন এমন দম্পতির ক্ষেত্রেই বিচ্ছেদের বৈধতা দেওয়া হবে। সব মিলিয়ে এই রায়ে ধর্মীয় নয় বরং রাষ্ট্রের মতবাদে বিশ্বাসী লোকজনই খুশি হয়েছিলেন। বিবাহবিচ্ছেদের বৈধতাকে তাঁরা ধরে নিয়েছিলেন বিজয় হিসেবে। কেবল রায় পাস করা নয়, রাষ্ট্রের কাছে যথাযথ ক্ষেত্রে আইনটির প্রয়োগেরও দাবি করেন তাঁরা। বিবাহবিচ্ছেদের পক্ষের একজন প্রচারক ম্যাগস ও’ব্রায়েন যেমন বলেছিলেন, ‘আমরা এই একুশ শতকের উষালগ্নে আয়ারল্যান্ডকে নিয়ে এলাম বিশ শতকের দোরগোড়ায়।’

১৯৯৫ সালের ওই রায়ের আরেকটি সংশোধনী আনা হয় ২০১৯ সালে। সেখানে বিচ্ছেদের জন্য কমপক্ষে চার বছর দাম্পত্যজীবনে আলাদা থাকার ওই শর্তের প্রবিধান উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ এখন আইরিশ আইনে দেশটির নাগরিকেরা বিবাহবিচ্ছেদের সিদ্ধান্তের বেলায় পুরোপুরি স্বাধীন।