আম্পায়ারিং সোজা নয়

আম্পায়ারিংয়ে আমি মোটামুটি টিকে গেলামঅলংকরণ: এস এম রাকিবুর রহমান

ছোটবেলায় কাঠের তক্তা থেকে শুরু করে নারকেলগাছের শাখা, হেন বস্তু নাই, যেটা দিয়ে আমরা বল পিটাই নাই! গ্রামের মাঠ ছেড়ে, নদীর ঘাট পেরিয়ে, শহুরে জীবনে এসে মাঠে বল পেটানো বন্ধ হয়েছে। কিন্তু কম্পিউটারে মাউস চেপে চার-ছক্কার ঝড় তুলে তুলে ক্রিকেটের ‘প্র্যাকটিস’ ধরে রেখেছি ঠিকই।

একসময় যখন অস্ট্রেলিয়ায় পিএইচডি করতে এলাম, দেখলাম এখানে প্রতি পাড়ায় ক্রিকেট মাঠ। কিছু ডলার খরচা করে সদস্য হয়ে গেলাম এক ক্লাবের। ভাবলাম, এবার শুরু হবে ফেসবুকে ‘অস্ট্রেলিয়ার ক্লাবে খেলছি’ ভাব নিয়ে বাংলাদেশের প্রতিটা আন্তর্জাতিক ম্যাচের আগে-পরে বিশেষজ্ঞ মতামত দেওয়া। কিন্তু আমি তো কাঠের তক্তা দিয়ে টেপ টেনিস বল পেটানো লোক। অরিজিনাল কুকাবুরা বল আর ব্যাটের সংঘর্ষে যেই কলিজা কাঁপানো শব্দ হয়, সেটা শুনেই ক্রিকেট খেলার শখ প্রায় মিটে গেল। একটা ম্যাচ খেলেই ফিটনেসে ঘাটতির দোহাই দিয়ে, অবসর নিয়ে কোনোরকমে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম।

আম্পায়ারিংয়ে আমি মোটামুটি টিকে গেলাম। সিদ্ধান্ত নিলাম, বোলার যতই গলা ফাটাক, বল পায়ে লাগলে কোনো আউট নাই! এই রকম ফালতু একটা নিয়ম ক্রিকেটে কীভাবে টিকে গেল বুঝি না! বল তো পায়ে লাগবেই।

কদিন পর ক্লাব থেকে যোগাযোগ করে জানতে চাইল, আমি আম্পায়ারিং করতে পারব কি না। মাত্র একটা ম্যাচ খেলে, দুটি বল মোকাবিলা করে সরাসরি আম্পায়ারিংয়ের প্রস্তাব! শুনে আমি থ। যাহোক, হয়ে গেলাম আম্পায়ার।

নিজ দেশে বছর কয়েক বছর শিক্ষকতা করে ব্যাপারটা এমন হয়েছে যে আশপাশে আর ভাই, কাকা, মামা ডাক শোনা যায় না। উঠতে-বসতে-চড়তে-নড়তে চারপাশে কেবল স্যার স্যার শুনতে হয়। কিন্তু দেশ ছেড়ে পশ্চিমা মুলুকে এসে তো আর এই স্যার স্যার ডাক শোনার কারবার নেই। একে আমি নিজেই ছাত্র! তার ওপর এই মুলুকে স্যার-ম্যাডামদের ডাকতে হয় সরাসরি নাম ধরে।

কিন্তু আম্পায়ার হিসেবে মাঠে গিয়ে দেখি সব খেলোয়াড় আমাকে স্যার ডাকছে! এটাই রীতি এখানে। একদম ওয়াও ফিলিং! আমিও সঙ্গে সঙ্গে দেশি স্যারদের ক্যারেক্টারে ঢুকে ফাউ ভাব ধরে ফেললাম। কিন্তু এই ওয়াও ফিলিং বেশিক্ষণ টিকল না। কারণ, ক্লাসের স্যার যা বলে তা-ই সঠিক, পোলাপাইন তেমন তর্ক করে না। অবশ্য তর্ক করবে কী, ওরা তো কথা তেমন শোনেই না!

কিন্তু ‘মাঠের স্যার’ হওয়ার বড় বিপদ আছে। এলবিডব্লিউর আবেদনে আঙুল তুলে দিলে ব্যাটসম্যান, আর না দিলে বোলার, কেউ না কেউ প্রায় সঙ্গে সঙ্গে সাকিব আল হাসান হয়ে যায়! তাতে অবশ্য আমি দমে যাওয়ার পাত্র নই। ক্রিকেট থেকে সহজে আমি অবসরে চলে গেছি ঠিক। কিন্তু আম্পায়ারিংয়ে অনেক পথ যাব, এই স্বপ্ন নিয়েই মাঠে নেমেছি।

আম্পায়ারিং ব্যাপারটাও অত সোজা নয়। একে তো ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। আবার ব্যাটসম্যানদের সোজা শট থেকে নিজেকে বাঁচাতে সব সময় সজাগ থাকতে হয়। তার ওপর খেয়াল করলাম, খেলোয়াড়েরা আমাকে প্রায়ই বাসার আলনার হ্যাঙ্গারের মতো ব্যবহার করছে। তাদের ক্যাপ, সোয়েটার, রোদচশমা, যে যার খেয়ালখুশিমতো আমাকে ধরিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। তাতে একটা সুবিধা হয় আমার। মাঠে যে বাতাস, জামাকাপড়ের ওজনে কোনোরকমে টিকে থাকতে পারি। নইলে বাতাসে কবে উড়ায় নিয়ে যেত, কে জানে!

জনপ্রিয়তাটা বেশ উপভোগ করছিলাম। কিন্তু গরিবের সুখ বেশি দিন টিকল না। ছাত্র ভিসায় এ দেশে আসায় আমার কাজ করার ওপর বিধিনিষেধ আছে।

আম্পায়ারিংয়ে আমি মোটামুটি টিকে গেলাম। সিদ্ধান্ত নিলাম, বোলার যতই গলা ফাটাক, বল পায়ে লাগলে কোনো আউট নাই! এই রকম ফালতু একটা নিয়ম ক্রিকেটে কীভাবে টিকে গেল বুঝি না! বল তো পায়ে লাগবেই। বড়জোর একটা নো বল দেওয়া যায়, তাই বলে আউট! এলবিডব্লিউ না দেওয়ায় ক্রমেই আমার নাম ছড়িয়ে গেল। আমাকে দেখলেই ব্যাটসম্যানরা রীতিমতো চার পা নিয়ে ক্রিজে নামতে শুরু করল! দেখা গেল, ইচ্ছা করেই তারা বল পায়ে লাগাচ্ছে।

জনপ্রিয়তাটা বেশ উপভোগ করছিলাম। কিন্তু গরিবের সুখ বেশি দিন টিকল না। ছাত্র ভিসায় এ দেশে আসায় আমার কাজ করার ওপর বিধিনিষেধ আছে। তো একদিন ট্রেনে করে যাচ্ছিলাম, সঙ্গে আমার সুপারভাইজারও। ট্রেনে এক বাঙালি খেলোয়াড়ের সঙ্গে দেখা। সে আবার আমাকে ‘স্যার’ সম্বোধন করে বাংলায় কথা বলছিল। আমাদের দেশে যে শিক্ষকদের ‘স্যার’ ডাকা হয়, এ গল্প আমি নিজেই আমার সুপারভাইজারকে আগে বলেছি। আমাদের আলাপ না বুঝলেও ‘স্যার’ ডাক তো সে শুনেছে ঠিকই।

সে কী বুঝেছে, কে জানে! কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার ট্যাক্স অফিস আমাকে চিঠি দিয়েছে কর ফাঁকি দেওয়ার জন্য। আমি নাকি না জানিয়ে গোপনে কোথায় স্টুডেন্ট পড়াচ্ছি! একটা তদন্ত কমিটিও করা হয়েছে! কত শর্ষেতে কত তেল হয়, সে হিসাব এখনো বাকি হয়তো।