জার্মান বিজ্ঞানী উইলহেম রন্টজেন একটা বায়ুশূন্য টিউব নিয়ে গবেষণা করছিলেন। টিউবটি থেকে যেন আলো বের হতে না পারে এ জন্য তিনি সেটার চারদিকে কালো কার্ডবোর্ড দিয়ে ঢেকে দেন। টিউবটির মধ্য দিয়ে বিদ্যুৎপ্রবাহ চালানোর সময় তিনি খেয়াল করেন দেয়ালে রাখা একটি বেরিয়াম প্লাটিনো-সায়ানাইড পর্দায় অদ্ভুত একটা কালো দাগ পড়েছে। এ রকম দাগ পর্দার ওপর শুধু আলো পড়লে সৃষ্টি হতে পারে। কালো কার্ডবোর্ড দিয়ে ঢাকা টিউব থেকে আলো বেরিয়ে আসার কোনো উপায় ছিল না। তাই তিনি আলোর উৎস খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন।
কয়েকদিন ধরে বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পর রন্টজেন নিশ্চিত হন টিউবটির ভেতর থেকেই কোনো একটা অদৃশ্য আলো বেরিয়ে আসছে। একদিন তিনি তাঁর স্ত্রীকে ডাকলেন। স্ত্রীকে বললেন পর্দার সামনে হাত মেলে ধরতে। তখন তাঁর স্ত্রীর হাতে বিয়ের আংটি পরা ছিল। টিউবের মধ্যে বিদ্যুৎ প্রবাহিত করে তিনি দেখতে পেলেন পর্দায় তাঁর স্ত্রীর হাতের হাড়ের ছবি ভেসে উঠেছে এবং বিয়ের আংটির স্থানে কালো রঙের ছায়া দেখা যাচ্ছে। উইলহেম বুঝতে পারলেন, তিনি একটা গুরুত্বপূর্ণ রশ্মি আবিষ্কার করে ফেলেছেন। অজ্ঞাত রশ্মিটির নাম তিনি দিলেন ‘এক্স-রে’।
১৮৯৫ সালের ৮ নভেম্বর যখন উইলহেম নিজের অজান্তে এক্স-রে আবিষ্কার করেন, তখন পদার্থবিজ্ঞানের অনেক মৌলিক বিষয়ও আবিষ্কৃত হয়নি। এক্স-রে আবিষ্কারের তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে অল্প দিনের মধ্যে পদার্থবিজ্ঞানে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আবিষ্কার করা হয়। বলা যায় এক্স-রে আবিষ্কারের ওপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে গেছে পুরো বিংশ শতাব্দীর পদার্থবিজ্ঞান।
এক্স-রে একটা অতি-উচ্চ কম্পাঙ্কের তড়িৎচুম্বক তরঙ্গ। এর তরঙ্গদৈর্ঘ্য কম হলেও শক্তি অত্যন্ত বেশি। এক্স-রের তরঙ্গদৈর্ঘ্য সর্বোচ্চ ১০ ন্যানোমিটার, অর্থাৎ এটার সর্বোচ্চ তরঙ্গদৈর্ঘ্য ১ মিটারের ১০ কোটি ভাগের এক ভাগ। তরঙ্গদৈর্ঘ্য ছোট হওয়ায় এক্স-রে অদৃশ্য থাকে। তরঙ্গদৈর্ঘ্য যত কম হয় তার পদার্থ ভেদ করার ক্ষমতা তত বেশি। এক্স-রে আমাদের শরীর বা কম ঘনত্বের কোনো পদার্থ ভেদ করে প্রবাহিত হতে সক্ষম হলেও হাড় বা উচ্চ-ঘনত্বের পদার্থ দ্বারা প্রতিহত হয়। এক্স-রে কোনো চার্জ বহন করে না। ফলে কোনো ধরনের তড়িৎক্ষেত্র বা চৌম্বকক্ষেত্রে বাধা পড়ে না। এক্স-রে সাধারণ আলোর মতো প্রতিফলিত বা প্রতিসৃতও হয় না। বায়ুশূন্য টিউবের দুই প্রান্তে অত্যন্ত উচ্চ ভোল্টেজের বিদ্যুৎপ্রবাহ চালনা করার মাধ্যমে এক্স-রে উৎপন্ন করা হয়।
এক্স-রে থেকে ক্ষতিকর তেজস্ক্রিয় বিকিরণ ঘটে। এই বিকিরণ যেন ছড়িয়ে না পড়ে সেজন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হয়। টিউব থেকে উৎপন্ন এক্স-রে মানুষের শরীর বা কম ঘনত্বের কোনো পদার্থের একদিক দিয়ে প্রবেশ করে অন্যদিক দিয়ে বের হয়ে যায়। বের হয়ে যাওয়া রশ্মিগুলো থেকে রেডিওগ্রাফ বা চিত্র তৈরি করা হয়। এক্স-রে মানুষ বা কোনো পদার্থের ভেতর দিয়ে আসার সময় কিছু অংশ পদার্থটি দ্বারা শোষিত হয়। কী পরিমাণ শোষিত হয়েছে তার হিসেব থেকেই পদার্থটির চিত্র তৈরি করা হয়। এই প্রক্রিয়াটি এক সেকেন্ডেরও কম সময়ের মধ্যে সম্পন্ন হয়।
এক্স-রে আবিষ্কৃত হওয়ায় সবচেয়ে বেশি উপকৃত হয়েছে চিকিৎসাবিজ্ঞান। রোগনির্ণয়ের ক্ষেত্রে এক্স-রে যুগান্তকারী পরিবর্তনে এনেছে। প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে এক্স-রের ব্যবহারের ক্ষেত্রও বাড়ছে। সব ধরনের এক্স-রে উৎপন্ন হওয়ার মূলনীতি এক হলেও একেক কাজের জন্য একেকভাবে এক্স-রে উৎপন্ন করা হয়। ১৮৯৫ সালে বিজ্ঞানী উইলহেম যেভাবে বায়ুশূন্য টিউবে বিদ্যুৎপ্রবাহের মাধ্যমে এক্স-রে উৎপন্ন করেন, ১২৭ বছর পর আজও একইভাবে এক্স-রে উৎপন্ন করা হয়।
বিজ্ঞানের উন্নতির কথা বিবেচনা করে উইলহেম এক্স-রে আবিষ্কারের মেধাস্বত্ব বিনা মূল্যে দিয়ে গেছেন। এক্স-রে আবিষ্কার করার পর তিনি বিভিন্ন পদকে ভূষিত হন। ১৯০১ সালে নোবেল পুরস্কারের প্রবর্তন হলে তিনি সে বছর পদার্থবিজ্ঞানে সর্বপ্রথম নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। শেষ বয়সে ভীষণ অর্থকষ্টে ভুগে ১৯২৩ সালে ৭৭ বছর বয়সে ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে এই মহান বিজ্ঞানীর মৃত্যু হয়।