বিড়ালটি যেভাবে বিজ্ঞানী হয়েছিল

ছবিটি চেস্টারের নয়, তবে সে ছিল ছবির সিয়ামিজ বিড়ালটির মতোই
ছবি: পিক্সাবে

কার কার পোষা বিড়াল আছে, হাত তুলুন। এক... দুই... তিন... ও বাবা, সংখ্যাটা দেখছি নেহাত কম নয়! আচ্ছা, এবার বলুন, আপনার পোষা বিড়ালটি কোন কাজের কাজি? সুযোগ পেলেই বেঘোরে ঘুমাতে যে পারে, তা অবশ্য জানি। এটাও জানি, কারও কারও বিড়াল টিভি দেখে, গান শোনে, বৃষ্টি দেখে উদাস হয়। কারওটা হয়তো ইঁদুরও ধরে ফেলে পালোয়ানের মতো। তবে একটা বিড়ালের কথা জানি, যে পদার্থবিজ্ঞানের জটিল গবেষণাপত্র লিখে বিখ্যাত বনে গিয়েছিল! মানে পুরোদস্তুর বিজ্ঞানী যাকে বলে। আমি কিন্তু মোটেও আষাঢ়ে গল্প ফাঁদছি না। বিশ্বাস না হলে পুরো লেখাটা পড়ুন।

সর্বনামের ভুলে

১৯৭৫ সালের কথা। যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটিতে পদার্থ ও জ্যোতির্বিজ্ঞান বিভাগে অধ্যাপনা করেন জ্যাক এইচ হেথারিংটন। পাশাপাশি বেশ কিছু বছর ধরে বিভিন্ন তাপমাত্রায় পরমাণুর আচরণ নিয়ে গবেষণাও চালাচ্ছিলেন। কী, ব্যাপারটা খুব খটমটে হয়ে যাচ্ছে?

আচ্ছা তাহলে আরও সহজ করে বলি, পদার্থবিজ্ঞানের জটিল একটা বিষয় নিয়ে গবেষণা করছিলেন হেথারিংটন।

নিয়ম হলো, গবেষণা সফলভাবে শেষ হলে ফলাফলসহ পুরো বিষয়টা লিখে ফেলতে হয়। একেই বলে গবেষণাপত্র। পরে তা জুতসই কোনো জার্নাল বা সাময়িকীতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেখানে আরও অনেক বিজ্ঞানী ও গবেষক সেটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়েন। সবকিছু যাচাই–বাছাই করে দেখেন। শেষমেশ সন্তুষ্ট হলে গবেষণাপত্রটি ছাপা হয় ওই জার্নালে। বিজ্ঞানীমহল জানতে পারে নতুন কোনো তত্ত্ব বা তথ্য।

যেটা বলছিলাম, গবেষণা শেষে বেশ খাটাখাটনি করে গবেষণাপত্র লিখে ফেললেন হেথারিংটন। তারপর পাঠিয়ে দিলেন ফিজিক্যাল রিভিউ জার্নালে। সেখানে হেথারিংটনেরই এক সহকর্মীর চোখে বিষয়টা প্রথম নজরে আসে। বিষয় হলো, হেথারিংটন পুরো গবেষণাপত্রই লিখেছেন ‘আমরা’ সর্বনাম ব্যবহার করে। যেখানে লেখার কথা, ‘কাজটা আমি এভাবে করেছি ’, সেখানে তিনি লিখেছেন ‘কাজটা আমরা এভাবে করেছি’। পড়লে মনে হয়, হেথারিংটন একা নন, একাধিক জন মিলে গবেষণাটা করেছেন। কিন্তু গবেষণাপত্রের লেখক হিসেবে আছে শুধু হেথারিংটনের নাম। আর সত্যিই তো, গবেষণা তিনি একাই করেছেন। তাহলে লেখায় ‘আমরা’ এল কী করে?

চেস্টার যেভাবে গবেষক

কোথাও একটা গন্ডগোল হয়েছে ধরেই ফিজিক্যাল রিভিউর পক্ষ থেকে দুটি সমাধানের প্রস্তাব এল। হেথারিংটনকে বলা হলো, হয় আপনি পুরোটাই নতুন করে লিখে পাঠান, নয়তো দ্বিতীয় গবেষকের নাম যোগ করুন।

হেথারিংটন পড়লেন বিপাকে। মনে রেখো, ঘটনাটা সত্তরের দশকের। তখন না ছিল কম্পিউটার, না ইন্টারনেট। মোটাসোটা গবেষণাপত্রের পুরোটাই হেথারিংটন লিখেছিলেন টাইপরাইটারে। পুরোটা আবার লিখতে যাওয়া মানে সময়ের ভীষণ অপচয়। আর দ্বিতীয় প্রস্তাবটিও মনে মনে নাকচ করে দিলেন তিনি। কারণ, কে চায় নিজের মেহনতের ফল অন্যকে দিতে? কেবল নামই তো নয়, টাকাপয়সার ব্যাপারটাও এখানে গুরুত্বপূর্ণ। তাই পুরো একটা বিকেল ভেবেটেবে হেথারিংটন ঠিক করলেন, গবেষণাপত্রের সহলেখক হিসেবে চেস্টারের নাম জুড়ে দেবেন। তা এই চেস্টারটা আবার কে? হেথারিংটনের পোষা সিয়ামিজ বিড়াল!

গবেষণাপত্রের ওপরে ডান দিকে এফ ডি সি উইলার্ডের ‘স্বাক্ষর’
ছবি: সংগৃহীত

কিন্তু স্বনামধন্য একটা জার্নালের গবেষণাপত্রে লেখক হিসেবে শুধু ‘চেস্টার’ তো আর দেওয়া যায় না। চাই সুন্দর একটা নাম। এ কারণে হেথারিংটন চেস্টারের পুরো নাম দিলেন এফ ডি সি উইলার্ড। এখানে ‘এফ’ ও ‘ডি’র পূর্ণরূপ হলো ফেলিস ডমেস্টিকাস (বিড়ালের বৈজ্ঞানিক নাম)। আর ‘সি’ হলো চেস্টার এবং উইলার্ড ছিল চেস্টারের বাবা। ব্যস, নামটা লিখে সহলেখককে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সহকর্মী হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিলেন হেথারিংটন।

গবেষণাপত্রটি পুনরায় পাঠালে সাদর গ্রহণ করল ফিজিক্যাল রিভিউ। প্রকাশিতও হয়ে গেল ১৯৭৫ সালের নভেম্বরে। নভেম্বরেরই শেষ দিকে মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটির পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ট্রুম্যান উডরাফ একটা চিঠি পাঠালেন। চিঠিতে অনেক প্রশংসা করেটরে উইলার্ডকে সোজা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর প্রস্তাবও দিয়ে ফেললেন তিনি! ‘বিশিষ্ট বিজ্ঞানী’ এফ ডি সি উইলার্ড হয়তো প্রস্তাবটা পাত্তাই দেননি!

থলের বিড়াল বেরিয়ে এল

সব ঠিকঠাকই চলছিল। কিন্তু মুশকিল বাধল, হেথারিংটনের এক সহকর্মী যেদিন উইলার্ডের সঙ্গে কথা বলতে চাইলেন। এক সাক্ষাৎকারে হেথারিংটন বলেছিলেন, ‘একদিন এক সহকর্মী আমার সঙ্গে কথা বলতে চাইলেন। কিন্তু সে সময় আমি বাসায় ছিলাম না, তাই তিনি উইলার্ডের সঙ্গেই কথা বলতে চাইলেন। ফলে খুব দ্রুতই থলের বিড়ালটা বেরিয়ে এল এবং সবাই তুমুল মজাও পেল।’

১৯৭৮ সালে সাধারণ মানুষও ব্যাপারটা জেনে ফেলল। সে বছর ফ্রান্সে এক বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে ‘স্বয়ং প্রফেসর’ এফ ডি সি উইলার্ডের ডাক পড়ল! বেশ কিছু কাগজপত্রও পাঠানো হলো, যেখানে তার স্বাক্ষর দরকার। এবারও হেথারিংটন রসিকতা করতে ছাড়লেন না! নিজের স্বাক্ষরটা করে চেস্টারের পায়ে কালি মেখে দিলেন। তারপর পায়ের ছাপ দিয়ে দিলেন এফ ডি সি উইলার্ডের জন্য নির্ধারিত স্বাক্ষরের জায়গায়! এমন বিচিত্র স্বাক্ষর দেখে সম্মেলনের লোকজনও বুঝে ফেলল আসল ঘটনা কী।

শেষমেশ কী হলো

সহলেখক হিসেবে পোষা বিড়ালের নাম দিয়ে মোটেও অনুতপ্ত বা বিব্রত নন হেথারিংটন। একবার বলেছিলেন, এই অস্বাভাবিক লেখকের ব্যাপারটা জানাজানি হওয়ার পরও মানুষ গবেষণাপত্রটিকেই বেশি মনে রাখবে।

শুধু ওই একবারই নয়, আরও একবার গবেষণাপত্রের লেখক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল চেস্টার। সেটা ১৯৮০ সালের কথা। সেবার ফরাসি ও মার্কিন গবেষকেরা একই বিষয়ে গবেষণা করেছিলেন। হেথারিংটনও ছিলেন ওই দলে। কিন্তু শেষতক গবেষণার ফল নিয়ে তাঁর ছিল বেজায় অসন্তুষ্টি। তাই তিনি প্রস্তাব দিয়েছিলেন, ‘মনে খচখচানি থেকে যাওয়া একটা গবেষণাপত্রে আমাদের সবার নাম রাখার কী দরকার! আসুন, এর বদলে লেখকের নাম হিসেবে এফ ডি সি উইলার্ডই জুড়ে দিই। পরে ভুলচুক ধরা পড়লেও আমাদের আর দায় থাকবে না।’

ব্যস, প্রস্তাবটা লুফে নিলেন বাকি গবেষকেরা এবং তা প্রকাশিত হলো বিখ্যাত এক ফরাসি জার্নালে। আর এভাবেই প্রথম বিড়াল হিসেবে একক গবেষণাপত্রের লেখক হিসেবেও নাম লিখিয়ে ফেলল চেস্টার!

চেষ্টা ছাড়াই বিজ্ঞানী বনে যাওয়া চেস্টার আজ আর বেঁচে নেই। ১৯৮২ সালে আনুমানিক ১৪ বছর বয়সে চিরবিদায় নিয়েছে সে। ৩৫ বছর শিক্ষকতা করে ইমেরিটাস অধ্যাপক হিসেবে অবসরে গেছেন হেথারিংটন। তবে এখনো গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। প্রিয় বিড়াল চেস্টার কিংবা সহগবেষক এফ ডি সি উইলার্ডকে নিশ্চয়ই মিস করেন তিনি!

সূত্র: সায়েন্স ডটওআরজি