অনেক অনেক অনেক অনেক দিন আগে গোপাল ভাঁড় একবার বাজি ধরে ইলিশ কিনতে গিয়েছিল। বাজির শর্ত অনুযায়ী ইলিশের দাম যেন কেউ জিজ্ঞেস না করে, সে জন্য গোপাল ভাঁড় পরনের ধুতি খুলে মাথায় বেঁধেছিল পর্যন্ত। সে অবস্থায় দেখে গোপাল ভাঁড়কে কেউ আর ইলিশের দাম জিজ্ঞেস করেনি আর গোপাল ভাঁড়ও বাজি জিতেছিল বেশ বড় অঙ্কের।
কিন্তু দিন বদলে গেছে। এখন আর গোপালের সঙ্গে তেমন কেউ বাজিও লাগে না, আর গোপালের আয়–রোজগারও গেছে কমে। আয়–রোজগার কমে গেলে কী হবে, ইলিশের প্রতি টানটা তার ঠিক টনটনে আছে। একবার নদীতে ঝাঁকে ঝাঁকে জাটকার বদলে ইলিশ পাওয়া যাচ্ছিল। দামও কমে গিয়েছিল হু হু করে। গোপালের মনে হলো, এই সুযোগ। এবারই এক জোড়া ইলিশ কিনে গিন্নিকে চমকে দেবে।
গোপাল ছুটল মাছবাজারে। কিন্তু পথিমধ্যেই দেখা হয়ে গেল সেই লোকের সঙ্গে, যে অনেক অনেক অনেক অনেক দিন আগে গোপালের সঙ্গে ইলিশ নিয়ে বাজি ধরেছিল। সে বলল, ‘কী হে গোপাল, যাও কোথায়?’
: এই তো বাজারে।
: বাজারে? তা মাছবাজারেই নাকি?
: হ্যাঁ, ওই ভাবলাম দুইটা ইলিশ কিনে আনি। দামও সস্তা!
: হ্যাঁ, খুব সস্তা। এত সস্তা যে এক জোড়া কেন, এক হালি ইলিশ কিনে ঝুলিয়ে ঝুলিয়ে নিয়ে গেলেও কেউ দাম জানতে চাইবে না!
: না না, তা নিশ্চয়ই চাইবে!
: উঁহু, চাইবে না। বাজি?
: ঠিক আছে, আমার কাছে দাম জানতে চাইলে কী দেবে?
: ৫০০ ইলিশের দাম। আর যদি না জিজ্ঞেস করে, তাহলে কিন্তু তোমাকে মুখে চুনকালি মাখতে হবে।
: ঠিক আছে।
গোপাল ৫০০ টাকায় এক জোড়া বেশ বড়সড় ইলিশ কিনে বাজার থেকে বেরিয়ে এল। হাতে ঝুলিয়ে পথচারীদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য দোলাতে থাকল বেশ কায়দা করে। কিন্তু গত কদিনে ইলিশ কেনা এতই স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে গেছে যে পথচারীদের কেউ ফিরেও তাকাল না। গোপাল আরও জোরে মাছ দোলাতে লাগল, কিন্তু তার দিকে দু-একজন তাকালেও ইলিশের দিকে একজনও নয়। গোপাল খুবই বিস্মিত।
ইলিশ কেনা হয়েছে, অথচ কেউ তাকাচ্ছে না! এই কি তবে বঙ্গদেশ? বাজিতে কি তাহলে হেরে যাবে সে? একটা-দুইটা না, ৫০০ ইলিশের দাম! উফ্! অবশ্য গোপাল দমে যাওয়ার পাত্র নয়। চলতি পথেই এক পরিচিতজনকে পেয়ে সে দাঁড় করাল।
: হে হে হে। কোথায় যাচ্ছেন?
: এই তো বাজারের দিকে।
: আচ্ছা আচ্ছা। আমিও বাজার থেকে এলাম। এই যে এক জোড়া ইলিশ কিনলাম।
: ও ইলিশ? ইলিশ আর কত খাব? দেখি, সবজি পাই কি না!
: খুব সস্তায় পেলাম তো। খুব সস্তা!
: দাম তো সস্তাই ইলিশের। এ আর নতুন কী?
পরিচিতজন চলে গেল। গোপাল ভাঁড় মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকল কিছুক্ষণ। বাজি বোধ হয় হেরেই যাচ্ছে সে। ইলিশের দাম নিয়ে দেখা যাচ্ছে কারও কোনো আগ্রহই নেই।
আরেকটু এগোতেই এক প্রতিবেশীর দেখা পেল গোপাল। দূর থেকে দেখেই ওই প্রতিবেশী বলল, ‘কী গোপাল, ইলিশ কিনলে নাকি?’
খুব খুশি হলো গোপাল ভাঁড়। যাক, একজন পাওয়া গেল যে ইলিশ নিয়ে আগ্রহী। দামও নিশ্চয়ই জানতে চাইবে। গোপাল পড়িমরি করে ছুটে গেল তার সামনে।
: হ্যাঁ, এই যে ইলিশ। এক জোড়া! কিনে ফেললাম সস্তা পেয়ে।
: তোমাদের এই এক সমস্যা। সস্তা কিছু পেলে আর মাথা ঠিক থাকে না। জানো না, সস্তার তিন অবস্থা? সস্তা পেয়ে গাপুসগুপুস ইলিশ খাবে আর দু-পাঁচ বছরের ইলিশ না-খাওয়া পেটটা খারাপ করে ছাড়বে। ওই পেট ঠিক করতে কত টাকার ওষুধ খেতে হবে, জানো? শোনো, সবার পেটে ইলিশ সয় না!
: হ্যাঁ, তা তো ঠিকই, তা তো ঠিকই। তবে দামে এত সস্তা যে লোভ সামলাতে পারলাম না...
: লোভে পাপ আর পাপে ইলিশ, গোপাল! ইলিশও ওই রকম লোভ করে মিঠা পানিতে এসে ধরা খায়। তুমিও ধরা খেয়েছ! আর খবরদার, আমার ফ্রিজে ওই ইলিশ কিন্তু রাখতে আসবে না, বুঝেছ?
গোপাল বলল, ‘না রে ভাই, পাগল হই নাই। কিন্তু ইলিশ বিক্রেতার কথামতো কেন যে কাজ হচ্ছে না, সেটা বোঝার চেষ্টা করছি!’
: কী বলেছিল সে?
: বলেছিল, এই মাছ দুইটা নাকি ভবিষ্যৎ বলতে পারে। দুইটা ইলিশকে একসঙ্গে ঘষা দিলেই নাকি কথা বলে ওঠে। আর বলে দেয়, কার কী ভবিষ্যৎ!
প্রতিবেশী গজগজ করতে করতে চলে গেল। গোপাল বুঝল, জীবনে এই প্রথম সে বাজি হারতে বসেছে। মুখে চুনকালি মাখার জন্য সে প্রস্তুতি নিয়ে ফেলল। তবে তার আগে শেষ চিকিৎসা হিসেবে সে দাঁড়িয়ে পড়ল মাঝ রাস্তায়। তারপরেই হাতের ইলিশ দুটো একটার সঙ্গে আরেকটার গায়ে ঘষতে শুরু করল। গোপাল ভাঁড়ের কাণ্ড দেখে লোক জমে গেল একেবারে।
: আরে, কী করেন?
গোপাল নিরুত্তর। সে ইলিশ ঘষেই যাচ্ছে। লোক আরও জড়ো হলো। সবার মুখেই এক প্রশ্ন, ‘লোকটা করছেটা কী?’
একজন তো বলেই বসল, ‘ইলিশ কিনে বোধ হয় পাগলই হয়ে গেছে গোপাল।’
গোপাল বলল, ‘না রে ভাই, পাগল হই নাই। কিন্তু ইলিশ বিক্রেতার কথামতো কেন যে কাজ হচ্ছে না, সেটা বোঝার চেষ্টা করছি!’
: কী বলেছিল সে?
: বলেছিল, এই মাছ দুইটা নাকি ভবিষ্যৎ বলতে পারে। দুইটা ইলিশকে একসঙ্গে ঘষা দিলেই নাকি কথা বলে ওঠে। আর বলে দেয়, কার কী ভবিষ্যৎ!
: দূর! তা হয় নাকি? তুমিও খুব বোকা তো!
: কী জানি, ভাই, কিছুই বুঝতে পারছি না। এদিকে দামও তো নিল ম্যালা!
: কত দাম?
গোপাল কিছু না বলেই হাঁটতে শুরু করল। লোকগুলোও হাঁটতে লাগল তার পিছু পিছু।
: আরে আরে, বলছ না কেন কত দাম নিল? কত দামে তোমাকে ঠকাল, শুনি?
গোপাল ভাঁড় কিছুই না বলে জোর কদমে হাঁটতে থাকল। তাদের একমাত্র আগ্রহ, গোপাল ভাঁড় কত টাকা ঠকেছে তা জানা!
গোপাল ভাঁড় ততক্ষণে বাজি ধরা লোকটার কাছে পৌঁছে গেছে। তার পেছনের লোকগুলোকে ইলিশের দাম জিজ্ঞেস করতে দেখে সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চলতি বাজারদরে ৫০০ ইলিশের দাম কত, তা হিসাব করতে শুরু করল।