সাস্টিয়ান, তোমরা কোন কথা কও?

জানা গেছে, ছোটবেলা থেকে কবিতার প্রতি তাঁর দারুণ ঝোঁক। এত দিন নানান ব্যস্ততায় কবিতাচর্চার সুযোগ হয়ে ওঠেনি। সম্প্রতি ঘরবন্দী কটা দিন কেটেছে তাঁর। অখণ্ড অবসরে তিনি কী কবিতা লিখলেন ডায়েরির পাতায় পাতায়? হয়তো লেখেননি। কিংবা লিখেছেন! হয়তো লিখতে বসলেই তাঁর বড্ড ঘুম পেত। হয়তো কোনো কবিতাই শেষ করে উঠতে পারেননি। মোট কথা এসব কল্পনা করতে দোষ কী! কল্পনায় তাঁর সেই ডায়েরি ও কবিতার সন্ধান যখন আমরা পেয়েই গেছি, তখন পড়েই দেখুন না একবার...

১৯ জানুয়ারি

বিকেল থেকে বাসায় আছি। বাইরে শিক্ষার্থীরা শোরগোল করছে। আমাকে যেতে দেওয়া হচ্ছে না কোথাও। অখণ্ড অবসর। কোনো মিটিং নেই। ফাইল সই করার তাগাদা নেই। এই তো বেশ আছি! অনেক দিন পর জীবনানন্দের কথা মনে পড়ছে। তাঁর কবিতার কথা মনে পড়ছে।

হায় সাস্টিয়ান, সোনালি সাস্টিয়ান, এই শিশিরে ভেজা সন্ধ্যায়

তোমরা আর কেঁদো নাকো বসে বসে এই চত্বরের পাশে

তোমাদের স্লোগানের সুরে বেতের বাড়ি আর ম্লান চোখ মনে আসে...

কবিতাটা শেষ করতে পারলাম না। ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। বাইরে বেশ শীত। ছেলেমেয়েরা এখনো আছে! কী সব বাজনা বাজিয়ে গানটান গাইছে! আমার ঘর থেকে খুব বেশি শোনা যায় না। তারপরও কানে তুলা গুঁজে রেখেছি। কান আর চোখ বন্ধ রেখে কাজ করে যাওয়াই আমার দায়িত্ব। এ কারণেই আমাকে এখানে পাঠানো হয়েছে।

২৩ জানুয়ারি

আজ সন্ধ্যায় বাসার বিদ্যুৎ–সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছে। বিটকেলে ছেলেমেয়ে যতসব! বিকেল থেকে মনে হচ্ছিল, কিছু একটা লিখি। বিদ্যুৎ নেই। ‍টিভিটাও চলছে না। তাই ঘুমিয়ে ছিলাম। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল, জীবনানন্দ দাশের ‘অন্ধকার’ কবিতার কথা মনে পড়ে গেল—

গভীর অন্ধকারে ‍ঘুম থেকে স্লোগানের চ্ছল চ্ছল শব্দে জেগে উঠলাম আবার;

তাকিয়ে দেখলাম পাণ্ডুর চাঁদ বৈতরণির থেকে তার অর্ধেক ছায়া

গুটিয়ে নিয়েছে যেন

সুরমার দিকে।

বিদ্যুৎ চলে গেলে আমি শুয়েছিলাম—বিছানায়—লেপে মুড়ে

কোনো দিন আর জাগব না জেনে

কোনো দিন জাগব না আমি—কোনো দিন জাগব না আর—

হে সাস্টিয়ান, লাল–নীল সাস্টিয়ান,

তোমরা দিনের আলো নও, উদ্যম নও, স্বপ্ন নও,

হৃদয়ে যে মৃত্যুর শান্তি ও স্থিরতা রয়েছে,

রয়েছে যে অগাধ বিশ্বাস,

সে বিশ্বাস নষ্ট করবার মতো ক্ষমতা তোমাদের নেই...

জানো না কি নিশীথ,

আমি অনেক দিন—অনেক অনেক দিন

শিক্ষক–রাজনীতির সঙ্গে অনন্তের মতো মিশে থেকে

হঠাৎ ভোরের আলোয় নিজেকে প্রচণ্ড ক্ষমতাবান, প্রতাপশালী হিসেবে

আবিষ্কার করেছি আবার;

আনন্দ পেয়েছি,

দেখতে পেয়েছি অপার সম্ভাবনা;

দেখেছি রক্তিম আকাশে সূর্য জেগে উঠে

একজন ‘কর্তা’ সেজে সাস্টিয়ানদের মুখোমুখি দাঁড়াবার জন্য

আমাকে নির্দেশ দিয়েছে;

আমার সমস্ত হৃদয় হাসিতে—আনন্দে—উল্লাসে ভ’রে গিয়েছে;

সূর্যের রৌদ্রে আক্রান্ত এই পৃথিবী যেন শত শত পদলেহনকারীর উচ্ছ্বাসে

উৎসব শুরু করেছে...

আজ বেশ বড়ই লিখলাম। জীবনানন্দের বই পাশে রেখেই লিখেছি। এখন বই পাশে রেখে লিখতে হয়। এভাবে লিখতে লিখতেই কবি হয়ে উঠব আশা করি। তখন আমার কলম আর কেউ থামাতে পারবে না। অবসরের পর আমি জ্ঞান দেব—প্রতিষ্ঠান কীভাবে চালাতে হয়। প্রতিষ্ঠান চালানোর অনেক তরিকাই আমার জানা আছে। এখনো সবগুলো কাজে লাগাইনি। এই যে ছেলেমেয়েরা আন্দোলন করছে, কী লাভ? কত কত কথা বলছে আমার নামে! জীবনানন্দের ‘নদী’ কবিতার কথা মনে পড়ছে। আমার বলতে ইচ্ছে করছে—

রাইশর্ষের খেত সকালে উজ্জ্বল হলো—দুপুরে বিবর্ণ হয়ে গেল

তারই পাশে সাস্ট...

সাস্টিয়ান, তোমরা কোন কথা কও?

পুলিশের লাঠির বাড়ি তোমার পিঠের ’পরে পড়েছে যে,

শীতের রাতে তুমি নীল হলে...

...স্লোগান দেয়—স্লোগান দেয়—ক্লান্ত হয় নাকো

এই সাস্টিয়ান…

২৪ জানুয়ারি

ঘুমিয়ে ছিলাম। ‘হঠাৎ আলোর ঝলকানিতে’ ঘুম ভেঙে গেল। এখন রাত পৌনে একটা। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘আমার চিত্ত ঝলমল করিয়া উঠিল’। ছাত্ররা বিদ্যুৎ সংযোগ ফিরে দেওয়ায় মনে হচ্ছে, তারা খানিকটা নমনীয় হয়েছে। হয়তো চলে যাবে। কিন্তু এখনো যায় না কেন! বুঝতে পারছি না। আরে বাবা, আন্দোলন করছ, দোতারা বাজিয়ে গান করছ, এই তো অনেক! কিসের পদত্যাগ?

তোমরা যেখানে সাধ চলে যাও—আমি এই সুরমার পারে

রয়ে যাব; দেখিব সবাই পাততাড়ি গুটাইতেছে ভোরের বাতাসে;

ঝামেলা হলেই দেখিব, ‘ভাইয়েরা’ লাঠিসোঁটা নিয়ে আসে

সবার গোচরে শিক্ষার্থীর পিঠে–ঠ্যাংয়ে লাঠি দিয়ে মারে...

(কল্পিত ডায়েরির পরের পৃষ্ঠাগুলো আর পাওয়া যায়নি।)