রাজনীতির 'বিপজ্জনক' খেলায় রজনীকান্ত?

‘কালা’ ছবির একটি দৃশ্যে রজনীকান্ত। ছবি: সংগৃহীত
‘কালা’ ছবির একটি দৃশ্যে রজনীকান্ত। ছবি: সংগৃহীত

রুপালি পর্দায় তাঁর কাজই হচ্ছে দুষ্টুলোককে ঠেঙিয়ে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা। এই বুড়ো হাড়েও নিয়মিত খলনায়কদের উত্তম–মধ্যম দিয়ে যাচ্ছেন তিনি। কিন্তু রাজনীতির মাঠে এসেই কি একটু বেকায়দায় পড়ে গেলেন?

ভারতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি রাজ্য তামিলনাড়ু। সেখানে রুপালি পর্দার নায়ক-নায়িকাদের রাজনৈতিক মঞ্চে আসার ঐতিহ্য চালু আছে। একই চলে গা ভাসিয়েছেন কিংবদন্তি দক্ষিণী অভিনেতা রজনীকান্ত ও কমল হাসান। তবে দুজন আছেন বিপরীত মেরুতে। মোদির পক্ষ-বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে এখনো ছল করছেন রজনীকান্ত। অবশ্য ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে নিজের কঠোর অবস্থানের কথা জানিয়ে দিয়েছেন কমল হাসান।

২০১৭ সালের ডিসেম্বরে রাজনীতিতে অংশ নেওয়ার কথা জানিয়েছিলেন রজনীকান্ত। কিন্তু এখনো পর্যন্ত নিজের রাজনৈতিক দলের নামটিও ঘোষণা করেননি তিনি। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির পক্ষে থাকবেন কি না, এ বিষয়ও পরিষ্কার করছেন না ৬৭ বছর বয়সী এই অভিনেতা। রাজনৈতিক দলের ছাতার নিচে না থেকে নিজের অগণিত ভক্ত-অনুরাগীকে নিয়ে ভিন্নধর্মী একটি সংগঠন গড়ে তুলেছেন রজনীকান্ত। এর নাম হলো ‘রজনী মাক্কাল মন্দ্রম’। ইংরেজিতে দাঁড়ায় ‘রজনী পিপলস ফোরাম’। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা, চূড়ান্ত রাজনৈতিক দলের আগে পরীক্ষামূলকভাবে এই সংগঠন চালু করেছেন রজনীকান্ত। এর মধ্য দিয়েই ধীরে ধীরে রাজনীতিতে জড়াবেন তিনি।

ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে নিজের কঠোর অবস্থানের কথা জানিয়ে দিয়েছেন কমল হাসান। ছবি: এএফপি
ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে নিজের কঠোর অবস্থানের কথা জানিয়ে দিয়েছেন কমল হাসান। ছবি: এএফপি

অন্যদিকে, রজনীকান্তের একসময়ের বন্ধু কমল হাসানও রাজনীতিতে নেমেছেন, গঠন করেছেন নতুন দল। কমল অবশ্য স্পষ্ট করেই জানিয়ে দিয়েছেন, ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির পক্ষে তিনি। অর্থাৎ বিজেপির ছায়াতলে তিনি যাবেন না। আর ঠিক এই জায়গাই এড়িয়ে যাচ্ছেন রজনীকান্ত। মোদির পক্ষ নেবেন কি না, তা স্পষ্ট করছেন না তিনি। আবার বিজেপিকে ‘শক্তিশালী’ দল বলেও অভিহিত করছেন রজনীকান্ত, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির প্রশংসাও তিনি করছেন!

তামিল সিনেমার সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন হলেন রজনীকান্ত। সম্প্রতি ভারতীয় ম্যাগাজিন ইন্ডিয়া টুডেকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে রজনীকান্ত বলেছেন, ‘রাজনীতি একটি বিপজ্জনক খেলা।’ রজনীকান্তের ভাষায়, ‘রাজনীতি একটি অনেক বড় খেলা এবং খুব বিপজ্জনকও। তাই আমাকে খুব সতর্কভাবে খেলতে হবে। সঠিক সময় বেছে নেওয়াটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’

বোঝাই যাচ্ছে, রাজনীতিকে খুব হালকাভাবে নিচ্ছেন না ‘থালাইভা’। এতই যখন চিন্তা, তখন কেন রাজনীতিতে? রজনীই বললেন, ‘এর সবই ঈশ্বরের ইচ্ছা। যখন আমি ঈশ্বরের কথা বলি, এটি একটি উত্তর। এর মধ্যেই সব আছে।’

এখন ভারতের বক্স অফিসে রাজত্ব চালাচ্ছে রজনীকান্তের নতুন সায়েন্স ফিকশন ছবি ‘টু পয়েন্ট ও’। শত শত কোটি রুপির ব্যবসা করছে এই ছবি। এর আগে চলতি বছরেই আরেকটি ছবি মুক্তি পেয়েছিল তাঁর। সেটি হলো, ‘কালা’। ধুন্ধুমার ব্যবসা করেছে ছবিটি। কিন্তু এর বিষয়বস্তু তুলে দেয় নতুন আলোচনা। এই ছবিতে বস্তি টিকিয়ে রাখতে হিন্দুত্ববাদী এক রাজনৈতিক নেতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন রজনীকান্ত। ওই রাজনৈতিক নেতার চরিত্রে রূপদানকারী নানা পাটেকরের ইচ্ছা সব কালো মুছে দিয়ে ধবধবে সাদার রাজত্ব কায়েম করা। অনেকটাই নরেন্দ্র মোদির ‘স্বচ্ছ ভারত অভিযান’-এর মতো কাজকারবার। নানা পাটেকর আবার ‘অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি’র নিশ্চয়তাও দিয়েছিলেন। এখন এর সঙ্গে যদি কেউ মোদির ভারতের তুলনা করেন, তবে কি তাকে ভুল বলা যাবে?

দ্য কুইন্টে প্রকাশিত এক নিবন্ধে প্রশ্ন তোলা হয়েছে, রজনীকান্ত কি তবে বিজেপির প্রতি নিজের সহানুভূতিশীল আচরণ ঢেকে রাখতেই এই ছবি করেছেন? নাকি ‘হিন্দুত্ববাদী’ ট্যাগ মুছে ফেলার চেষ্টা করছেন? সবচেয়ে বড় কথা, এই সুপারস্টার এখনো রাজনীতিবিদ হতে পারেননি। নিজের অবস্থান নিয়ে শুধুই ধোঁয়াশা সৃষ্টি করছেন।

তামিলনাড়ুতে মেগাস্টার রজনীকান্তের ওপর ভর করে নির্বাচনী বৈতরণি পার হওয়ার চেষ্টায় আছে নরেন্দ্র মোদির দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)। ছবি: রয়টার্স
তামিলনাড়ুতে মেগাস্টার রজনীকান্তের ওপর ভর করে নির্বাচনী বৈতরণি পার হওয়ার চেষ্টায় আছে নরেন্দ্র মোদির দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)। ছবি: রয়টার্স

রজনীকান্তও বলছেন, তাঁর কাছে রাজনীতি খুবই ‘চ্যালেঞ্জিং’। সিনেমার মতো শুধু অভিনয় করলেই এখানে কাজ শেষ হয় না। বরং ছবির পরিচালক, লেখক, প্রযোজক—সব ভূমিকাতেই মাঠে নামতে হয়।

২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচন ঘিরেই এত সব খেলার অবতারণা। ফার্স্টপোস্টের বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, রজনীকান্তের সঙ্গে রাজনৈতিক দর্শনের দিক থেকে বেজায় অমিল কমল হাসানের। কমলের অভিযোগ, রজনীর রাজনৈতিক দর্শনে ‘গেরুয়া বসনের’ প্রভাব প্রচণ্ড। অর্থাৎ কিছুটা ধর্মভাবাপন্ন। কমল বলেছেন, ‘তাঁর এই ধারার পরিবর্তন না হলে আমাদের জোট হবে না। আমরা ভালো বন্ধু, কিন্তু রাজনীতি আলাদা বিষয়।’ কোনো ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির সঙ্গে থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন তিনি।

অন্যদিকে, ধর্মনিরপেক্ষতাকে ভারতের ‘সৌন্দর্য’ বলে অভিহিত করছেন রজনীকান্তও। কিন্তু অযোধ্যা বা বাবরি মসজিদ নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে চান না তিনি। রজনীর মতে, বছরের পর বছর ধরে চলে আসা ঐতিহ্যের ধারায় আদালতের হস্তক্ষেপ করা উচিত নয়। শবরীমালা মন্দিরে নারীদের প্রবেশাধিকার নিয়ে আদালতের আদেশের বিষয়ে সম্প্রতি তিনি এ কথা বলেছেন।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, জয়ললিতার মৃত্যুর পরই তামিলনাড়ুর রাজনৈতিক নেতৃত্বে শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে। আর সেটিই পূরণ করতে চাইছেন রজনীকান্ত ও কমল হাসান। আর রজনীর ওপর ভর করে নির্বাচনী বৈতরণি পার হওয়ার চেষ্টায় আছে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)। রাজনীতিতে আসার ঘোষণা দেওয়ার পরই রজনীকান্তকে অভিনন্দন জানিয়েছিল রাজ্য বিজেপি। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের খবরে প্রকাশ, আগামী বছরের লোকসভা নির্বাচনে রজনীকান্তের সমর্থন চায় দলটি। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগেও নরেন্দ্র মোদি দেখা করেছিলেন রজনীকান্তের সঙ্গে। তখন অবশ্য দুই পক্ষই একে ‘সৌজন্য সাক্ষাৎ’ বলে চালিয়ে দিয়েছিল।

২০১৭ সালের ডিসেম্বরে রাজনীতিতে অংশ নেওয়ার কথা জানিয়েছিলেন রজনীকান্ত। কিন্তু এখনো পর্যন্ত নিজের রাজনৈতিক দলের নামটিও ঘোষণা করেননি তিনি। ছবি: এএফপি
২০১৭ সালের ডিসেম্বরে রাজনীতিতে অংশ নেওয়ার কথা জানিয়েছিলেন রজনীকান্ত। কিন্তু এখনো পর্যন্ত নিজের রাজনৈতিক দলের নামটিও ঘোষণা করেননি তিনি। ছবি: এএফপি

দুর্নীতি নির্মূলের ঘোষণা দিয়ে তামিলনাড়ুতে ভোট দখলের চেষ্টা করছে বিজেপি। দলটির দাবি, তামিলনাড়ুর কিছু জনপ্রিয় ব্যক্তি নাকি তাদের সঙ্গে আছে। ভারতীয় রাজনৈতিক বিশ্লেষক টি এস সুধীর বলছেন, ‘তামিলনাড়ুতে জিততে হলে বিজেপির একমাত্র পথ হলো রজনীকান্তকে ব্যবহার করা। ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী কমলকে কাজে লাগাতে পারবে না মোদির দল। তাই তারা রজনীকান্তকে বাগে আনার চেষ্টা করছে।’ এরই মধ্যে কিন্তু বিজেপির পক্ষে আসার জন্য রজনীকান্তের প্রতি আহ্বানও জানানো হয়েছে।

দুর্নীতির বিরুদ্ধে রজনীকান্তও নিয়েছেন ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি। মোদি সম্পর্কে রজনীর মন্তব্য, ‘তিনি জাতির জন্য সত্যিই ভালো কিছু করতে চান। তিনি সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন।’ তাহলে কি দুই পক্ষ কাছাকাছি চলে এসেছে? নিন্দুকেরা বলছেন, অন্তত কথাবার্তায় তারই আভাস পাওয়া যাচ্ছে।

শত শত সিনেমায় অভিনয় করেছেন রজনীকান্ত। তাঁর একটি সংলাপ ভক্তদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয়। এটি হলো ‘কীভাবে বা কখন কী করব, তা আমি কখনোই তোমাকে বলব না। যখন করব, তখনই বুঝতে পারবে।’ খলনায়কদের নাস্তানাবুদ করতে বলা এই সংলাপের মতো করেই কি রাজনৈতিক ঘুঁটি চালাবেন রজনীকান্ত? সময়ই এর উত্তর দেবে। তবে এর আগে রজনীকান্তের নিশ্চিত হতে হবে, এই খেলার চিত্রনাট্য তাঁর জানা আছে তো!