শ্বেতহস্তী হয়ে উঠছে টোকিওর অলিম্পিক আয়োজন

জাপানের নতুন জাতীয় স্টেডিয়াম চালু করা হয়েছে। ছবি: রয়টার্স
জাপানের নতুন জাতীয় স্টেডিয়াম চালু করা হয়েছে। ছবি: রয়টার্স

অলিম্পিকের আয়োজনকে ঘিরে স্বাগতিক শহর টোকিও নতুন যেসব নির্মাণ প্রকল্প হাতে নেয়, সেগুলোর মধ্যে কোনটি সুনির্দিষ্টভাবে অলিম্পিকের জন্য এবং কোনটি শহরের সার্বিক অবকাঠামো উন্নয়নের সঙ্গে সম্পর্কিত, সেই হিসাব হচ্ছে খুবই গোলমেলে। অলিম্পিকের আয়োজক কমিটি খরচের হিসাব কম করে দেখানোর জন্য নির্মাণ প্রকল্পের মধ্যে বেশ কয়েকটিকে অলিম্পিকের খরচের তালিকা থেকে বাদ দিতে প্রয়াসী।

অন্যদিকে যে দেশে অলিম্পিকের আয়োজন বসছে, সেই দেশটির হিসাবরক্ষণ দপ্তর খরচের হিসাব গণনা করে অন্য দিক থেকে। অলিম্পিক-পরবর্তী নাগরিক সুযোগ-সুবিধা উন্নত হয়ে আসার ব্যাখ্যা আয়োজক কমিটি দিলেও হিসাবরক্ষণ দপ্তরের মতে, অলিম্পিকের আয়োজন শহরে না বসলে সেই সব কাঠামো আদৌ নির্মাণ করা হতো কি না, সেই প্রশ্ন থেকে যাওয়ায় সব রকম খরচাপাতিকেই অলিম্পিকের ব্যয় হিসেবে ধরে নেওয়া হচ্ছে হিসাবরক্ষণ বিভাগের অনুসৃত নীতি। টোকিওর ২০২০ সালের অলিম্পিক প্রস্তুতির বেলাতেও এই বিতর্কের কোনো রদবদল ঘটেনি।

টোকিও অলিম্পিকের আয়োজক কমিটি গত সপ্তাহে বলেছিল, গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজনে আনুমানিক ১ হাজার ২৬০ কোটি ডলার কমিটি খরচ করছে; খরচের যে হিসাব হচ্ছে, তা এক বছর আগে দেওয়া হিসাবের সমপরিমাণ। তবে একই সময়ে জাপানের জাতীয় অডিট বোর্ড অলিম্পিকের প্রস্তুতিসংক্রান্ত যে প্রতিবেদন জাপানের সংসদে পেশ করার জন্য তৈরি করেছে, তাতে বলা হয়েছে, খরচের পরিমাণ আয়োজকদের দেওয়া হিসাবের চেয়ে অনেক বেশি হবে। অতিরিক্ত ৯৭০ কোটি ডলার খরচের একটি তালিকা প্রতিবেদনে অন্তর্ভুক্ত রেখে অডিট বোর্ড বলছে, অলিম্পিক-সম্পর্কিত খরচ সেগুলো হলেও আয়োজকদের দেওয়া হিসাবে তা অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। অন্যদিকে জাপানের প্রভাবশালী দুটি দৈনিক আসাহি ও নিক্কেই শিম্বুন অলিম্পিক-সম্পর্কিত খরচাপাতির নিজস্ব যে হিসাব করে নিয়েছে, তাতে দেখানো হয়েছে, সার্বিক খরচ দাঁড়াবে ২ হাজার ৮০০ কোটি ডলারের কাছাকাছি। ফলে অলিম্পিকের খরচের দিকটি রাখঢাক করে রাখার জন্য আয়োজক কমিটিকে এখন সমালোচনার মুখে পড়তে হচ্ছে।

খরচের বেলুন ফুলেফেঁপে ওঠা অলিম্পিকের আয়োজনের বেলায় নতুন কিছু নয়। আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি আই ও সির চাপের মুখে স্বাগতিক শহরকে অধিকাংশ ক্ষেত্রে নতুন এমন কিছু অবকাঠামো তৈরি করে নিতে হয়, অলিম্পিকের আয়োজন শেষ হয়ে গেলে অর্থকরীভাবে যেগুলো কাজে না লাগায় শ্বেতহস্তী হিসেবে পড়ে থাকে। অলিম্পিকের এই শ্বেতহস্তী প্রপঞ্চ থেকে মুক্ত থাকার লক্ষ্যে ২০১৩ সালে স্বাগতিক শহর হতে পারার প্রতিযোগিতায় জয়লাভ করার সময় যেসব হিসাব টোকিও দাখিল করেছিল, তার পেছনে ছিল কমপ্যাক্ট বা গোছানো একটি প্রতিযোগিতার আয়োজন। সেই সূত্রে খরচের পরিমাণ তখন নির্ধারণ করা হয় ৭৩০ কোটি ডলার। কমপ্যাক্ট গেমস ধারণার পেছনে আছে খেলাধুলার চলমান সুযোগ-সুবিধাগুলো কাজে লাগানোর পাশাপাশি ১৯৬৪ সালের অলিম্পিকের জন্য নির্মিত কিছু স্থাপনা সংস্কার করে নেওয়া এবং কাছাকাছি এলাকার মধ্যে সব প্রতিযোগিতার আয়োজন করা। তবে টোকিও অলিম্পিকের আয়োজক কমিটি পরে সেই অবস্থান থেকে অনেকটাই সরে আসে এবং ক্রীড়া প্রতিযোগিতার ভেন্যুর বিস্তৃতি বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে খরচও ঊর্ধ্বমুখী হতে শুরু করে। ম্যারাথন এবং দূরপাল্লার দ্রুতগতির হাঁটা আই ও সির চাপের মুখে টোকিও থেকে দূরের শহর হোক্কাইডোর সাপ্পোরোতে সরিয়ে নিতে হওয়ায় খরচ এখন আরও কিছুটা বেড়ে যাবে।

আগামী বছরের অলিম্পিক আয়োজনের বিশাল খরচের মধ্যে আনুমানিক ৫৬০ কোটি ডলার আসবে বেসরকারি ব্যবস্থায় জোগাড় করা তহবিল থেকে, যেসব ব্যবস্থার মধ্যে স্পনসরশিপ, টিকিট বিক্রির আয় এবং বিপণন অন্তর্ভুক্ত আছে। বাদবাকি অর্থের জোগান দেবে জাপানের জাতীয় সরকার, টোকিও মেট্রোপলিটন সরকার এবং অন্যান্য সরকারি সংস্থা। প্রাথমিক হিসাব, ৭৩০ কোটি ডলারে খরচ সীমিত রাখা সম্ভব হলে করদাতাদের অর্থ নিয়ে টানাটানি করার প্রয়োজন তেমন বেশি হতো না। তবে খরচের হিসাব এখন তিন গুণের বেশি বেড়ে যাওয়ায় করদাতাদের অর্থের দিকে যে আরও বেশি করে হাত বাড়াতে হচ্ছে, তাই শুধু নয়; পাশাপাশি অলিম্পিকের আয়োজন শেষ হয়ে যাওয়ার পর টোকিওর শ্বেতহস্তীর খপ্পরে পড়ে যাওয়া নিয়েও উদ্বেগ দেখা দিতে শুরু করেছে।

অলিম্পিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন এখন পর্যন্ত স্বাগতিক কোনো শহরের জন্যই আর্থিক দিক থেকে লাভবান প্রমাণিত হয়নি। লাভের বড় একটি অংশ সম্প্রচার অধিকারের নামে আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি ও অন্যরা খেয়ে ফেলে এবং এরপরও এদের চাপের মুখে স্বাগতিক শহরকে খরচাপাতি সমানে বাড়িয়ে নিতে হয় বলে লাভের গুড় শেষ পর্যন্ত সবটাই যায় পিঁপড়ার ভাগে। তবে তা সত্ত্বেও সম্মাননা এবং প্রচারগত সুবিধা এটা এনে দেয় বলে সেই সুযোগ হাতছাড়া করা অনেকের পক্ষেই সম্ভব হয় না।