লকডাউনের কারণে ব্রিটেনে ৪ লাখ জীবন বেঁচেছে

করোনাভাইরাস মহামারিতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে মানুষ। ছবি: রয়টার্স
করোনাভাইরাস মহামারিতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে মানুষ। ছবি: রয়টার্স

২৯ জানুয়ারি। যুক্তরাজ্যে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়। মার্চের প্রথম দিকে, দিনে নতুন রোগীর সংখ্যা ছিল ১৩০। শেষ দিকে বেড়ে দাঁড়ায় ২ হাজার ৫০০। এপ্রিলের মাঝামাঝি, দিনপ্রতি গড় আক্রান্তের সংখ্যা পাঁচ হাজার ছাড়িয়ে যায়। আস্তে আস্তে এই সংখ্যা কমতে শুরু করে। এখন দাঁড়িয়েছে বারো শ, প্রতিদিন।

সংক্রমণের মতো, দিনপ্রতি মৃত্যুর হার সর্বোচ্চ ছিল এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহে। প্রতিদিন গড়ে এক হাজার। গতকাল ছিল ১৩৫। সংক্রমণ ও মৃতের সংখ্যা আস্তে আস্তে বেড়ে শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছাচ্ছে। তারপর? কমতে শুরু করছে। শুধু ব্রিটেনে নয়, প্রায় সব দেশেই একই প্রবণতা। তবে নতুন করে সংক্রমণের খবর আসছে। ছোট পরিসরে। বিচ্ছিন্নভাবে। প্রতিদিন নতুন করে আক্রান্ত, সেরে ওঠা এবং মৃতের হার শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছানো, তারপর কমতে থাকার, দেশভেদে, অঞ্চলভেদে ভিন্ন। লকডাউন, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, স্বাস্থ্যবিধি মেনে নিয়মিত হাত ধোয়া এবং চিকিৎসাসেবার ওপর নির্ভর করছে সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার কমে যাওয়ার ধরন।

সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার কমাতে লকডাউনের কার্যকারিতা প্রমাণিত হয়েছে গবেষণায়। লন্ডনের ইম্পেরিয়াল কলেজের বিজ্ঞানীরা অঙ্ক কষে এই সংখ্যা বের করেছেন। নামকরা বিজ্ঞান সাময়িকী ‘নেচার’–এ প্রকাশিত এক প্রবন্ধে তাঁরা বলেছেন, ইউরোপজুড়ে লকডাউন এবং চলাচল নিয়ন্ত্রণের ফলে ৩০ লাখ মানুষের মৃত্যু ঠেকানো গেছে। লকডাউনের কারণে শুধু ব্রিটেনে আনুমানিক ৪ লাখ মানুষের জীবন বেঁচেছে। গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, লকডাউনের কারণে সংক্রমণের হার ৮৫ শতাংশ কমানো সম্ভব হয়েছে। ব্রিটেনে একসময় এই হার ছিল ৩ দশমিক ৮, অর্থাৎ একজন আক্রান্ত লোক গড়ে ৩ দশমিক ৮ জনকে সংক্রমিত করছিল। গবেষণামতে, এই হার লকডাউনের কারণে কমে দাঁড়ায় শূন্য দশমিক ৬৩। মহামারি রুখতে এই মাত্রা যত দ্রুত কমবে ততই মঙ্গল। সংক্রমণ ঠেকাতে এই সংখ্যাটি ১–এর নিচে থাকা জরুরি।

জনসংখ্যার একটি বড় অংশ, অন্তত ৭০ শতাংশের বেশি সংক্রমিত হলে ভাইরাসের বিস্তার প্রকৃতিগতভাবে বাধাগ্রস্ত হয়। কমে আসে সংক্রমণ ও মৃত্যুহার। এই ধারণাটিকে বলা হয়—হার্ড ইমিউনিটি। গবেষকেরা বলছেন, তাঁদের হিসাব অনুযায়ী, যুক্তরাজ্যের জনসংখ্যার মাত্র ৫ শতাংশ সংক্রমিত হয়েছে। জার্মানিতে এই সংখ্যা শূন্য দশমিক ৮৫ শতাংশ। নরওয়েতে শূন্য দশমিক ৪৬ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি বেলজিয়ামে ৮ শতাংশ। তাঁরা বলছেন, এই গবেষণায় প্রমাণ হয়েছে সংক্রমণ ও মৃত্যুহার কমাতে লকডাউন, সামাজিক দূরত্ব, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা আর চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করা সবচেয়ে কার্যকর। হার্ড ইমিউনিটি এখনো দেখা যায়নি। গবেষকদের মতে, এগুলো শিথিল করবার আগে গভীরভাবে ভাবতে হবে। বিধিনিষেধগুলো একসঙ্গে তুলে না নিয়ে ধাপে ধাপে নিতে হবে। ব্রিটিশ সরকারের করোনাসংক্রান্ত অনেক সিদ্ধান্ত এই গবেষকদের তথ্যের ভিত্তিতে নেওয়া হচ্ছে।

ভাইরাস নিজ থেকে বংশবৃদ্ধি করতে পারে না। বংশবৃদ্ধির জন্য প্রাণীর শরীরের কোষে প্রবেশ করতে হয়। খাদ্য, পুষ্টি সেখান থেকেই আসে। বংশবৃদ্ধির মাধ্যমে তৈরি হওয়া নতুন ভাইরাসের জিনগত রূপ, আস্তে আস্তে সামান্য পরিবর্তিত হয়। এই পরিবর্তন অত্যন্ত ধীরগতির। এই পদ্ধতির নাম মিউটেশন। মিউটেশনের ফলে তৈরি হওয়া এই নতুন ভাইরাস অনেক সময় শক্তিশালী হয়ে ওঠে। তবে অনেক সময় লাগে। পরিবর্তিত এই ভাইরাসের আক্রমণ, বংশবিস্তার ও শরীরে ক্ষতি করার ক্ষমতা বেড়ে যায়। উল্টোটাও হয়। অর্থাৎ সংক্রমণের তীব্রতা ধীরে ধীরে কমতে শুরু করে। কমে যায় প্রাণী দেহে ক্ষতির মাত্রা। একসময় বিলুপ্তির পথে চলে যায় ভাইরাস। বুঝতেই পারছেন, ভাইরাসের জিনগত পরিবর্তন সব সময় খারাপ নয়।

সার্স ভাইরাসের সংক্রমণের কথা মনে আছে? ২০০২ সালের নভেম্বর। প্রথম সংক্রমণের খবর আসে চীন থেকে। মাত্র কয়েক সপ্তাহ। সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে সব মহাদেশে। সঙ্গে আতঙ্ক। ছয় মাসে প্রাণ যায় প্রায় ৮০০ মানুষের। ২০০৩–এর মাঝামাঝি থেকেই সংক্রমণ কমে আসতে শুরু করে। ২০০৪–এর মে মাসে সংক্রমণের সংখ্যা নেমে দাঁড়ায় শূন্যের কোঠায়। করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে কী হচ্ছে? সংক্রমণের সংখ্যা বেড়ে গিয়ে শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছানো, তারপর কমতে শুরু করা, এর পেছনে কি পরিবর্তিত করোনাভাইরাসের ভূমিকা রয়েছে? উত্তরটা এখনো পরিষ্কার নয়। অপেক্ষা করতে হবে আরও গবেষণার। এখন পর্যন্ত পাওয়া ফলাফলগুলো প্রাথমিক তথ্যের ওপর ভিত্তি করে।

ইতালির সান মার্টিনো হাসপাতালে বিজ্ঞানী মাত্তিও বাসোট্টি বলেছেন, দুই মাস আগে ইতালির উত্তরাঞ্চলে করোনাভাইরাসের বিধ্বংসী ক্ষমতা একই এলাকায় এখন পাওয়া ভাইরাস থেকে বেশি ছিল। উপসর্গগুলোর মাত্রা ছিল ভয়াবহ। তীব্র শ্বাসকষ্ট, কাজ করছিল না শরীরের নানা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার কয়েক দিনের মধ্যেই মারা যাচ্ছিলেন রোগীরা। একই মত দিয়েছেন ইতালির আরেক গবেষক ল্যাম্বার্টো মানজুলী। বলে রাখা দরকার, এই গবেষণা এখনো কোনো প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞান সাময়িকীতে প্রকাশ হয়নি। উপসর্গের এই তারতম্য ভাইরাসের জিনগত পরিবর্তনের কারণে কি না, তা জানতে আরও বেশ কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।

আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক লি রেইলিও ভাইরাসের বিধ্বংসী ক্ষমতা কমে যাওয়ার কথা বলেছেন। তবে বিজ্ঞানীদের আরেকটি অংশ, ভিন্ন মত দিয়েছেন। স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ের সংক্রমণ বিশেষজ্ঞ ডক্টর অস্কার ম্যাকলিন বলেছেন, ভাইরাসের বিধ্বংসী ক্ষমতা কমে যাওয়ার বড় ধরনের কোনো প্রমাণ এখনো পাওয়া যায়নি। ভাইরাস আস্তে আস্তে কম আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। তবে এত কম সময়ে নয়। বিধ্বংসী ক্ষমতা কমতে দরকার কয়েক বছরের, কয়েক মাসে এটা কমে না।

মার্কিন সংক্রমণ বিশেষজ্ঞ ডক্টর অ্যান্থনি ফাউসি বলেছেন, এইচআইভি, ইবোলা থেকে কোভিড–১৯ অনেক ভয়ংকর। সহজে চলে যাবে, এই ধারণা ঠিক নয়। অন্য ভাইরাস থেকে করোনা বেশ ভিন্ন। আকারে অন্যদের থেকে বড়। এইচআইভি এবং হেপাটাইটিস সি থেকে এদের জিনোমের পরিমাণ তিন গুণ বেশি। এতে করে করোনার বংশবৃদ্ধির ক্ষমতা অন্য ভাইরাস থেকে বেশি। অত্যন্ত চালাক এই ভাইরাস। জিনগত পরিবর্তনের মাধ্যমে সংক্রমণের ক্ষমতা যাতে অতিমাত্রায় না কমে, তার জন্য নিজের শরীরে নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র রয়েছে।

ফ্লোরিডার স্ক্রিপস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা বলেছেন, ইউরোপ ও আমেরিকায়, বিশেষ করে, নিউইয়র্কে করোনার রূপটি অত্যন্ত ভয়ংকর। অন্য এলাকা থেকে আলাদা। কারণ হয়তো ভাইরাসের জিনগত পরিবর্তন।

করোনাভাইরাস সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের অনেক কিছু এখনো অজানা। প্রয়োজন আরও অনেক গবেষণার, সঙ্গে সময়ের। ভাইরাস নিজ থেকে যাবে কি না, সে জন্য বসে থাকলে চলবে না। বসেও নেই বিজ্ঞানীরা। জোর কদমে চলছে ভ্যাকসিনের ট্রায়াল। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ভ্যাকসিনের ট্রায়ালের ফলাফল জানা যাবে সেপ্টেম্বরে। ফলাফল আশানুরূপ হলে ভ্যাকসিন পাওয়া যাবে অক্টোবর থেকে। অতীতের সব মহামারি শেষ হয়েছে। এটাও হবে। কবে হবে? সেটা কিছুটা হলেও নির্ভর করছে আমার আর আপনার ওপর। কীভাবে? বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ শুনুন। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখুন। ভালো থাকবেন।

সুব্রত বোস: প্রবাসী বাংলাদেশি ও বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানির ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালস অ্যানালিটিকসের গ্লোবাল প্রধান।
[email protected]