কেমন কাটছে আমাদের দিন

>করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ-বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ-বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]

ঘড়িতে এখন রাত দুইটা। রাতের নিস্তব্ধতাকে ভেঙে দিয়ে একটি অ্যাম্বুলেন্স আর কিছু পুলিশের গাড়ি সাইরেন বাজিয়ে ছুটে চলেছে। সাইরেনের বুক বিদীর্ণ করা শব্দ যেন এক অজানা আতঙ্কের বার্তা জানিয়ে যাচ্ছে ম্যারিল্যান্ডের এই ছোট্ট শহরকে। শুধু ভয় হয়, এবার আমার পালা নয়তো? এত দিনে আমরা কোভিড-১৯ নামের পৃথিবীব্যাপী মহামারি ভাইরাসের মহামারির কথা সবাই জেনে গেছি। মার্চের ৫ তারিখে আমেরিকার ম্যারিল্যান্ড স্টেটে প্রথম করোনায় সংক্রমিত রোগী শনাক্ত হওয়ার পর স্টেটটির গভর্নর এখানে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন। এ সময় স্টেটটিতে দ্রুত করোনা রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। কাছের স্টেট নিউইয়র্কে প্রতিদিন কোভিডে আক্রান্ত হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু আর অসহায়ের মতো নিজ গৃহে বাধ্যতামূলক অবস্থান—সব মিলে হঠাৎ করেই যেন আমাদের চেনা পৃথিবীটা বদলে যায়।

এই অচেনা জগতে কেমন কাটছে আমাদের দিন? মার্চের ১৬ তারিখে যখন জানলাম আমাদের আর অফিসে যেতে হবে না, বাসায় বসে কাজ করতে পারব, প্রথমে খুশি হলেও পরে বুঝলাম, সারা পৃথিবীর অর্থনীতি যদি এই দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তবে অন্য অনেকের মতো আমিও যেকোনো দিন বেকার হয়ে যাব। বাংলাদেশে কী হবে বা হচ্ছে, সেটা তো প্রতি মুহূর্তের ভাবনা। এ রকম নানা দুশ্চিন্তা নিয়ে বাসায় ফিরে দেখি, আমাদের আড়াই বছরের ছেলে তার মা-বাবাকে সারাক্ষণ একসঙ্গে পেয়ে অনেক খুশি। আমিও ভাবলাম মন্দ কী! এখন আর ভোরের সূর্য ওঠার আগে মেট্রো ধরার কোনো তাড়া নেই, বিকেলে অফিস শেষে ফিরতি ট্রেনে ভিড় ঠেলে বাড়ি ফেরার ক্লান্তি নেই, ছেলেকে ডে-কেয়ার থেকে তুলতে দেরি হওয়ার দুশ্চিন্তা নেই, বাজার করার ঝক্কি নেই।

কিন্তু দুই সপ্তাহ না যেতেই ছেলে বুঝে ফেলল, এই নতুন পৃথিবীতে অনেক কিছুর মতো প্রতিদিন তার বন্ধুদের সঙ্গে খেলার সুযোগ নেই, শিক্ষকদের আদর আর ভালোবাসা নেই, বিকেলবেলা পার্কে বেড়াতে যাওয়া নেই, সপ্তাহান্তে চিড়িয়াখানা বা মিউজিয়ামগুলোতে ঢুঁ মারার উপায় নেই, আরও কত কী! সারা দিন শুধু চাতক পাখির মতো জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকা, যদি কোনো মানুষের দেখা পাওয়া যায়, যদি একটা গাড়িকে ছুটে যেতে দেখা যায়, যদি দুটো কাঠবিড়ালিকে ঘাসের ওপর ছোটাছুটি করতে দেখা যায়!

এদিকে আমার আর ছেলের বাবার দিন কাটে ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। আমরা দুজন পালা করে অফিসের কাজ করি, ছেলের সঙ্গে খেলা করি, সঙ্গে ঘর-গৃহস্থালির কাজ সবই ভাগাভাগি করে করি। সারা দিনের যুদ্ধ শেষে যখন ফুরসত মেলে, তখন হয়তো মাঝরাত। মাঝে মাঝে খুব হাঁপিয়ে উঠি। বসন্তের নতুন পাতাগুলো একটু ছুঁয়ে দেখা হয় না, চেরিগাছের ফুলের মাঝে হারিয়ে যাওয়া হয় না। মনে হয়, আর কখনো কি মুক্ত বাতাসে শ্বাস নিতে পারব? তখন ওই অ্যাম্বুলেন্সের বিষাদ সাইরেন আমাকে মনে করিয়ে দেয়, আমার মতো দুঃখবিলাস করার সৌভাগ্যও সবার নেই। অনেকেই এই পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিয়েছেন, অনেকে হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন। আবার অনেকে যমের হাত থেকে কাউকে বাঁচানোর জন্য দিনের পর দিন হাসপাতালে যুদ্ধ করছেন। আর আমি ঘরে বসে অস্থির হয়ে যাচ্ছি! এ ভীষণ অন্যায়।

তাই ঠিক করেছি, যখন যেখানে যে অবস্থায় আছি, সে অবস্থাতেই প্রতিটা মুহূর্ত বেঁচে থাকব। ব্যস্ততার জন্য যেসব কাজ করার ফুরসত হচ্ছিল না, সেগুলো করব। বন্ধুবান্ধব, আপনজনদের সঙ্গে যোগাযোগ করব, নিজের শখের কাজগুলো প্রতিদিন একটু একটু করে করব। আর নিজেকে আরেকটু ভালো করে গড়ে তুলব। সুস্থভাবে একটি দিন বেঁচে থাকা হবে প্রতিদিনের চ্যালেঞ্জ। আর কয়েক দিন পরই তো ঈদ। এবারের ঈদের আনন্দ হবে বেঁচে থাকার আনন্দ, ঈদের প্রার্থনা হবে প্রিয়জনদের নিয়ে সুস্থভাবে বেঁচে থাকার প্রার্থনা, আর ঈদের উপহার হবে একটি জীর্ণমুখের হাসি।