তারুণ্য যেমন মধুর, তেমন কঠিন

তারুণ্যে কঠিন সময় এলে কাছের বন্ধুরা সেই সময় কাটাতে সাহায্য করতে পারে
তারুণ্যে কঠিন সময় এলে কাছের বন্ধুরা সেই সময় কাটাতে সাহায্য করতে পারে

বহু বছর আগের কথা। ঢাকায় কলেজ শেষ করে আমেরিকায় গেলাম ইউনিভার্সিটিতে। ঢাকায় আমার জীবন ছিল মধুর। ছোট একটা কলেজে পড়ার কারণে কলেজের সবাই আমাকে চিনত। ক্লাস এইট থেকে শুরু করে কলেজের সেকেন্ড ইয়ার পর্যন্ত বেশির ভাগ ছেলেমেয়ের সঙ্গে সখ্য ছিল। যেহেতু এক স্কুল আর কলেজেই ১২ বছর ছিলাম, কলেজের আয়া থেকে শুরু করে প্রিন্সিপাল পর্যন্ত সবাই আমাকে চিনতেন এবং দু-একজন ছাড়া সবাই বেশ পছন্দ করতেন। কলেজের বাইরে ছিল বন্ধুর একটা বড় সার্কেল। নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের কারণে নিজ বয়সী এবং বয়সে বড় অনেকের সঙ্গে গভীর ঘনিষ্ঠতা ছিল। পাড়ার বন্ধুও ছিল অনেক। এর বাইরে ভাইবোন, আত্মীয়স্বজন তো ছিলই। বহু বছর চেষ্টা করার পর একজনের সঙ্গে ভাবও হয়েছিল। আমার জীবনে আমিই ছিলাম রাজা। জীবন ছিল ভালো লাগা আর ভালোবাসায় ভরপুর।

এসব ছেড়ে গেলাম বিদেশ বিভুঁইয়ে। বড় একটা ইউনিভার্সিটি। হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী। কেউ আমাকে চেনে না। আমিও কাউকে চিনি না। যেখানে দেশে সবার মধ্যমণি ছিলাম, সেখানে হয়ে গেলাম আকাশের কোনায় অচেনা নক্ষত্র। নতুন করে কীভাবে বন্ধু বানাতে হয়, ভুলে গিয়েছিলাম। তা ছাড়াও নিজের ভাষায় কথা বলে না, আমার সঙ্গে ভৌগোলিক, সামাজিক অথবা সাংস্কৃতিক দিকের কোনো ধরনের মিল নেই—তাঁদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করার অভিজ্ঞতা একদমই ছিল না। নতুন বন্ধু বানানো বেশ দুষ্কর হয়ে গেল। বেশ কয়েক মাস পড়ে গেলাম গভীর বিষণ্নতায়। কোনোভাবে বিষণ্নতা কাটিয়ে উঠতে পারলেও আমার নতুন বাস্তবতার ব্যাপারে ধাতস্থ হতে লাগল বেশ কয়েক বছর। যত দিনে হলাম, তত দিনে প্রায় ইউনিভার্সিটি শেষ হওয়ার সময় এসে গেছে। ইউনিভার্সিটি শেষে যখন আরেক শহরে চাকরিতে ঢুকলাম, শুরু হলো নতুন চ্যালেঞ্জ।

আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে এ রকম অভিজ্ঞতা শুধু আমার নয়, আরও অনেকেরই হয়েছে। স্কুল থেকে কলেজ, কলেজ থেকে ইউনিভার্সিটি, তারপর চাকরি—প্রতি পদেই খুব কম সময়ের মধ্যে সবকিছু সাংঘাতিকভাবে পালটে যায়। প্রতিটা স্তরই যেন আলাদা একেকটা জীবন। জীবনের যেকোনো পর্যায় শেষে কঠিন অনুভূতির সম্মুখীন হতে হবে, সেটাই স্বাভাবিক। এই বাস্তবতার সম্মুখীন হতে হবে, সেটাও অনিবার্য। তবে এ রকম যে হবে, সেটার ব্যাপারে আগে থেকে অবগত থাকলে কঠিন অনুভূতিগুলো মোকাবিলা করতে নিজেকে আরেকটু ভালোভাবে প্রস্তুত করা যায়। ধাক্কাটা কম লাগে। বিষণ্নতার কষ্টকে একটু দূরে রাখা যায়।

আবারও বলছি, প্রথমেই যেটা মাথায় রাখতে হবে, সেটা হলো ১৫ বছর বয়স থেকে শুরু করে ২৫ পর্যন্ত কিছুদিন পরপর বাস্তব জীবনে বড় একেকটা পরিবর্তন আসবে। বেশিরভাগ মানুষের জন্যই এই বাস্তবতা এড়ানো অসম্ভব। তবে পরিবর্তন এসেছে বলেই যে নতুন জীবনের সঙ্গে আগের বাস্তবতার সম্পূর্ণ বিচ্ছেদ ঘটাতে হবে, সেটা ভাবারও কোনো কারণ নেই। আমার ক্ষেত্রে আমি যে ভুলটা করেছিলাম, সেটা হলো বিদেশে গিয়ে নতুন জীবনের চাপে পড়ে দেশের বন্ধু–বান্ধব, আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ হারিয়ে ফেলেছিলাম। অবশ্য তখন যোগাযোগ রাখাটাও কঠিন ছিল। ই–মেইল ঠিকঠাকভাবে তখনো আসেনি। যোগাযোগের মাধ্যম বলতে ফোন (যেটা খরচের কারণে বাস্তবিক ছিল না) আর চিঠি (যেটা লেখার ব্যাপারে আমার আলস্য ছিল অপরিসীম)। লেখাপড়া যে রকম করতে হবে, ঠিক সে রকমভাবে চিঠি লেখা যে সুখ–শান্তি ও সাফল্যের জন্য জরুরি, সেটা তখন বুঝতে পারিনি। কেউ আমাকে বোঝায়ওনি।

এই বোঝানো নিয়ে কিছু কথা আছে। আপনি যে আপনার বাস্তবতা নিয়ে মনঃকষ্টে আছেন, এটা সব সময় সবাই বুঝবে না। বুঝলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কেউ আগবাড়িয়ে আপনাকে পরামর্শ দিতে আসবে না। বেশি যেটা হয়, সেটা হলো মানুষ ধরেই নেয় যে এসব এক ধরনের তারুণ্যের আবেগী বিলাসিতা। এমন অবস্থায় যদি মনে হয় যে জীবনটা দুর্বিষহ হয়ে যাচ্ছে, তাহলে করণীয় হলো নিজের থেকে পরামর্শ অথবা যেকোনো ধরনের কাউন্সেলিং খুঁজে নাওয়া। এ ক্ষেত্রে যে কোনো মানসিক চিকিৎসকের কাছেই যেতে হবে, সে রকম কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। বিষণ্নতা, বিশেষ করে তরুণ জীবনের বিষণ্নতা যে ভয়ংকর রূপ ধারণ করতে পারে, এ ব্যাপারে আমাদের সচেতনতা অনেক বেড়েছে। এর সঙ্গে সঙ্গে অনলাইন ও অফলাইনে সেটা মোকাবিলা করার সংস্থান বেড়েছে। এই সংস্থান ও সমাধান খুঁজে বের করার ব্যাপারে কোনো সংকোচ বা লজ্জাবোধ থাকার সামান্যও কারণ নেই।

পুরোনো সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা, নতুন পরামর্শ খুঁজে নেওয়ার বাইরেও আরেকটা বিষয় যেটা করা জরুরি, সেটা হলো কিছু গঠনমূলক শখের কাজ খুঁজে বের করা—তরুণ বয়সে প্রতিটা শখই চালিয়ে যেতে পারবেন। এতে জীবনে এক ধরনের ধারাবাহিকতা আসে, স্থিতিশীলতা আসে, যা বিষণ্নতাকে দূরে রাখে, একাকিত্ব মোকাবিলা করতে সাহায্য করে।

আবার নিজের জীবনে ফিরে যাই। কলেজজীবনে লেখালেখি খুব পছন্দ করতাম। ক্রিকেট–ফুটবল খেলতে ভালোবাসতাম। নানা ধরনের সামাজিক কাজ করতাম। ইউনিভার্সিটিতে গিয়ে শুরুর দিকে কোনোটাই চালিয়ে যাইনি। আমার বিশ্বাস, এ কারণেই আমার বিষণ্নতা ও একাকিত্ব আরও প্রকট হয়েছিল।

তারুণ্য যেমন মধুর, ঠিক তেমনি কঠিন। প্রতিটি মানুষের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ একটি সময় তারুণ্য। এ সময় পরবর্তী জীবনের ভিত তৈরি হয়। তখন একজনের প্রয়োজন শক্ত পায়ে এগিয়ে চলা। বিষণ্নতার ভার কাঁধে নিলে তা কঠিন হয়ে পড়ে। প্রত্যেক তরুণেরই নিজের প্রতি দায়িত্ব, এই বিষণ্নতাকে দূরে রাখা। এই দায়িত্ব পালনের যাত্রায় নিজেকে একা ভাবার কোনো কারণ নেই।

ভালো লাগার বিষয়গুলো হাতের কাছেই আছে। খুঁজে নিতে হবে। নিজেকে ভালোবেসে। জীবনকে ভালোবেসে। 

লেখক: অভিনয়শিল্পী