ঈদের দিনে নান্দাইল দিঘিতে হাজারো মানুষ

নান্দাইল দিঘিতে চলছে নৌবিহার। ছবি: আনোয়ার পারভেজ
নান্দাইল দিঘিতে চলছে নৌবিহার। ছবি: আনোয়ার পারভেজ

ঈদ উপলক্ষে হাজারো মানুষের ঢল নেমেছে জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার নান্দাইল দিঘিতে। আজ বুধবার ঈদের দিন সকাল থেকেই ৩০০ বিঘা আয়তনের এই স্বচ্ছ জলরাশির সৌন্দর্য উপভোগ করতে আসেন পর্যটকেরা। দিঘিপাড়ের সবুজ ছায়াঘেরা মনোরম পরিবেশে আর দিঘির পানিতে ইঞ্জিনচালিত নৌকা আর স্পিডবোটে চড়ে বেড়িয়েছেন অনেকেই। দূরদূরান্ত থেকে এসেছেন পর্যটকেরা। দিঘির জলে সাঁতার কেটেছেন কেউ কেউ।

দিঘির পাড়ে আইসক্রিম, ফুসকা,চটপটি, আচার, শরবত, ঝালমুড়ি, পাপড়, জিলাপি থেকে শুরু করে হরেক পদের খাবারের পসরা সাজিয়ে বসেছেন দোকানিরা। দিঘি ঘুরতে এসে শিশুরা চড়ছে নাগরদোলা-চড়কিতে। কেউ কিনছে রঙিন বেলুন, কেউ হরেক রকম খেলনা। চলছে লাঠিখেলা, জারিগানও।

ঈদের তৃতীয় দিন পর্যন্ত এখানে লাখো মানুষ আসবে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় পুনট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুল কুদ্দুস ফকির।

বিশাল নান্দাইল দিঘি। ছবি: আনোয়ার পারভেজ
বিশাল নান্দাইল দিঘি। ছবি: আনোয়ার পারভেজ

বগুড়া থেকে সপরিবারে ঘুরতে আসা রেহান আলম বলেন, ঈদের আনন্দ উপভোগ করতে নান্দাইল দিঘির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে এসেছেন। দিঘির স্বচ্ছ জলরাশির অপরূপ দৃশ্য তাঁর মন মাতিয়েছে। তবে এখানে হোটেল-মোটেল, রেস্টহাউস, রেস্টুরেন্ট কিছুই না থাকায় বেড়াতে এসে ভোগান্তিতে পড়েছেন।

জয়পুরহাটের পাঁচবিবি থেকে পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে নান্দাইল দিঘি ঘুরতে আসা কলেজছাত্রী নাসরিন গীতি বলেন, ‘ঐতিহাসিক এই দিঘির কথা অনেক শুনেছি। বিশাল আয়তনের দিঘির অপরূপ প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হয়েছি।’

গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার কামদিয়া থেকে মোটরসাইকেল চালিয়ে আজ নান্দাইল ঘুরতে এসেছেন রোমেল হাসান। সঙ্গে তাঁর নববিবাহিতা স্ত্রী রওনক জাহান। বলেন, ‘এত বিশাল দিঘি আগে কখনো দেখিনি। নৌকায় চড়ে দিঘির সৌন্দর্য উপভোগ করেছি। দিঘির পাড়ে বসে সূর্যাস্ত উপভোগ করার জন্য অপেক্ষা করছি। রাত যাপনের ব্যবস্থা থাকলে কাল পর্যন্ত থেকে যেতাম।’

নান্দাইল দিঘি ঘুরতে আসা তরুণী রজনী আকতার বলেন, ‘ঈদের দিন এখানে ঘুরতে এসে অন্য রকম মজা পেয়েছি। নৌকায় চড়ে দিঘির জলে ঘুরেছি। নাগরদোলায় চড়েছি। ফুসকা, চটপটি, আইসক্রিম খেয়েছি।’

দিঘির পাড়ে বসেছে মেলা। ছবি: আনোয়ার পারভেজ
দিঘির পাড়ে বসেছে মেলা। ছবি: আনোয়ার পারভেজ

বগুড়া বিয়াম মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী সাদমান সাজিদ বলেন, ‘দাদুবাড়িতে ঈদ করতে এসে এখানে বাবার সঙ্গে ঘুরতে এসেছি। এত্ত বড় দিঘি আগে কখনো দেখিনি।’

স্থানীয় ইউপি সদস্য আফজাল হোসেন বলেন, তিন দিনব্যাপী ঈদ মেলা বসে এখানে। শতাধিক দোকানে তিন দিনে ২০ থেকে ৩০ লাখ টাকার ব্যবসা হয়। পর্যটকেরা নৌকায় চড়ে দিঘির সৌন্দর্য উপভোগ করেন। ছায়াঘেরা দিঘির পাড়ে বসে হিমেল বাতাসে প্রাণ জুড়ান। শিশুরা নাগরদোলা-চরকিতে চড়ে আনন্দ করছে। ঐতিহাসিক এই দিঘিকে ঘিরে গোটা এলাকায় এখন উৎসব-আমেজ।

স্থানীয় লোকজন, প্রশাসন এবং নান্দাইল দিঘি ঘুরতে আসা দর্শনার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নান্দাইল দিঘির ইতিহাস ৪০০ বছরেরও বেশি পুরোনো। ১৬১০ খ্রিষ্টাব্দে রাজা নন্দালাল প্রজাদের জলকষ্ট লাঘবে নান্দাইল দিঘি খনন করেন। কথিত রয়েছে, নন্দ রানির ইচ্ছা অনুযায়ী লাখো শ্রমিক লাগিয়ে এক রাতে দিঘিটি খনন করা হয়েছিল। ৩০ বছর আগেও নান্দাইল দিঘির চারদিকে ঘন জঙ্গল ও উঁচু টিলা ছিল। টিলার ওপড়ে ছিল শত প্রজাতির বনজ ও ফলদ গাছগাছালি। শীতের সময় দিঘিতে আসত অতিথি পাখি। সরকারি মালিকানাধীন এই ঐতিহাসিক দিঘিকে আশির দশকে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়। প্রাথমিকভাবে পর্যটন করপোরেশন নান্দাইল দিঘিতে কার্যালয় স্থাপন ছাড়াও জনবল নিয়োগ দেয়। কিন্তু কিছুদিন পর উদ্যোগ থেমে যায়। প্রত্যাহার করে নেওয়া হয় জনবল। এরপর থেকে নান্দাইল দিঘি পাড়ের মূল্যবান গাছগাছালি লোপাট শুরু হয়। গাছ ও টিলা কেটে নির্বিচারে দখল হয় দিঘি পাড়ের জায়গা। গড়ে ওঠে লোকালয়,বসতি। হুমকির মুখে পড়ে দিঘির পাড়ের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ।

ঈদে নান্দাইল দিঘিতে বেড়াতে এসে শখের নাগোরদোলায় পর্যটকেরা। ছবি: আনোয়ার পারভেজ
ঈদে নান্দাইল দিঘিতে বেড়াতে এসে শখের নাগোরদোলায় পর্যটকেরা। ছবি: আনোয়ার পারভেজ

কালাই উপজেলার চেয়ারম্যান মিনফুজুর রহমান বলেন, ইতিহাস-ঐতিহ্যের সাক্ষী নান্দাইলদিঘির পর্যটন সম্ভাবনা কাজে লাগাতে সম্প্রতি সরকারি নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। দিঘিতে পর্যটকদের সংখ্যা দিন দিন বেড়ে যাওয়ায় এর জলরাশি স্বচ্ছ রাখা, পর্যটকদের সুবিধার্থে একটি ঘাট নির্মাণ এবং বিশ্রামাগার কাম রেস্টহাউস নির্মাণ করা হয়েছে। তবে পূর্ণাঙ্গ পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তোলার নান্দাইল দিঘির পরিকল্পিত উন্নয়নে প্রকল্প গ্রহণ করা প্রয়োজন।

মিনহাজুর রহমান বলেন, দেশি-বিদেশি পর্যটক বাড়াতে হলে বেদখল হওয়া সরকারি সম্পত্তি উদ্ধার, প্রয়োজনে জমি অধিগ্রহণ, নিরাপত্তাপ্রাচীর, পিকনিক স্পট, গাড়ি পার্কিং, পর্যাপ্ত বিশ্রামাগার, পর্যটকদের রাত যাপনে কটেজ নির্মাণ দরকার। পর্যটকদের নিরাপত্তায় ট্যুরিস্ট পুলিশ ফাঁড়ি প্রয়োজন। নান্দাইল দিঘির এসব উন্নয়নে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় কাজ করছে।