কেবল আম এবং আম

পাকা আমের মধুর রসে... টি–শার্ট অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী ও তুলি
পাকা আমের মধুর রসে... টি–শার্ট অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী ও তুলি

বর্ষার ঝুম বৃষ্টিতে যখন ভিজতে থাকবে আপনার জানালার কার্নিশ, পাচিলের ওপর কালো দাঁড়কাক; আম-জাম-জামরুলের দুঃখ ভুলে একচিলতে বারান্দায় ঝোলানো মানি প্ল্যান্ট আর টবে লাগানো পাতাবাহারের তিরতিরে কাঁপন দেখে যখন শৈশবের আমকুড়ানি দুরন্তপনার কথা ভেবে আকুল হবেন, ঠিক তখন যদি আপনার সদ্য পড়তে শেখা শিশুটি আপন মনে গেয়ে ওঠে,

ঝড় এল এল ঝড়
আম পড় আম পড়
কাঁচা আম ডাঁসা আম
টক টক মিষ্টি…।

তখন কোনো এক গোপন গভীর অব্যক্ত ঊর্ধ্বমুখী অভিমান আপনার গলা বেয়ে ঝাপসা করে দেবে চোখের পাতা! হয়তো আপনিও নিজের অজান্তে গাইতে শুরু করবেন, ‘… তার চেয়ে চল যাই/ করি কিছু খাটনি,/ নুন-ঝাল-তেল মেখে/ করে নিই চাটনি।/ কি যে মজা চাটনিতে/ টক-ঝাল-মিষ্টি,/ দেখলেই জিভ পুরে/ আসে পানি বৃষ্টি,…’। চোখের সঙ্গে সঙ্গে আপনার জিবও তখন আর্দ্র হতে শুরু করবে।

বাঙালির খাদ্যসংস্কৃতিতে আম শুধু একটি ফল নয়, বরং একটি সাংস্কৃতিক অনুষঙ্গ। এই একটি ফল আমাদের জীবনে তৈরি করে বয়সভিত্তিক গাদাগুচ্ছের স্মৃতি। মানসপটে তো বটেই, শারীরিকভাবেও আমরা সেসব স্মৃতিকে বয়ে চলি জীবনভর।

আমরা যখন ঠিক বাঙালি হয়ে উঠিনি, প্রায় ছয় হাজার বছর থেকে এই ফল গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলের মানুষ হিসেবে আমাদের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। আমের একটি নাম ‘সোমধারা’। পাকা আমের মিষ্টি রসকে দুধের সঙ্গে মিশিয়ে দিলে তা হয়ে যায় সোমধারা! আর কে না জানে, দুধের সঙ্গে আমের রস মিশিয়ে খাওয়া বাঙালির চিরাচরিত অভ্যাস। সোমধারা নামটি থেকে বাঙালি জীবনে আমের গুরুত্ব আর প্রাচীনত্ব বোঝা যায়। উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, পরিপক্ব আমই শুধু বাঙালি খায় না। মুকুল থেকে খাওয়া শুরু হয়। তারপর কাঁচা ও পাকা আম দিয়ে তৈরি হয় বিভিন্ন ধরনের খাবার। এখন হয়তো আর খাওয়া হয় না, কিন্তু আমের মুকুল দিয়ে তৈরি চাটনি, ঝোল খাওয়ার রেওয়াজ বাঙালির অনেক প্রাচীন।

ওপরের ছড়াটিতে নুন-ঝাল-তেল মেখে আমের চাটনি বানানোর কথা বলা হয়েছে। কাঁচা আম কুচি কুচি করে কেটে সরিষার তেল, লবণ, কাঁচা মরিচ বা শুকনো মরিচের গুঁড়ো মেখে তৈরি হয় আমের চাটনি। কোনো কোনো অঞ্চলে এটি ‘ঝালা’ নামেও পরিচিত, সম্ভবত এর ঝাঁজালো স্বাদের জন্য। আম বেশি টক হলে অল্প পরিমাণ চিনি বা গুড় মিশিয়ে নিলে সেটা সবার খাবার যোগ্য হয়ে ওঠে। অঞ্চলভেদে চাটনি খাবার অনেক প্রণালি রয়েছে। সে বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ এখানে নেই। মূল কথা হলো, আম খাওয়া শুরু হয় এই চাটনি দিয়ে।

কাঁচা আমে তৈরি আচার হচ্ছে বাঙালি জীবনের আর এক অধ্যায়ের নাম। প্রায় সব ধরনের ফল এবং সবজি দিয়ে আচার তৈরি করা গেলেও আমের আচার এক এবং অদ্বিতীয়। এটি সংরক্ষণ করে রেখে প্রায় সারা বছর খাওয়া যায়। আচার শুধু খাদ্যবস্তুই নয়, বাঙালির হারিয়ে যাওয়া ছাদ বিলাসের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গও বটে। সরিষার তেল আর বিভিন্ন মসলায় জাড়িত বিচিত্র কায়দায় বানানো আমের আচার কাচের বয়ামে রেখে, মুখ আটকে শরীকি ছাদের এজমালি রোদে শুকানোর স্মৃতি আমাদের প্রাচীন নারীদের এখনো মুগ্ধ করে বৈকি। প্রায় সারা দেশে চাষ হওয়া আম থেকে তৈরি হয় বিচিত্র সব আচার। আম দিয়ে অনেক পদের টক খাবার তৈরি করা হয়। এর মধ্যে একটি হলো আমচূড়। পরিপক্ব কাঁচা আম সরু ফালি করে কেটে কড়া রোদে শুকিয়ে সংরক্ষণ করে রাখা খাবারই হলো আমচূড়। প্রধানত মসুর ডাল রান্নায় আমচূড় ব্যবহার করা হয়। এ ছাড়া চাঁপাইনবাবগঞ্জ এবং রাজশাহী অঞ্চলের কোনো কোনো এলাকায় মাষকলাইয়ের ডালেও আমচূড় ব্যবহার করা হয়। কাঁচা আম দিয়ে আমডাল খাবার প্রচলনও রয়েছে আমাদের দেশে এবং এটি জনপ্রিয় খাবার হিসেবেই পরিচিত। মসুর ডাল রান্নার সময় পাঁচফোড়নে কাঁচা আম সাতলে নিয়ে রান্না করা আমডাল না খেলে আমের মৌসুম ঠিক জমে না বাঙালির। এ ছাড়া আমের টকও জনপ্রিয় খাবার হিসেবে পরিচিত। চোঁচা ফেলে পরিপক্ব কাঁচা আম চাকা চাকা করে কেটে শুকনো মরিচ আর পাঁচফোড়নে সম্ভার দিয়ে রান্না করা হয় আমের টক। সঙ্গে কোথাও কোথাও গুড় বা চিনির ব্যবহারও দেখা যায়। কাঁচা আমের সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের শাক রান্নারও প্রচলন রয়েছে। প্রচলন রয়েছে ছোট মাছ দিয়ে কাঁচা আমের তরকারি রান্নার। তবে এসব খাবারের থেকে একেবারে ভিন্ন খাবার হলো আমসত্ত্ব।

পাকা আম ভালোভাবে পরিষ্কার করে খোসা ছাড়িয়ে নিয়ে চিপে রস বের করে ছাঁকনি দিয়ে ছেঁকে আঁশহীন করে নেওয়া আমসত্ত্ব তৈরির প্রথম ধাপ। এরপর বড় আকারের প্লেটে অল্প সরিষার তেল মাখিয়ে রোদে রেখে গরম করে নিয়ে তার ওপর রস ঢেলে রোদে শুকিয়ে নিয়ে তৈরি করা হয় আমসত্ত্ব। এভাবে কয়েকটি স্তরে তৈরি করা যায় আমসত্ত্ব। যদি আম টক হয় তবে সে ক্ষেত্রে চিনির বা গুড়ের সিরা মিশিয়ে আমের রসকে মিষ্টি করতে হবে (আম্রকুঁড়ির গন্ধে তোমায় স্বাগত বৈশাখ, মাহবুব সিদ্দিকী)। আমসত্ত্ব তো তৈরি হলো। এবার খাওয়া হবে কীভাবে? রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং সে পথ বাতলে দিয়েছেন, “আমসত্ত্ব দুধে ফেলি/ তাহাতে কদলী দলি/ সন্দেশ মাখিয়া দিয়া তাতে/ হাপুস হুপুস শব্দ চারিদিক নিস্তব্ধ/ পিপিড়া কাঁদিয়া যায় পাতে।” দুধে আমসত্ত্ব দিয়ে তাতে পাকা কলা আর সন্দেশের সংযোগ মানেই বেচারা পিঁপড়ার কান্না!

শুধু বিভিন্ন খাদ্যই তো নয়। আম দিয়ে পানীয়ও তৈরি হয়। বিভিন্ন ‘জুস বারে’ গ্রিন ম্যাঙ্গো জুস পান করার অভিজ্ঞতা রয়েছে আমাদের। কাঁচা আম আগুনে পুড়িয়ে চিপে সেই রস দিয়ে বানানো ‘আমের পানা’ আমাদের জীবনে এখন কিছুটা অপ্রচলিত। তবে পাকা আমের রসের আমদুধ এখনো খাওয়া হয় কোনো কোনো পরিবারে। এই বল-বীর্যবর্ধক আমদুধের কারণেই আমের আর এক নাম ‘সোমধারা’।

সে জন্য আগেই বলেছি, আম বাঙালি জীবনে শুধু একটি ফল নয়। এটি জীবনচর্যার অনুষঙ্গও বটে।