সন্তানের চলার পথ রুদ্ধ করে দিচ্ছেন না তো?

আর দশটা সাধারণ বাঙালি মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ের মতো বড় হচ্ছিল নিশি (ছদ্মনাম)। স্কুলে কার সঙ্গে মিশছে, কোথায় যাচ্ছে, কী পরছে বা কী পড়ছে, তার বন্ধুরা কে কোথায় থাকে থেকে শুরু করে যাবতীয় খুঁটিনাটির দেখভাল করেন মা। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়ে, চাকরির সুবাদে ঘর ছেড়ে অপরিচিত এক শহরে পাড়ি জমিয়েই বিপাকে পড়ল মেয়েটা। এখানে তো মা নেই, এবার তবে তাকে কে আগলে রাখবে? কে দেখাবে চলার পথ?

ঠিক এমনটাই ঘটেছে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত অস্ট্রেলীয় নাগরিক সাকিব আলমের (ছদ্মনাম) বেলায়ও। অস্ট্রেলিয়ায় বড় হলেও তাঁর এশীয় বাবা-মা ভুলতে পারেননি রক্ষণশীল সংস্কৃতি। কাজেই ২৫ বছর বয়সে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে হুট করেই তিনি আবিষ্কার করলেন, অন্যদের তুলনায় মানসিকভাবে কম করেও পাঁচ বছর পিছিয়ে তিনি। কারও সঙ্গে মিশতে লজ্জা পান। অন্তর্মুখী স্বভাবের জন্য মন খুলে কাউকে জানানো হয় না ভালো লাগা মন্দ লাগার গল্পগুলো। মেয়েদের সঙ্গে কথা বলতে গেলে রীতিমতো তোতলাতে থাকেন। কেন যেন এক বন্ধুর সঙ্গে দীর্ঘদিন সম্পর্ক টেকেও না তাঁর। যত দিনে তিনি বন্ধুর সন্ধানে পা বাড়িয়েছেন, তত দিনে চারপাশের পশ্চিমারা বন্ধুমহল নিয়ে জমিয়ে জীবন উপভোগ করছে।

খোলস থেকে বেরিয়ে আসতে সাহসী এক উদ্যোগ নিলেন সাকিব। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক পোস্ট দিয়ে নিজের বেড়ে ওঠার গল্প শেয়ার করলেন। সবার কাছে, বিশেষ করে এশিয়ার পরিবারগুলোতে বড় হওয়া ব্যক্তিদের কাছে নতুন করে জীবন শুরু করার পরামর্শ চাইলেন। অকল্পনীয় সাড়া এল তাঁর ওই পোস্টে। এশীয় পরিবারের অনেক সন্তানই জানালেন তাঁদের নিভৃতচারী জীবনের কথা।

বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের শেষ প্রান্তে এসে ইন্টার্নশিপ করার সময় নিশির একবার মনে হয়েছিল, এবার বোধ হয় নিজের মতো করে জীবন গুছিয়ে নেওয়া যাবে। কিন্তু না, সেখানেও বাদ সাধেন বাবা-মা। ইন্টার্নশিপের জন্য নিশি যে শহরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন, সেখানে বাবার এক বন্ধুর বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয় তাঁকে। নিশি কখন ঘর থেকে বের হচ্ছেন, কখন বাড়ি ফিরছেন, কী খাচ্ছেন, প্রতিটি বিষয় নজরদারির মধ্যে রাখেন তাঁরা। আর সপ্তাহান্তে বাবা-মা তো আসছেই তাঁকে দেখতে। নিশি স্বাবলম্বী হবেন কীভাবে?

আর সাকিবের ওপর ছিল পরিবারের প্রত্যাশার বোঝা। আত্মীয়স্বজন ছেড়ে সন্তানদের নিয়ে বিদেশ-বিভুঁইয়ে পড়ে থাকার একমাত্র কারণ সন্তানদের প্রতিষ্ঠিত করা। কাজেই সারা দিন চার দেয়ালে একাডেমিক বই নিয়ে বসে থাকতে থাকতে সাকিবের জগৎ আর বেড়ে ওঠেনি।

নিশি বা সাকিবের মতো বাংলাদেশের বেশির ভাগ ছেলেমেয়েই বড় হয় বাবা-মায়ের কড়া নজরদারির মধ্যে। তাদের বয়ঃসন্ধিকাল কাটে একাকী। শারীরিক বা মানসিক পরিবর্তনের কথা কারও সঙ্গে ভাগ করে নিতে একদম মানা করে দেওয়া হয় তাদের। নিষেধের বেড়াজালে রেখে-ঢেকে থাকতে থাকতে তাদের ব্যক্তিসত্তা কোথায় যেন হারাতে বসে। রাস্তা পার হতে গেলেও মা নয়তো বাবা হাত ধরে রাখে। সন্ধ্যার মধ্যে বাড়ি ফেরার কারফিউ নিয়েই বড় হয় তারা। স্বতন্ত্র ব্যক্তি হিসেবে তাদের ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠে না। সমবয়সী পশ্চিমা ছেলেমেয়েদের তুলনায় অনেক বেশি সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে। কারণ, সারা জীবনের সব সিদ্ধান্ত যে তাদের হয়ে মা–বাবাই নিয়েছেন।

এবার মধ্য কুড়িতে এসে যখন নিশি-সাকিবরা সত্যিকারের মুক্তির স্বাদ নিতে চাইছেন, তখন পদে পদে ভুল যেন তাঁদের হাতছানি দিয়ে ডাকছে। জীবনে প্রথমবার নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিতে যাওয়া মেয়েটা কিংবা হঠাৎ করে পাওয়া স্বাধীনতা উপভোগ করতে যাওয়া ছেলেটা সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে নিজের অজান্তেই করে ফেলেন ভুল। মানুষ চিনতে গিয়ে পড়েন বেকায়দায়। সাদা-কালো জীবনে রংধনুর অমোঘ আকর্ষণ আর মোহে পড়ে যান নিমেষেই। নিজের চিরচেনা গৎবাঁধা গণ্ডি থেকে তাড়াহুড়ো করে বেরোতে গিয়ে হোঁচট খান। এই গোলকধাঁধার জগতে নিজেকে নতুন করে গড়ে তোলার শুরুটা তিনি করবেন কী করে?

সারা বিশ্বের অর্ধেকের বেশি শিশু মানসিক, শারীরিক বা যৌন নিপীড়নের শিকার হয়। জাতিসংঘ শিশু তহবিলের (ইউনিসেফ) তথ্য অনুযায়ী, নিপীড়নের শিকার শিশুদের ৬৪ শতাংশই দক্ষিণ এশিয়ার নাগরিক। ৫ থেকে ১৪ বছর বয়সী শিশুদের সহিংসতার মুখোমুখি হওয়ার হার বেশি। বাংলাদেশের ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী মেয়েদের ৪৭ শতাংশ পরিবারের সদস্য বা স্বামীর দ্বারা শারীরিক বা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। বাদ যায় না ছেলেরাও।

এশিয়াজুড়ে এই চিত্র খুব স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তন করতে না পারলেও নিজের শাসনে যথাসম্ভব সুরক্ষিত রাখার তাগিদ থেকেই অনেক বাবা-মা সন্তানদের আগলে রাখতে চান। কিন্তু তাঁদের এই আগলে রাখার মানসিকতা থেকে সন্তান যে পরনির্ভরশীল হয়ে পড়ছে, সেটা হয়তো তাঁরা বুঝতেও পারছেন না। বাবা-মা তাদের যেভাবে বড় করেছেন, তারাও তেমন পাখির বাচ্চার মতো করে ডানার নিচে যত্ন করে লুকিয়ে রাখতে চান সন্তানদের। আর তাতেই ঘটে বিপত্তি। সিদ্ধান্ত দেওয়ার জন্য বাবা-মা তো চিরদিন পাশে থাকবে না, এটা বাস্তবতা।

শৈশবে শিশু যেমন মা–বাবার ওপর নির্ভরশীল, ঠিক তেমনি বার্ধক্যে বাবা-মা সন্তানের ওপর অনেকটাই নির্ভর করেন। বাবা-মা যেমন নিজের সর্বস্ব দিয়ে সন্তানকে ভালো রাখতে চান, ঠিক তেমনি তাঁদেরও ভীষণ ভালোবাসে বাচ্চারা। কিন্তু অতিরিক্ত রক্ষণশীলতার ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে অপরিচিত দুনিয়ার সঙ্গে তাল মেলাতে না পারার দায় অযাচিতভাবেই বাবা-মায়ের ওপর এসে বর্তায়। সন্তানদের সঙ্গে তাঁদের দূরত্ব তৈরি হয়।

অপহরণ, গুম, ধর্ষণ, খুন, লুটতরাজের এই রাজ্যে সন্তানদের নিয়ে দুশ্চিন্তা করা খুব স্বাভাবিক। কিন্তু সে দুশ্চিন্তা যদি সন্তানের ভবিষ্যতের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়, তবে পরিণাম ভয়াবহ। লাটাই থেকে সুতো একটু একটু ছাড়লে ঘুড়ি আরাম করে ওপরে উড়তে পারে। আর লাটাই থেকে যদি সুতো একবারে পুরোটা খুলে যায়, বেসামাল ঘুড়ি এখানে-ওখানে গুঁতো খেয়ে হারিয়ে যায় কোনো এক অন্ধকারে।

কাজেই সন্তানকে কিছু ক্ষেত্রে তার মতো করে সিদ্ধান্ত নিতে দেওয়া উচিত। ভুল করলে তাকে বুঝিয়ে বলতে হবে কেন তার সিদ্ধান্ত ভুল ছিল, এ সিদ্ধান্তের ফলাফল কী হতে পারে। চাপিয়ে দেওয়ার চেয়ে বরং শিখিয়ে দেওয়া অনেক জরুরি। এতে সন্তান নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ ভাবতে শিখবে, নিজেকে নিয়ে হীনম্মন্যতায় ভুগবে না। আত্মনির্ভরশীল শিশু আত্মবিশ্বাসী হয়ে সফলতার দিকে এগিয়ে যাওয়ার পথ করে নিতে শেখে।