লালবাগ কেল্লায় ঈদের আনন্দ

ঈদের পরদিন লালবাগ কেল্লা। পরী বিবির সমাধি।  ছবি : সাইফুল ইসলাম
ঈদের পরদিন লালবাগ কেল্লা। পরী বিবির সমাধি। ছবি : সাইফুল ইসলাম

বেশ একটা প্রাণ জুড়িয়ে দেওয়া বাতাস। ঈদের পরদিন লালবাগের কেল্লায় আসা মানুষ বেশ স্বস্তিতে আছে। মাথার ওপর নেই প্রবলপ্রতাপী সূর্য। বছরের এ সময় দুপুরের সূর্য থেকে যেন আগুন বের হয়। কিছুক্ষণ ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হয়েছে বলে তিনি এখন মেঘের আড়ালে রয়েছেন। তাতেই রক্ষে।

ঈদের ছুটিতে লালবাগের কেল্লা খোলা থাকে। ভ্রমণপিয়াসী মানুষ এখানে আসেন একখণ্ড শান্তির অন্বেষায়। বিশাল এ কেল্লায় এসে হয়তো নিয়ে যান মোগল আমলের স্বাদ। স্থাপত্যগুলো কি তাঁদের সঙ্গে কথা বলে?

যাঁরা এসেছেন, তাঁদের মধ্যে তিন তরুণীকে দেখা গেল একই ধরনের সালোয়ার-কামিজ পরেছেন। আরেকটা তরুণের দলে প্রত্যেকেই পরেছেন একই রকম কালো টি-শার্ট এবং প্রত্যেকের চোখে অবধারিতভাবে কালো সানগ্লাস। এই তরুণদের একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এই কেল্লা কে বানিয়েছে, জানেন?’

‘জানুম না ক্যান, শায়েস্তা খান।’ সেই সঙ্গে যোগ করেন, ‘হ্যার মাইয়ার কব্বরও তো এইখানেই।’

অথচ কেল্লায় ঢোকার পরই এক জায়গায় লেখা আছে কেল্লা নির্মাণের ইতিহাস। প্রায় কেউই সেদিকে চোখ রাখে না।

সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা ধারণা প্রচলিত, এই কেল্লা নির্মাণ করেছিলেন শায়েস্তা খান। হ্যাঁ, সেই শায়েস্তা খান, যাঁর আমলে টাকায় ৮ মণ চাল পাওয়া যেত। আসলে কেল্লার ভেতরে শায়েস্তা খানের মেয়ে পরী বিবির সমাধি আছে বলেই ধারণাটা ছড়িয়েছে। আসল ইতিহাস একটু ভিন্ন রকমের।

যাঁর সঙ্গে এই কেল্লার নাম জড়িত, তিনি মুহাম্মদ আজম শাহ। জনশ্রুতি আছে, মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের ছেলে আজম শাহ বাবার কাছে আবদার করেছিলেন, তাঁকে যেন বাংলার সুবাদার করে পাঠানো হয়। পুত্রের আবদার রেখেছিলেন সম্রাট। ১৬৭৮ সালে তাঁকে সুবাদার করে পাঠানো হয় ঢাকায়। আওরঙ্গজেবের এই পুত্র ছিলেন দাম্ভিক। ঢাকার সুবাদারি পেয়ে শাহজাদা আজম বুড়িগঙ্গার তীরে একটি দুর্গ নির্মাণ করা শুরু করলেন, নাম রাখলেন ‘কিলা আওরঙ্গবাদ’। কিন্তু এই নামে কেউ আর ডাকত না কেল্লাটিকে। লালবাগ এলাকায় কেল্লাটি হওয়ায় সবাই লালবাগের কেল্লা বলেই ডাকা শুরু করে।

আজম শাহ দুর্গটি নির্মাণ করা শুরু করেছিলেন। কিন্তু সম্রাটের আদেশে পরের বছরই তাঁকে ঢাকা ত্যাগ করতে হলো। দ্বিতীয়বারের মতো শায়েস্তা খান এলেন সুবাদার হয়ে (১৬৭৯ সালে। প্রথমবার ছিলেন ১৬৬৩ থেকে ১৬৭৩ সাল পর্যন্ত)। শায়েস্তা খানকে আজম শাহ অনুরোধ করেছিলেন দুর্গটির নির্মাণকাজ শেষ করার জন্য। বলা হয়ে থাকে, এই আজম শাহের সঙ্গেই বিয়ে হওয়ার কথা ছিল পরী বিবির। কিন্তু পরী বিবি অকালে প্রাণ হারালে শায়েস্তা খান দুর্গটিকে অপয়া বলে মনে করেন। দুর্গ নির্মাণ শেষ করেননি শায়েস্তা খান। কিন্তু কন্যা পরী বিবির সমাধির ওপর একটি স্থাপনা গড়ে তোলেন তিনি।

বলে রাখা ভালো, শায়েস্তা খান ছিলেন সম্রাট জাহাঙ্গীরের পত্নী নূরজাহানের ভাই আসফ খানের ছেলে। আসফ খানের বোন মমতাজ মহলকেই বিয়ে করেছিলেন সম্রাট শাহজাহান। অর্থাৎ আওরঙ্গজেবের মামা ছিলেন শায়েস্তা খান।

ঈদের আনন্দ নিয়ে যাঁরা লালবাগের কেল্লা দেখতে এসেছেন, যাঁরা মনের আনন্দে ছুটে যাচ্ছেন হাম্মামখানা, পরী বিবির মাজার, মসজিদ, সুড়ঙ্গপথ থেকে শুরু করে কেল্লার নানা দিকে, এই ইতিহাস না জানলেও তাতে তাঁদের ভ্রমণের আনন্দ কিছুমাত্র কমছে না।