প্রশ্নবোধক চিহ্ন এল কেমন করে

কোথা থেকে এল প্রশ্নবোধক চিহ্ন? এটাই বড় একটা প্রশ্ন। ছবি: সংগৃহীত
কোথা থেকে এল প্রশ্নবোধক চিহ্ন? এটাই বড় একটা প্রশ্ন। ছবি: সংগৃহীত

১.

বাক্যের শেষে প্রশ্নবোধক (?) চিহ্নকে দেখলেই ডর লাগে, মাঝেমধ্যে পিলে চমকে ওঠে। দেখতে লাগে ক্রুদ্ধ সাপের ফণা, যেন আচমকা ছোবল দেওয়ার জন্য ওত পেতে থাকা গোক্ষুর। ফণাতে অঙ্কিত থাকে গবাদির ক্ষুর যে কারণে গোক্ষুর, এ কথা বুঝি। কিন্তু গরু যতই নিরীহ হোক আর তার ক্ষুর আঁকা থাক সাপের ফণায়, গোক্ষুর নিরীহ নয়, এর এক ফোঁটা বিষে হাল্লাক হতে পারে দশাসই ১০ জন।

কেউ কেউ একটা সাপের জায়গায় দু–তিনটে, কখনো বা একগাদা সাপ এনে জড়ো করেন বাক্যের শেষে। এসব সাপের পেছনে কখনো আশ্চর্যবোধক লাঠিও থাকে, যেমন ‘কী বলতে চান আপনি???!!!!’ এসব লাঠির ধর্ম ভিন্ন, এরা সাপকে মারে না, তার রোষও কমায় না বরং সাপের গায়ে যাতে কেউ টোকা না দেয়, সে জন্য খবরদারি করে।

চিহ্নগুলো দেখে প্রায় মনে হয়, এরা চরাঞ্চলের দুই ভীতি, ধানখেতের সাপ আর দখলদারের লাঠি। এ দুটি একসঙ্গে হলে ভয়ের মাত্রা বেড়ে যায়, তটস্থ হয়ে ভাবি, এখন কোথায় পালাই! ‘মা ধরণি দ্বিধা হও’ বলে যতই ফাটল খুঁজি, অধমের পরিত্রাণের জন্য ধরণি দ্বিধা হয় না। ফলত সাপেরা ছোবল দেয়, লাঠিরা পেটাতে থাকে ‘মম’ গবাদি-নিরীহ দেহ। এরপরও বেঁচে থাকি পরার্থ সম্বল করে, কারণ বেঁচে না থাকলে বান্ধবের সাপখেলা শেষ হয়ে যাবে, থাকবে না লাঠিবাজিও।

কিছু জানতে হলে, প্রশ্ন করতে হলে, ব্যাকরণমতে বাক্যের শেষে প্রশ্নবোধক চিহ্নটা থাকতেই হবে, আমরা তা পছন্দ করি আর না–ই করি। স্প্যানিশ ভাষায় তো প্রশ্নকে পোক্ত করার জন্য বাক্যের শুরুতে থাকে এক ফণা আর শেষে থাকে আরেক ফণা। Do you love me? এই বাক্যের স্প্যানিশ রূপ হবে Me amas? যার একটা ফণা নিচের দিকে, আরেকটা ফণা ওপরের দিকে। অর্থাৎ পাতালে যাও আর জমিনে থাক, রেহাই নেই, সাপ কামড়াবেই, আশী বিষের দংশন থেকে মুক্তি নেই কারও। ভালোবাসার কথা জিজ্ঞাসা করতে গিয়ে যদি উল্টাসিধা ‘আগায় ফণা আর পাছায় ফণা’ লাগাতে হতো স্বীয় ভাষায়, তবে নিশ্চিত নিরীহ বাঙালি হয় ভাষাত্যাগী হতো, নয় দেশত্যাগী!

জীবন থেকে অনেক প্রশ্ন কমিয়ে ফেলতে দেখেছি আমার এক ব্যর্থ প্রেমিক বন্ধুকে। প্রচণ্ড মানসিক চাপের কারণে তার দেহমন এমনভাবে বিধ্বস্ত হয়েছিল যে সে একরঙা বিছানার চাদর ছাড়া শুতে পারত না, মাল্টিকালার চাদর দেখলে চোখ ব্যথা করত তার। চকরাবকরা পর্দাগুলো নামিয়ে বিধবা বোনের একরঙা শাড়ি লটকে দিয়েছিল সেখানে। মেঘ গুড়গুড় করে উঠলে দুহাতে পেট চেপে ধরত সে, বিজলি চমকালে বুক চেপে ধরত। তার এই অবস্থাটা ছিল ‘সিমাব আকবরাবাদি’র একটি বিখ্যাত শেরের মতো…

মুহাব্বাতমে ইক এয়সা ওয়াক্ত ভি আতা হ্যায় ইনসাঁ পার
সিতারোঁ কি চমক্‌সে চোট লাগতি হ্যায় রগ-এ-জাঁ পার

একটু সুস্থ হয়ে সে যে চিঠিগুলো লিখত, তার ফিরে পাওয়া প্রেমিকাকে তাতে কোনো প্রশ্ন থাকত না। সে মনে করত, প্রশ্ন করলে কষ্ট হয় মানুষের, বিশেষত নারীদের। আমাকে বলত জীবন থেকে প্রশ্ন কমিয়ে ফেলতে। ‘তুমি কেমন আছ?’ এই সামান্য কথাটাকেও ঘুরিয়ে লিখত, ‘নিশ্চয়ই ভালো আছ প্রিয়া।’ এতে যেন একটি সর্পকে হত্যা করতে পারত সে। কোনো উত্তর সে ‘না’ দিয়ে শুরু করত না। ‘কেন’ শব্দটি ব্যবহার করত না পারতপক্ষে। বলত না, ‘কথা দিয়েও কেন তুমি আসোনি সেদিন?’ বরং বলত, ‘সেদিন তুমি ব্যস্ত ছিলে, জানি চেষ্টা করেও আসতে পারনি, আজ তো এসেছ, অথচ আসার কথা ছিল না তোমার।’

২.

গ্রিক ও লাতিন ভাষায় শুরুর দিকে প্রশ্নবোধক চিহ্ন বলে কিছু ছিল না। লেখাগুলো হতো অবিরাম, কোনো ফাঁকফোকর না রেখে ঠাসবুনটের ইটের দেয়ালের মতো। নিউ টেস্টামেন্ট বাইবেলের একটি অংশও অপ্রতুল বিরামচিহ্ন–সংবলিত এমনই বুনট। প্রশ্নবোধক বাক্য সাধারণ বাক্য থেকে স্বতন্ত্র, তাই কিছু একটা প্রতীক দিয়ে সেটা বোঝানোর চেষ্টা হয়েছে অতীতের ভাষাগুলোতে। বর্তমানের ফণাধারী প্রশ্নচিহ্ন আগে ছিল অপেক্ষাকৃত কম উগ্র। অষ্টম শতকের দিকে ইংরেজ কবি আলকুইন কিছু ব্যাকরণ বই লিখেছিলেন যাতে বিরামচিহ্নের ওপর কিছু নির্দেশনা ছিল। তখন নিচে একটি ডট দিয়ে তার ওপরে বিজলির প্রতীক আঁকা হতো দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য। এর পেছনে যুক্তি ছিল, প্রশ্নকারীর গলা স্বাভাবিক গলার চেয়ে একটু চড়া হয়ে থাকে।

অবশ্য মিষ্ট কথা বলার সময়েও গলা চড়ে যেতে দেখেছি আমাদের গ্রামীণ যাত্রামঞ্চে। তখন মাইক্রোফোন, লাউডস্পিকার ছিল না যাত্রায়, ছিল না জেনারেটরও, হ্যাজাক বাতি জ্বালিয়ে মঞ্চ আলোকিত করা হতো। দড়ি আর কপিকল দিয়ে বাতিগুলো রাখা হতো দরকারি উচ্চতায়। যাত্রা-প্যান্ডেলের লোকজন যাতে স্পষ্ট শুনতে পায়, সে জন্য গলা চড়িয়ে নায়ককে বলতে হতো ভালোবাসার সংলাপ, ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি সখিনা।’ নইলে নায়ক যদি নম্র গলায় বলত ‘ভালোবাসি’, মানুষ তখন শুনত ‘গয়া-কাশী।’

কেউ কেউ মনে করেন, প্রশ্নবোধক চিহ্নের জন্ম হয়েছে প্রাচীন মিসরে। মিসরীয়রা খুব বিড়াল ভালোবাসত। গৃহকল্যাণের নিমিত্তে ‘বাস্তেত’ নামক উপাস্য এক বিড়াল-দেবতাও ছিল তাদের। গবেষণাকারীদের দর্শন ছিল, বিড়ালের ভেতর যখন জিজ্ঞাসু মনোভাব তৈরি হয়, তখন তার লেজ বাঁকা হয়ে রূপ নেয়, প্রশ্নবোধক চিহ্নের আকারে। আবার বিস্মিত হলে বা ভয় পেলে তা ওপরের দিকে খাঁড়া হয়ে যায়। অতএব প্রশ্নচিহ্ন ও আশ্চর্যবোধক চিহ্ন—দুটিই পাওয়া গেছে বিড়ালের লেজের অভিব্যক্তি থেকে।

কিন্তু এই যুক্তি আবেগনির্ভর। কারণ, তখন লিখিত ভাষার চল শুরু হয়নি। যে যুক্তিটা মোটামুটি গ্রহণযোগ্য, সেটা লাতিন ভাষার এক মজার বিবর্তন। বাক্যের শেষে সোজাসুজি বানান করে লেখা হতো কোয়েস্টিও (Quaestio) অর্থাৎ এটি একটি প্রশ্ন। Quaestio-কে সংক্ষেপ করে মধ্যযুগের পণ্ডিতেরা QO লেখা শুরু করলেন। পরে আরও সংক্ষেপ করতে গিয়ে 'Q' অক্ষরটিকে চড়িয়ে দেওয়া হলো ‘O’ অক্ষরের ওপরে। কালান্তরে সৌন্দর্যবোধের কারণে ‘O’ অক্ষরটি ক্রমে ছোট হতে হতে বিন্দুতে পরিণত হলো। এখন প্রশ্নবোধক (?) বা আশ্চর্যবোধক (!) চিহ্নের পরে আর নতুন করে দাঁড়ি দেওয়ার দরকার হয় না, কারণ এতে যে বিন্দু রয়েছে, তাতেই দাঁড়ি নির্দেশিত হয়। সপ্তম শতক থেকে শুরু করে প্রশ্নের এই সুস্থিত ফণার আদলে আসতে বিংশ শতাব্দী চলে এসেছে।

কলেজে ক্লাস নেওয়ার সময় আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার একবার বলেছিলেন, বিবর্তন অনেক ক্ষেত্রেই অসহ্য রকম ধীর, ‘নৌকোর একতলা পাল থেকে দুইতলা পালের চিন্তায় আসতে মানুষের সময় লেগেছে ৫০০ বছর।’ আর প্রশ্ন–সংবলিত সর্পফণা তৈরি করতে আমাদের লেগে গেছে ১২০০ বছর। কিন্তু যতই স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত হোক এই ফণা, এর ব্যবহার সীমিত করতে পারলে জীবন অনেক সুস্থির হবে, ভালোবাসার মানুষকে হারানোর শঙ্কা কমে যাবে।

লেখক: কিউরেটর (টেক), সায়েন্স ওয়েসিস জাদুঘর, রিয়াদ, সৌদি আরব।