
বাংলা ভাষায় ঠিকভাবে কথা বলছি তো আমরা? আমাদের অনেকেরই উচ্চারণে সমস্যা থাকে। থাকে আঞ্চলিকতার টান। যেমন কেউ বলতে পারেন, ‘ডাকা শহরের কবর কী?’—আপনি হয়তো বুঝতে পারবেন না তিনি বলতে চাইছেন ‘ঢাকা শহরের খবর কী?’ খবরকে কবর দেওয়ার ঘটনা কম ঘটে না, উচ্চারণে অল্পপ্রাণ আর মহাপ্রাণের গোলমালের কারণে।
অনেক অঞ্চলে ছড়ানো বাংলাদেশ। অঞ্চল থাকলে আঞ্চলিকতা থাকবেই। অঞ্চলের ভাষাটাই নিজের ভাষা হয়ে উঠবে। মা যে ভাষায় কথা বলে, সেটাই মাতৃভাষা। প্রমিত ভাষার দরকার পড়ে বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ যেন সবাই সবার ভাষা বুঝতে পারে, তা নিশ্চিত করতে। চাকরির সাক্ষাৎকারের সময়, কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন বন্ধুদের সঙ্গে যখন পরিচয় হয়, অনেকে নিজের আঞ্চলিক ভাষার কারণে বিব্রত বোধ করেন। তাই প্রমিত উচ্চারণ যদি একটু চর্চা করা যায়, ক্ষতি কী?
বাংলা উচ্চারণের সময় কিছু ব্যাপারে আমরা হোঁচট খাই। ঠিকঠাকমতো উচ্চারণ শেখানোর কিছু স্কুল আছে। আবৃত্তি প্রশিক্ষণকেন্দ্রগুলোয় গেলে উচ্চারণ সম্পর্কে কোর্স করা যায়। এখানে উচ্চারণের কিছু বিষয় নিয়ে কথা বলা হলো। ভাবার কোনো কারণ নেই, সমস্যার সবকিছু নিয়েই কথা বলছি আমরা। অল্প কিছু বিষয়ে কথা বলা হচ্ছে, ভাষা ও উচ্চারণ নিয়ে আগ্রহ তৈরি করার জন্য। এরপর নিজে নিজেই উচ্চারণের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠবেন।
১. জ নিয়ে জেরবার
সমস্যা হয় জ নিয়ে। বাংলায় বর্গীয় জ যেমন আছে, তেমনি আছে অন্তস্থ য। এই অন্তস্থ য-এর উচ্চারণ একসময় ছিল ‘ইয়’। এখন কিন্তু দুই জ-এর উচ্চারণই জ। অর্থাৎ ইংরেজি j-এর মতো। একেবারেই z-এর মতো নয়। জবাব এবং যম, জামদানি আর যশরাজ—এখানে ‘জ’ বা ‘য’—দুটোরই উচ্চারণ ‘জ’ বা j । ব্যতিক্রম থাকে শুধু বিদেশি শব্দে। যেসব বিদেশি শব্দে z উচ্চারণ আছে এবং তা বাংলায় সংরক্ষণ করা হয়েছে, তা z-এর মতোই উচ্চারিত হয়। যেমন: zoo-কে বলি জু।
২. চ নিয়ে চাঁছাছোলা কথা
চ নিয়ে রয়েছে যন্ত্রণা। অনেকেই এই সুন্দর বর্ণটিকে s-এর মতো উচ্চারণ করেন। চাচা না বলে বলেন sasa। চাল না বলে বলেন saল। প্রমিত বাংলায় চ-কে s উচ্চারণ করা যায় না। একটু চেষ্টা করলেই এই সমস্যা থেকে উদ্ধার পাওয়া সম্ভব। জিহ্বাটা মুখগহ্বরের কোথায় গিয়ে স্পর্শ করছে, সেটা জানা থাকলেই চ উচ্চারণটি করা সহজ।
৩. ছবি কখনো সোবি নয়
ছ নিয়েও তো একই সমস্যা। ছবিকে যদি কেউ উচ্চারণ করে soবি, তাহলে কেমন লাগবে? এই উচ্চারণটা অনেকেই করে থাকেন। ছাগলকে saগোল, ছাতাকে saতা। এই সমস্যাও অনুশীলনে কেটে যায়।
৪.শ কি সবখানে সহজ?
বাংলায় তিনটি শ আছে। তালব্য, মূর্ধন্য এবং দন্ত্য। কিন্তু উচ্চারিত হয় দুটি। মূলধ্বনি হিসেবে উচ্চারিত হয় ‘শ’। যেমন সবিশেষ। এখানে উচ্চারণ কিন্তু ‘শ’। তবে কোথাও কোথাও শ (Sh) কিন্তু স (S)-এর মতো উচ্চারিত হয়। সেটা কোথায় হয়? যখন শ সহধ্বনি হয়ে যায় অর্থাৎ অন্যধ্বনির প্রভাবে সেই শ টা ‘স’ বা s-এর মতো হয়ে যায়। ত, থ, ন, র, ল—এইসব দন্ত্য বা দন্ত্যমূলীয় বর্ণের সঙ্গে স বা শ যখন সংযুক্ত অবস্থায় উচ্চারিত হয়, তখন তার উচ্চারণ হয়ে যায় রীতিমতো স (S)-এর মতো। যেমন: মস্ত, দরখাস্ত, সুস্থ, উপস্থিত, স্নেহ, শ্লোক, শ্রোতা, শ্রেষ্ঠ ইত্যাদি।
৫. তিন র-এর রগড়
বাংলা ভাষায় ‘র’ তিনটি। র, ড়, ঢ়। তিনটিরই উচ্চারণ আছে। কিন্তু ইদানীং গানে, সংলাপে দেখা যাচ্ছে সবখানেই ‘র’ উচ্চারিত হচ্ছে। আবার ইংরেজির প্রভাবে কোথাও কোথাও ‘র’ হারিয়ে গিয়ে হয়ে যাচ্ছে ‘ড়’। কেউ ‘ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার’কে বলছে ‘ঝরের রাতে তোমার অভিসার’; কেউ বলছে ‘ঝড়ের ড়াতে তোমাড় অভিসাড়।’ ‘ঢ়’ তো হারিয়ে যেতে বসেছে। অথচ আষাঢ় শব্দটি উচ্চারণ করতে হলে ঢ় লাগবেই। সতর্ক হলেই র, ড়, ঢ় উচ্চারণ করা কঠিন কিছু নয়। শব্দের মধ্যে চর্চার শুরুতে ড়-এর জায়গায় ড, ঢ়-এর জায়গায় ঢ উচ্চারণ করতে করতেও একসময় ড় আর ঢ় ঠিকভাবে উচ্চারণ করা যায়।
৬.অল্পপ্রাণে কত প্রাণ
অল্পপ্রাণ মহাপ্রাণ শব্দে ভুল হয় আঞ্চলিকতার কারণে। আপনি যদি খবর না বলে বলেন কবর, ঘাতক না বলে বলেন গাতক, ঘুড়ি না বলে বলেন গুরি, ছালা না বলেন বলেন চালা, ঝুড়ি না বলে বলেন জুরি—তাহলে কেমন হবে? এই সমস্যা থাকে অনেকের। অল্পপ্রাণ-মহাপ্রাণের সমস্যা কাটিয়ে না উঠলে উচ্চারণের সমস্যা কাটবে না।
খ-ছ-ঠ-থ-ফ-ঘ-ঝ-ঢ-ধ-ভ এই দশটি বর্ণকে যদি আমরা আলাদা করে ফেলি এবং তাদের যথাযথ অনুশীলন করি, তবে প্রাণগত সমস্যার উত্তরণ ঘটবে। তখন ঘরকে গর, খালকে কাল বলার প্রবণতা আর থাকবে না।
৭. অ কেন ও হয়
‘অ’ কোথায় ‘অ’ থাকছে, কোথায় ‘ও’ হয়ে যাচ্ছে, সেটাও দারুণ এক ব্যাপার। শব্দের শুরুতে, মধ্যে, শেষে—সব জায়গাতেই ‘অ’-এর পরিবর্তিত উচ্চারণ হতে পারে। যেমন: শব্দের শুরুতে ও হচ্ছে, এমন কয়েকটি শব্দ: গতি, কবিতা, মহীয়ান।
শব্দের শুরুতে অ থাকছে, এমন কয়েকটি শব্দ: খচ্চর, চরকা, তরঙ্গ।
সূত্রটা হলো, কোনো শব্দের দ্বিতীয় বর্ণের সঙ্গে ই-কার, ঈ-কার, উ-কার, ঊ-কার, ঋ-কার, জ্ঞ, য-ফলা থাকে, তাহলে প্রথম বর্ণের উচ্চারণ ও-কারান্ত হবে। যেমন: করুণ, ময়ূর, মসৃণ, যজ্ঞ, জন্য। এগুলো না থাকলে অ অবিকৃত থাকবে। আসলে অ-এর ও হয়ে ওঠার সূত্রগুলো জানা থাকলে উচ্চারণের ভুল আর থাকে না।
মাঝে আর শেষেও কখনো কখনো অ পরিবর্তিত হয়ে ‘ও’ হয়। তারও রয়েছে সূত্র।
৮. বড় ‘ব্যাদোনা’ নিয়ে ‘হ্যামোন্ত’ দেখি!
বর্ণ তো একটা—এ। উচ্চারণ দুটো—এ, অ্যা। যেমন: আমরা বলি এক (অ্যাক), অথচ ‘একটি’ উচ্চারণের সময় ‘এক্টি’ বলি। তাই ‘এ’-এর উচ্চারণের ব্যাপারে বিভ্রান্তি দেখা দেয়। ‘অ্যা’ আমাদের উচ্চারণে আছে, বচনে আছে, কথায় আছে, কিন্তু লেখায় নেই। ‘এ’-এর উচ্চারণের বিষয়ে পাকাপোক্ত কোনো নিয়ম জানা নেই। কিন্তু বোঝার সুবিধার জন্য প্রাথমিকভাবে কিছু সাধারণ সূত্র বা নিয়ম আমরা দাঁড় করাতে পারি।
এ-কারের পরে যদি ই-কার, উ-কার কিংবা এ-কার থাকে, তাহলে সাধারণত আগে থাকা এ-কার বিকৃত হয় না বা অ্যা-কার হয় না। যেমন: খেলা (খ্যালা) কিন্তু খেলি (খেলি), দেখা (দ্যাখা) কিন্তু দেখুন (দেখুন), ভেংচানো (ভ্যাংচানো) কিন্তু ভেংচি (ভেংচি)। এ রকম আরও কিছু সূত্র আছে, যা শেখার সময় আয়ত্ত করে নেওয়া যাবে। তবে সংস্কৃত থেকে আসা শব্দগুলোর প্রায় ৯৫ শতাংশের মধ্যেই এ কখনো অ্যা হয় না। প্রেম্ কিন্তু প্র্যাম নয়, বেদ্ কিন্তু ব্যাদ নয়, মেদ্ কিন্তু ম্যাদ নয়।
হেমন্ত (হেমন্তো) কিন্তু হ্যামন্তো নয়, বেগ্ কিন্তু ব্যাগ নয়, চেতনা (চেতোনা) কিন্তু চ্যাতনা নয়।
৯. দরদ থাকুক ভাষার জন্য
কথা যখন বলব, তখন যেন ভাষার প্রতি ভালোবাসা থাকে। ইংরেজি উচ্চারণ তো আমরা খুব সতর্কভাবেই করি। আমরা কি প্রেসিডেন্টকে ফ্রেসিডেন্ট বলি? রিফ্রেশমেন্টকে রিপ্রেশমেন্ট বলি? তাহলে কেন আমরা বেদনাকে ব্যাদোনা, চেতনাকে চ্যাতনা বলব? কেন আমরা দেশকে বলব দ্যাশ?
একটু খেয়াল করে যদি আমরা উচ্চারণ করি, তাহলে এই ভুলগুলো হবে না কখনো।
১০. হাতের কাছে অভিধান আছে
বাংলা উচ্চারণের অভিধান তো কিনতে পাওয়া যায়। কোনো উচ্চারণ নিয়ে মনে একটু সংশয় এলেই অভিধানের পাতা ওল্টাতে পারি আমরা। দেখে নিতে পারি উচ্চারণটা। যেমন: লেখা হচ্ছে দলভুক্ত বা দলবদ্ধ। উচ্চারণ করছি আমরা দলোভুক্ত বা দলোবদ্ধ। আবার যখন বলছি দলবল, তখন কিন্তু দলো হবে না, বলো হবে না, তখন বলব দল্বল্। কেন এমন উচ্চারণ করব, তাও কিন্তু ব্যাকরণের বই ঘাঁটলেই পাওয়া যাবে।