এতটা উদাসীন কেন বাবা

অনেকে বলেন, সন্তানের কাছে প্রত্যেক বাবা সুপারম্যান। কিন্তু আমার কাছে আমার বাবা তা নন। বাবাকে আমি পেয়েছি সংসারবিবাগী একজন মানুষ হিসেবে, যিনি জীবনের প্রতি চরম উদাসীন। সংসারের চেয়ে সাহিত্যচর্চা, প্রকাশনা, কীর্তন, মাজার শরিফে যাওয়ার প্রতি ছিল বাবার টান। তাঁর অসুস্থতা, অস্বাভাবিক মানসিক অবস্থা ও মাদকাসক্তির কারণে মা-বাবার দীর্ঘ দাম্পত্য জীবনেও বিবাহবার্ষিকী উদ্‌যাপন তো দূরে থাক, অন্য কোনো সুখকর মুহূর্তের স্মৃতিও আমাদের নেই!

ছোটবেলা থেকে বাবা সম্পর্কে পাড়া–প্রতিবেশীদের কাছে নানা কটু কথা শুনে আমরা তিন ভাই বড় হয়েছি। বাবার শারীরিক ও মানসিক অস্বাভাবিক আচরণ নিয়ে আমার পরলোকগত দাদুরও ছিল অন্তহীন দুশ্চিন্তা। বাবার চরম উদাসীনতা আমার মাকে এখনো খুব কাঁদায়। আমাদের জীবন, পড়ালেখা নিয়ে দাদুর উৎকণ্ঠা ছিল। কিন্তু বাবা আমাদের নিয়ে ভাবতেন না। যখন প্রতিবেশী ও বন্ধুদের বাবারা সন্তানদের ভবিষ্যৎ ভেবে অস্থির হতেন, তখন বেশ আক্ষেপ হতো! যে বয়সে বাবারা সন্তানের ভবিষ্যৎ চিন্তায় অস্থির থাকেন, আমাদের সেই বয়সে বাবার মানসিক রোগের চিকিৎসক দেখানো আর সুস্থতার কথা চিন্তা করতে হয়েছে। তবে বাবাকে নিয়ে চারপাশে এত কটু কথা শুনে আর বিরূপ পরিবেশে বড় হয়েও আমরা লক্ষ্যচ্যুত হইনি। যে যার মতো পড়াশোনা করেছি, উচ্চশিক্ষা নিয়েছি।

আমি এখন দুই সন্তানের বাবা। ছেলেদের আবদার যখন পূরণ করি কিংবা ছেলের দুষ্টুমিতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠি, তখন আমার স্মৃতিতে বাবার সঙ্গে এমন কোনো স্মৃতি আছে কি না, মনে করার চেষ্টা করি। যখন সন্তানের অসুস্থতায় দুশ্চিন্তায় প্রহর কাটে, তখনো ভাবতে ইচ্ছা করে, আমার বাবাও কি আমাকে নিয়ে উৎকণ্ঠায় এমন রাত পার করেছেন? মাঝেমধ্যে এই স্মৃতিগুলো নিয়ে বাবাকে প্রশ্ন করতে ইচ্ছা করে! কিন্তু আজও করা হয়নি।

বাবার দোষের কথা বলে শেষ হবে না। তবে বাবা হলেন নিভৃতচারী একজন শিল্প-সাহিত্যপ্রেমী ও সংগঠক। কুসঙ্গ, মাদকাসক্তি, অসুস্থতার কারণে পরিবারে ভূমিকা রাখতে পারেননি। কিন্তু অনেক খেটে খাওয়া মানুষের কাছে বাবা খুব পছন্দের সদাচারী একজন মানুষ। অর্জিত ডাক্তারি বিদ্যায় এখনো তিনি মানুষের সেবা করে চলেছেন। বাবা হয়েছি বলেই বাবাকে খুব উপলব্ধি করি! শুধু ভাবি, কেন সংসারের প্রতি এতটা উদাসীন হলেন আমার বাবা!