চার সন্তান নিয়ে অসহায় নূরজাহান

রাতে রান্নার মতো কিছুই ছিল না। তাই বিকেলের দিকে তরকারির জন্য বাজারে যান তিনি। ১০ মিনিট পর খবর আসে, গুলিবিদ্ধ হয়েছেন তিনি। দ্রুত অ্যাম্বুলেন্স জোগাড় করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পথে তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। তরকারি আনা তো হলোই না, রাতের খাবারও খাওয়া হলো বাড়ির কারও।
স্বামীর মৃত্যুর আগ মুহূর্তের ঘটনার কথা বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন কক্সবাজারের চকরিয়া পৌরসভার মিয়াজীপাড়া গ্রামের জাকের হোছাইনের (৪৮) স্ত্রী নূরজাহান বেগম।
কোনো রকমে নিজেকে সামলে নিয়ে নূরজাহান বেগম বলেন, যিনি হরতাল-অবরোধে গোলাগুলির ভয়ে ছেলেমেয়েদের বিদ্যালয়ে যাওয়া বন্ধ করে দেন, তিনিই নোংরা রাজনীতির শিকার হয়ে মারা গেলেন।
গত ২৯ নভেম্বর সন্ধ্যায় আওয়ামী লীগ-পুলিশ এবং বিএনপির সংঘর্ষের ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান জাকের। তাঁর স্ত্রী ও মা জানান, জাকের রাজমিস্ত্রির কাজ করে সংসার চালাতেন। বর্তমানে চার সন্তান নিয়ে অসহায় হয়ে পড়েছেন নূরজাহান।
জাকের হোছাইনের বৃদ্ধা মা সোফিয়া খাতুনও ছেলের শোকে নির্বাকপ্রায়। কাঁপা গলায় তিনি বলেন, ‘মাত্র এক গন্ডা জায়গার ঘর-ভিটাটা ছাড়া জাকেরের আর কোনো সম্পদ নেই। এখন তার বউ-বাচ্চারা কীভাবে চলবে আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না।’
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গত ২৯ নভেম্বর বিকেল তিনটায় চকরিয়া শহীদ আবদুল হামিদ পৌর বাসটার্মিনালে উপজেলা যুবদলের সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুল হালিমের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। বিএনপির নেতা-কর্মী ও হালিমের পরিবারের অভিযোগ, পুলিশের নির্যাতনে হালিম মারা গেছেন। এ কারণে তাঁরা জানাজার পর হালিমের লাশ নিয়ে মিছিল বের করেন। মিছিলকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের পর পৌর এলাকার শতাধিক যানবাহন ও ১০টি দোকান ভাঙচুর করেন বিএনপির নেতা-কর্মীরা। এর ১০ মিনিট পরই আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা প্রতিবাদী মিছিল বের করলে শুরু হয় গোলাগুলি। আর এ সময় গুলিবিদ্ধ হন জাকের হোছাইন।
এদিকে জাকেরকে নিয়ে শুরু হয়েছে রাজনৈতিক ফায়দা লোটার চেষ্টা। ওই দিন সন্ধ্যা সাতটায় পৌর বিএনপির যুগ্ম আহবায়ক ও পৌর মেয়র নুরুল ইসলাম হায়দার দাবি করেন, জাকের পৌর বিএনপির ৮নং ওয়ার্ডের সদস্য। কিন্ত ৩ ডিসেম্বর জাকেরের স্ত্রী নূরজাহান জানালেন, তাঁর স্বামী কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। অবরোধ-হরতাল, মিটিং-মিছিলও পছন্দ করতেন না। হয়তো কেউ ফায়দা হাসিল করতে তাঁকে কর্মী বলে দাবি করছেন।
নূরজাহান আরও বলেন, ‘কে বা কারা গুলি করেছে তা আমি দেখিনি। তাই কারও বিরুদ্ধে মামলাও করিনি। এ ছাড়া, মামলা চালানোর মতো সামর্থ্যও আমার নেই।’ পারিবারিক সূত্র জানায়, জাকেরের পাঁচ সন্তানের মধ্যে বড় মেয়ে রেশমী জান্নাতের বিয়ে হয়ে গেছে। মেজো মেয়ে সোহাইলা জান্নাত ১০ম শ্রেণীতে পড়ে এবং তৃতীয় মেয়ে নুশরাত জাহান জেএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। তা ছাড়া, এবার প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা দিয়েছে চতুর্থ ছেলে মো. আরমান ও ছোট মেয়ে রোজবেল আফরোজ তাসফিয়া।
মেজো মেয়ে সোহাইলা জান্নাত বলে, ‘বাবা বিদেশ যাওয়ার জন্য একটি পাসপোর্ট বানিয়েছিলেন ২০০৫ সালের ২৯ নভেম্বর। সেই ইস্যু করা ২৯ তারিখেই তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। এখন আমাদের সবার ভবিষ্যৎও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।’