নারী কাউন্সিলর ওয়ারিশান সনদ দিতে পারেন না!

আরিফুর রহমানের পালক ভাই আশিকুর রহমান ওয়ারিশান সনদ নেন ৩৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর রঞ্জন বিশ্বাসের কাছ থেকে। সুরাইয়া বেগম যে সনদ দেন, তাতে আশিকুর রহমানের নাম নেই, আর রঞ্জন বিশ্বাসের দেওয়া সনদে আশিকুর রহমানের নাম আছে। আরিফুর ও আশিকুর দুই ভাইয়ের মধ্যে (একজন পালক) জমি নিয়ে বিরোধ চলছে।

আরিফুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘মোকদ্দমার শুরুতেই নারী কাউন্সিলরের কাছ থেকে নেওয়া সনদ নিয়ে ঝামেলায় পড়ি। আমাকে বলা হয়, নারী কাউন্সিলর এ সনদ দিতে পারেন না। প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন দেখাই, যেখানে হাইকোর্টের একটি রায়ের উল্লেখ করে বলা হয়েছে যে সাধারণ আসন ও সংরক্ষিত আসনের নারী সদস্যদের সঙ্গে কোনো বৈষম্য করা যাবে না। কিন্তু প্রথম আলোর প্রতিবেদনের কপি দিয়ে রেহাই মেলেনি। অনেক ঝক্কিঝামেলা করে অবশেষে হাইকোর্টের রায়ের কপি দেখাতে হয়।’

অবশেষে চলতি বছরের ১২ জানুয়ারি রাজধানীর কোতোয়ালি রাজস্ব সার্কেলের সহকারী কমিশনার (ভূমি) এস এম মাহফুজুর রহমানের সই করা রিভিউ মোকদ্দমায় (৩২/২০১৬) উল্লেখ করা হয়েছে, ‘বাদীপক্ষ কর্তৃক দাখিলকৃত মহামান্য হাইকোর্ট কর্তৃক প্রদত্ত বিগত ২০০৪ সালের ১৬ আগস্টের রায় মোতাবেক সাধারণ ও সংরক্ষিত উভয় আসনের ক্ষেত্রে পুরুষ বা মহিলা উভয়ই সর্ব বিশেষ সমভাবে বিবেচ্য হবে মর্মে দেখা যায়...।’

তবে পরস্পরবিরোধী সনদ দেওয়ায় তা আমলে নেওয়ার জন্য এ আদালত এখতিয়ারসম্পন্ন নয়, যথাযথ এখতিয়ারসম্পন্ন কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে নিষ্পত্তি হওয়া প্রয়োজন। নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত বিবাদীর (আশিকুর রহমান) নামে মঞ্জুরীকৃত নামজারি মোকদ্দমা এবং সৃজিত জোত বাতিল করে মূল খতিয়ানে ফেরত নেওয়ার আদেশ দেওয়া হয়েছে এ রায়ে। এর আগে পর্যন্ত নারী কাউন্সিলরের সনদ গ্রহণযোগ্য কি না, তা নিয়েই সময় গড়াতে থাকে।

গত বছরের ৩০ এপ্রিল কোতোয়ালি রাজস্ব সার্কেলের সহকারী কমিশনারের (ভূমি) সই করা এক চিঠিতে ওয়ারিশান সনদের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য কাউন্সিলর সুরাইয়া বেগম ও রঞ্জন বিশ্বাসের কাছে চিঠি দেন। এর উত্তরে রঞ্জন বিশ্বাস বলেন, তাঁর দেওয়া সনদটিতে (আশিকুর রহমানের নামসহ) উত্তরাধিকারে কোনো গরমিল পাননি। আর সুরাইয়া বেগম বলেন, হাবিবুর রহমানের স্ত্রী (যখন বেঁচে ছিলেন) রাবিয়া খাতুনের আবেদন পেয়ে ২০১৫ সালে একটি সনদ দেন, তাতে স্ত্রী, এক ছেলে (পালক ছেলের নাম নেই) ও এক মেয়ের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। রাবিয়া খাতুন মারা যাওয়ার পর তাঁর ছেলে আরিফুর রহমানের আবেদন পেয়ে আরেকটি সনদ দেন, যা সত্য।

২০০২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর স্থানীয় সরকার বিভাগের এক পরিপত্রে সাধারণ ও সংরক্ষিত আসনের কাউন্সিলরদের কে কী কাজ করবেন, তা উল্লেখ করা হয়েছে। এ পরিপত্রের পাঁচ নম্বরে বলা হয়েছে, সাধারণ আসনের কমিশনার ওয়ার্ড এলাকার জন্ম-মৃত্যু, মৃত ব্যক্তির পোষ্য-সংক্রান্ত উত্তরাধিকার, জাতীয়তা ও চারিত্রিক সনদ প্রদান করবেন। এখানে সংরক্ষিত আসনের কথা উল্লেখ নেই। একইভাবে ২০১২ সালে কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত আসনের কাউন্সিলরদের দায়িত্ব, কার্যাবলি ও সুযোগ-সুবিধাসংক্রান্ত যে বিধিমালা জারি করেছে, তাতেও এ সনদ দেওয়ার ক্ষমতা শুধু সাধারণ আসনের কাউন্সিলরকে দেওয়া হয়েছে। তবে এর আগে ২০০৪ সালে হাইকোর্ট রায়টি দেন। রায়টিকে আমলে না নেওয়ায় জটিলতার সৃষ্টি হয়।

আরিফুর রহমানের বাবার নাম হাবিবুর রহমান, মায়ের নাম রাবেয়া খাতুন। তাঁরা দুজন মারা গেছেন। আরিফুর রহমানের দেওয়া বিভিন্ন নথি অনুযায়ী, ১৯৭৬ সালে তোহরা বিবির কাছ থেকে আশিকুর রহমান মানিককে আট মাস বয়সে পালক হিসেবে গ্রহণ করেন হাবিবুর রহমান। অভিযোগ, এই পালক ছেলের নিজের পরিচয় গোপন করে হাবিবুর রহমানের ছেলে দাবি করে ওয়ারিশ সম্পত্তি দখল করেছেন। আশিকুর রহমান তিনি যে হাবিবুর রহমানের ছেলে, তার প্রমাণ হিসেবে ভোটার আইডি কার্ড দাখিল করেছেন, যেখানে বাবার নাম লেখা আছে হাবিবুর রহমান। পুরান ঢাকার প্রসন্ন পোদ্দার লেনে ৫৮ দশমিক ০৪ অজুতাংশ সম্পত্তি নিয়ে এই বিরোধ।

নিবন্ধনহীন পালকনামার মাধ্যমে তোহরা বিবি তাঁর সন্তানকে (আশিকুর রহমান) আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে বিনা শর্তে হাবিবুর রহমানকে দিয়ে দেন। হাবিবুর রহমান নিজের ছেলের মতোই তাঁকে বড় করেন। এই পালক ছেলে ছাড়াও হাবিবুর রহমানের আছে এক ছেলে আরিফুর রহমান ও মেয়ে সেলিমা সুলতানা। মুসলিম উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী, পালক ছেলে কোনো ওয়ারিশ পায় না। আশিকুর রহমান পালক ছেলে, তার প্রমাণ আরিফুর রহমানের হাতে আছে। ২০১৩ সালে প্রসন্ন পোদ্দার লেনের আবদুল হামিদ কোতোয়ালি থানায় আশিকুর রহমান মানিকের বিরুদ্ধে একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। ওই তদন্ত প্রতিবেদনে বিবাদী মানিকের বাবা ও মায়ের নামের আগে ‘পালক’ কথাটি লেখা রয়েছে। প্রসন্ন পোদ্দার লেন সমাজকল্যাণ ও পঞ্চায়েত কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক এক প্রত্যয়নপত্রে জানিয়েছেন আশিকুর রহমান হাবিবুর রহমানের পালক ছেলে। ১৯৭৬ সালের পালকনামায় দুই সাক্ষীর আঙুলের টিপসইও আছে।

জমি নিয়ে বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য আরিফুর রহমান নির্বাচন কমিশন, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন, জেলা প্রশাসক বরাবর বিভিন্ন সময়ে আবেদন করেছেন। এগুলো করার পর ঝামেলা হয় নারী কাউন্সিলরের দেওয়া ওয়ারিশান সনদ নিয়ে।

কাউন্সিলর সুরাইয়া বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘একবার নয় বছর আর এবার প্রায় দুই বছর ধরে কাউন্সিলরের দায়িত্ব পালন করছি। এর আগেও ওয়ারিশান সনদ দিয়েছি, কখনো ঝামেলা হয়নি। আরিফুর রহমানের সনদ নিয়ে ঝামেলা শুরু হয়। তবে হাইকোর্টের রায়ে স্পষ্ট বলা হয়েছে, সংরক্ষিত আসনের কাউন্সিলরদের সঙ্গে কোনো বৈষম্য করা যাবে না। এ ছাড়া কোথাও লেখা নেই যে আমরা এ সনদ দিতে পারব না।’