নুনের বিষে নীল উপকূল–কন্যারা

বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ হাসপাতালের বারান্দায় রেলিং ধরে খেলছিল একটা শিশু। না শিখেছে সে স্পষ্ট বোল, না জানে বাড়ির উঠোন আর হাসপাতালের বারান্দার পার্থক্য। আদর করে কেউ ডাকলেই গুট গুট করে দৌড়াচ্ছে। মাত্র সাড়ে তিন বছরের হাসিখুশি মেয়েটির মুখ হঠাৎ মলিন হলো। থেমে গেল চলাচল। কেউ গুরুত্ব না দিলেও আঁতকে উঠলেন ওর দাদি। জানালেন, এরপরই ব্যথা বাড়বে, তলপেট চেপে ধরে বসে কাতরাবে। চিকিৎসক জানিয়েছে, এরই মধ্যে এত ছোট শিশুটির মূত্রতন্ত্রে প্রদাহ শুরু হয়েছে। বহরবুনিয়া ইউনিয়ন থেকে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে নাতিকে নিয়ে এসেছেন বৃদ্ধা। মোরেলগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পৌঁছাতে তাদের খেয়ায় পাড়ি দিতে হয়েছে পানগুছি নদী।

সাতক্ষীরার গাবুরার চকবারা গ্রামে লবণাক্ততার শিকার নারীরা
ছবি: সাদিয়া মাহ্জাবীন ইমাম

এসব উপকূলীয় অঞ্চলের বসত নদ-নদীর পাড় ঘেঁষে গড়ে উঠেছে। রাত আর দিনের মতোই এখানে অবধারিতভাবে আসে জোয়ার-ভাটা। লবণাক্ততার প্রভাবে বাড়ছে নারীদের প্রজননস্বাস্থ্যের সংক্রমণ, জরায়ু ক্যানসার। বেশি আতঙ্কিত করছে কন্যাশিশুদের সংক্রমিত হওয়ার খবর। মোরেলগঞ্জ হাসপাতালের তখনকার আবাসিক চিকিৎসক মনজিল রসিদ জানালেন, তাঁদের কাছে যত নারী রোগী আসে, তার ৬০ শতাংশই জরায়ু, ডিম্বনালি ও অন্যান্য প্রজনন অঙ্গের সংক্রমণে আক্রান্ত থাকে। এর মধ্যে কন্যা শিশুদের সংখ্যা বাড়ছে। বাগেরহাটের শরণখোলা, মোরেলগঞ্জের মতো খুলনার দাকোপ বা সাতক্ষীরার শ্যামনগর সবই উপকূলীয় এবং দুর্যোগপ্রবণ এলাকা। বিচ্ছিন্ন গ্রাম হওয়ায় এসব এলাকার নারী, কিশোরী ও কন্যাশিশুদের স্বাস্থ্যঝুঁকি আরও বেশি।

প্রায় এক যুগ ধরে উপকূলীয় এলাকায় স্বাস্থ্যসেবা দিচ্ছেন দাকোপ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মোজাম্মেল হক নিজামী। জানালেন, ‘বছরজুড়ে চিকিৎসা নিতে আসা উপকূলের নারীদের অধিকাংশের সমস্যা ‘ভ্যাজাইনাল ক্যানডিডিয়াসিস’ বা যোনিপথে ছত্রাক সংক্রমণজনিত অসুখ। এর অন্যতম কারণ মাটি ও পানিতে সহনশীল মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি লবণ। এসব রোগের জন্য মেয়েশিশুদেরও এখন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হচ্ছে। লবণাক্ততার সঙ্গে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বাস, সচেতনতার অভাব এবং অপুষ্টি এই সংক্রমণের অন্যতম কারণ।’ মেডিকেল ক্যাম্প করা হলে শিশু, কিশোরী ও নারী রোগীর সংখ্যা অনেক বেশি হয় বলে জানালেন এ চিকিৎসক। এ বছরের মার্চে উপকূলীয় অঞ্চল দাকোপের প্রত্যন্ত ছয়টি গ্রামে মেডিকেল ক্যাম্প করা হয়েছিল। এই ক্যাম্পে জরায়ু ক্যানসারের প্রাথমিক পরীক্ষা করাতে এসেছিলেন ছয় শতাধিক নারী।

দাকোপ উপজেলার সুতারখালী ইউনিয়নের কালাবগি গ্রামটি সুন্দরবনের ভেতরে। এখান থেকে সবচেয়ে কাছের হাসপাতালে যেতে সময় লাগে ট্রলারে সাড়ে তিন ঘণ্টার নদীপথসহ অন্তত সাড়ে চার ঘণ্টা। এখানকার কোনো নারীর সন্তান প্রসবের সময় জটিলতা থাকলে তাঁকে কয়েক দিন আগে হাসপাতালে ভর্তি করে রেখে আসতে হয়। অধিকাংশেরই সে সংগতি নেই। এই কালাবগির দুই নারীর সঙ্গে কথা হচ্ছিল। জানা গেল, বাঁশের খুঁটির ওপরে বসানো একটি ঘেরা জায়গাকে বাথরুম হিসেবে ব্যবহার করে আটটি পরিবার। শিবসা নদীর জোয়ার–ভাটার সঙ্গে তাল মিলিয়ে সেখানে নারীদের যেতে হয়।

দাকোপের কালাবগিতে সুতারখালী নদীপাড়ের এই বাঁশের ঘর বাথরুম হিসেবে ব্যবহার করে আটটি পরিবার
ছবি: সাদিয়া মাহ্জাবীন ইমাম

সাতক্ষীরার শ্যামনগরের গাবুরার লবণাক্ততার পরিমাণ বোঝাতে বৃদ্ধা আছিয়া একাই যথেষ্ট। তিনি বলেছিলেন, তাঁর বাড়ির সামনের খালে রাতের বেলা ঢিল ছুড়লে সবুজ আলো জ্বলে। লবণের পরিমাণ কতটা বেশি, সেটা বোঝাতেই এই উদাহরণ। অথচ এই পানিই তাদের গোসল, দৈনন্দিন ব্যবহার আর কখনো কখনো পানের একমাত্র উৎস। এক কলস সুপেয় পানি আনতে যেতে হয় কয়েক মাইল। আছিয়া বেগমের কথার মাঝখানে প্রায় চেঁচিয়ে উঠেছিলেন ২৬ বছর বয়সী আরেক নারী। জানালেন, সংক্রমণের পর চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতেই কেটে ফেলা হয়েছে তাঁর জরায়ু। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সে নারীর বিশ্বাস, ভালো চিকিৎসক পেলে হয়তো ওষুধেই সুস্থ হয়ে যেতেন। জানালেন, গাবুরার দুই গ্রামে হাঁটলে অন্তত ২০ জন নারী পাওয়া যাবে যাঁদের বয়স ৪০–এর কম। কিন্তু এরই মধ্যে জরায়ু হারিয়েছেন তাঁরা। আর অল্প বয়সের কিশোরীরা লজ্জায় বলতে পারে না সমস্যার কথা। ছোট মেয়ে বাচ্চারা বুঝতেই পারে না, কী হয়েছে। প্রস্রাবের সময় কান্নাকাটি করে।

এখানে মাতৃস্বাস্থ্য কতটা ঝুঁকিপূর্ণ এর একটি উদাহরণ হতে পারে ৭ জানুয়ারি জন্ম নেওয়া এক শিশু। শ্যামনগরের পদ্মপুকুর ইউনিয়নের শায়লা শারমিনকে হাসপাতাল পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার সময় পায়নি পরিবার। এর আগেই কপোতাক্ষ নদে ট্রলারেই জন্ম নেয় তাঁর প্রথম সন্তান। অত্যন্ত জটিল পরিস্থিতিতে নবজাতক ও মা দুজন দুই দিন থাকলেন হাসপাতাল আর বাড়িতে বিচ্ছিন্ন হয়ে। শায়লা শারমিনের স্বামী নুর হুসাইন বলছিলেন, আগের রাত থেকেই তাঁর স্ত্রীর প্রসববেদনা ছিল কিন্তু নদীপথের দূরত্বই এ দুর্ভোগ ঘটিয়েছে।

নোনা নদীর নুনের বিষে নীল হয়ে যাওয়া মেয়েশিশু বা কিশোরীদের সমস্যা বাবা-মা বুঝলেও অধিকাংশ সময়ই তাঁদের কিছু করার সংগতি থাকে না। নদী পার হয়ে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন মাথা খুঁড়ে হার মানে বাস্তবতার কাছে। এভাবে শৈশব থেকেই কন্যাশিশুদের বহন করতে হয় সংক্রমণের অবধারিত নিয়তি। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে অসুখ। অল্প বয়সেই জরায়ু হারানোটা এখন উপকূলীয় নারীদের জন্য সাধারণ খবর হয়ে উঠছে। আর এই দুর্ভোগকে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বলে মনে করেন বিজ্ঞানী ও চিকিৎসকেরা। ওজিএসবির সাবেক প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক রওশন আরা বেগম বললেন, ‘বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নারীদের ওপর সবচেয়ে বেশি পড়ছে। এমনকি বন্ধ্যাত্বের হারও বাড়ছে। লবণাক্ততার জন্য উপকূলের শিশু, কিশোরী বা নারীদের এই স্বাস্থ্যগত সমস্যা জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবেরই অংশ।’

তেমনই ভুক্তভোগী এক শিশু যাকে বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জের স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে দেখেছিলাম আমরা। সাড়ে তিন বছরের শিশুটির মা–বাবা কেউই নেই। একমাত্র অভিভাবক দাদির উপার্জন প্রতিদিন মাটি কাটার পারিশ্রমিক হিসাবে পাওয়া কটি মাত্র টাকা। বৃদ্ধা এই নারীকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, এত কষ্ট করে অতটা দূর থেকে নাতিকে হাসপাতাল পর্যন্ত নিয়ে এসেছেন কেমন করে? নিজের ব্যাখ্যাতীত দুর্দশার বর্ণনা করে বললেন, বাচ্চাটা প্রস্রাব করতে গেলে যে কষ্ট পায়, তা সহ্য করা যায় না। প্রথমে ফুঁপিয়ে কাঁদে, তারপর কখনো কখনো চিৎকার করে। এক দিনের কাজ বাদ দিয়ে তাই এত দূর নিয়ে এসেছেন। ওই দিন তাঁর কোনো উপার্জন নেই। গ্রামের চিকিৎসকেরা ওষুধ দিলেও বাচ্চাটির অসুখ সারেনি। এখানে হাসপাতালে আসার পর জানলেন, এটি মূত্রতন্ত্রে প্রদাহজনিত সংক্রমণ।

হাসপাতালের বারান্দায় প্রজাপতির মতো উড়ে বেড়ানো শিশুটি একসময় ক্লান্ত হয়ে বসে পড়ে। সঠিক চিকিৎসা না হলে তাকে বয়ে বেড়াতে হবে এ অসুস্থতা। এ শিশুটির মতো উপকূলের বহু শিশুই এখন শরীরে বহন করে চলেছে লবণাক্ততার ক্ষত, যা সময়ের সঙ্গে আরও বাড়বে।