এ বছর ৮ মার্চ তারিখটা বাংলাদেশের জন্য একটা ভয়ানক দিনের সাক্ষী হয়ে আছে। এই দিনেই প্রথম দেশে তিনজন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছিলেন। কিন্তু ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকে আমরা যাঁরা পুরকৌশল বিভাগে পড়ি, তাঁদের অনেকেরই দিনের শুরুটা হয়েছিল দারুণ এক অভিজ্ঞতায়।
সেদিন সকাল সাতটায় আমরা যাত্রা শুরু করি পদ্মা ব্রিজ রেল লিংক প্রকল্পের উদ্দেশে, যা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাসফর। মেয়র হানিফ উড়ালসড়ক পার হওয়ার পরপরই আমাদের বাসগুলোর সঙ্গে যুক্ত হয় প্রকল্পের ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি গাড়ি, তাঁদের সঙ্গেই আমরা আমাদের প্রথম গন্তব্যে পৌঁছাই। করোনা মহামারির কারণে প্রকল্প অফিস আমাদের শরীরের তাপমাত্রা পরীক্ষার পর মাস্ক ও হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানায়। এরপর আমরা পৌঁছাই বিশাল সভাকক্ষে।
আনুষ্ঠানিকভাবে আমাদের ‘শিক্ষাসফর’ শুরু হয় একটি ভিডিও চিত্র দেখে। ভিডিওতে আমরা দেখি, কীভাবে চলছে পদ্মা সেতু ও রেললাইনের মধ্যে সংযোগের কাজ, প্রতিটি ব্যাপারই প্রকল্পের বিজ্ঞ প্রকৌশলী ও ব্যবস্থাপকেরা আমাদের বুঝিয়ে বলেন। এই উপস্থাপনা শেষে আমরা সভাকক্ষ থেকে চলে যাই প্রকল্পের ওয়ার্কশপে। সেখানেই পদ্মা সেতুর বিশাল বিশাল গার্ডারগুলো তৈরির কাজ চলছিল। বিশাল এই কর্মযজ্ঞ দেখে আমাদের বেশ খানিকটা সময় কেটেছে। এরপর আমরা সেখানকার ম্যাটেরিয়ালস, সয়েল, কংক্রিটসহ সবগুলো পরীক্ষাগার ঘুরে দেখি। এই ল্যাবগুলোই মূলত প্রকল্পের মান নিয়ন্ত্রণের আঁতুড়ঘর।
পরীক্ষাগারগুলোর ঠিক পাশেই রেডিমিক্স প্ল্যান্ট—যেখানে কংক্রিট মিক্স তৈরির কাজ হয়। সেই বিশাল ফানেল আকৃতির সায়লোগুলোর পাশ দিয়ে হেঁটে হেঁটে আমরা রেডিমিক্স প্ল্যান্ট দেখা শেষ করি। সবাই যেহেতু পুরকৌশলের শিক্ষার্থী, বইয়ে পড়া বিষয়গুলোর সঙ্গে আমরা বাস্তবের এই বিশাল প্রকল্পের কার্যক্রমকে মিলিয়ে নিচ্ছিলাম।
আশপাশ ঘুরে আরও কিছু কারিগরি জ্ঞান ঝোলায় ভরে আমরা চলে যাই সবচেয়ে আকাঙ্ক্ষিত স্থান—পদ্মা সেতুর মাওয়া প্রান্তে। পথের মধ্যেই আমরা পদ্মা রেল প্রকল্পের ‘আর্থওয়ার্ক’ দেখি, যেখানে মাটিকে রেললাইনের উপযোগী করা হচ্ছে। সেতুর মাওয়া প্রান্তে পৌঁছে আমরা দেখতে পাই—মূল পদ্মা সেতুর দৃশ্যমান স্প্যান এবং পিলার। প্রতিটি পিলারের নিচেই আছে শক্তিশালী ভিত্তি। বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে নির্মিত এই সেতুর নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কন্সট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড।
বাংলাদেশের এখন পর্যন্ত সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং স্থাপনা এই পদ্মা সেতু। সেতুটি একটি দুই স্তরের ট্রাস ব্রিজ, যার ওপরের ভাগে চার লেনের মহাসড়ক এবং নিচের অংশে সিঙ্গেল ট্র্যাক রেলপথ নির্মাণ হবে। যতটুকু সময় সেখানে ছিলাম, প্রতিটা মুহূর্তে অবাক হয়েছি এই ভেবে যে এত জটিল একটি আধুনিক স্থাপনা বাংলাদেশে দক্ষ প্রকৌশলীদের তত্ত্বাবধানে খুব সুনিপুণভাবে মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে। বিস্ময়ভরা এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা নিয়ে আমরা ঢাকার উদ্দেশে রওনা হয়েছিলাম। ফিরতি পথের ক্লান্তি যখন চোখ বন্ধ করে দিচ্ছিল, ঠিক তখনই খবর পাই বাংলাদেশে প্রথম তিনজন করোনা–আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছেন। এত সুন্দর একটা দিনের শেষটা হয় আতঙ্কের শুরু দিয়ে। এর কিছুদিনের মাঝে আমরা প্রবেশ করি বন্দিজীবনে। শুরু হয় করোনাকালের ঘরে থাকার দিন।
এর মধ্যেই আমরা হারিয়েছি পদ্মা সেতু প্রকল্পের কারিগরি উপদেষ্টা, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, জাতীয় অধ্যাপক, প্রকৌশলী জামিলুর রেজা চৌধুরী স্যারকে। ২৮ এপ্রিল ভোরবেলা স্যারের মৃত্যু সংবাদ পাওয়ার পর সবার প্রথম পদ্মা সেতুই চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল। পদ্মা সেতুর এপার-ওপার সংযুক্ত হয়েছে, বসে গেছে সবগুলো স্প্যান, এ নিয়ে সবার মধ্যেই বেশ রোমাঞ্চ কাজ করছে। আর আমার মনে হচ্ছে, সেতুর ওপর দাঁড়িয়ে পদ্মার নির্মল বাতাস উপভোগ করছেন জামিলুর রেজা স্যার—এই দৃশ্য দেখতে পারলে হয়তো আমাদের শিক্ষাসফরটা পূর্ণতা পেত।