পাহাড় চাপায় স্বপ্ন বিলীন

কক্সবাজার শহরের ঘোনাপাড়া এলাকায় পাহাড় কেটে তৈরি অবৈধ বসতি। প্রতিবছর প্রাণহানি সত্ত্বেও পাহাড়ধসের ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে এখানকার বাসিন্দারা  l প্রথম আলো
কক্সবাজার শহরের ঘোনাপাড়া এলাকায় পাহাড় কেটে তৈরি অবৈধ বসতি। প্রতিবছর প্রাণহানি সত্ত্বেও পাহাড়ধসের ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে এখানকার বাসিন্দারা l প্রথম আলো

ছেলেমেয়েদের নিয়ে খায়রুল আমিনের স্বপ্ন ছিল আকাশছোঁয়া। লেখাপড়া শিখে ছেলে প্রকৌশলী আর মেয়ে হবে চিকিৎসক। তারপর দুজন নেমে পড়বে মানবসেবায়। কিন্তু সেই স্বপ্নই যে পাহাড়চাপায় বিলীন হবে, তা কখনো ভাবেননি এই হতভাগ্য বাবা।
খায়রুল আমিনের বাড়ি মহেশখালীর শাপলাপুরে। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া কথা ভেবে তিনি চলে আসেন কক্সবাজার শহরে। ওঠেন শহরের সার্কিট হাউস–সংলগ্ন রাডার স্টেশন পাহাড়ের নিচে কবরস্থানপাড়ার একটি ঘরে। ২৭ জুলাই গভীর রাতে পাহাড় ধসে পড়ে তাঁর বসতবাড়ির ওপর। মাটিচাপায় প্রাণ হারান তাঁর স্ত্রী লুৎফুন্নেছা ওরফে জুনু আকতার (৩৩) ও মেয়ে নীহামনি (৭)। ভাগ্যক্রমে রক্ষা পান খায়রুল ও তাঁর ছেলে আয়াত উল্লাহ (১৩)।
একই দিন পাহাড়চাপায় নিহত হন শাহ আলম (৪৮) ও রোকেয়া আকতার (৩৭) দম্পতি। শাহ আলমের বাড়ি মহেশখালীর জেএমঘাট এলাকায়। আর রোকেয়ার বাড়ি কক্সবাজার শহরের বাহারছড়ায়। ১৫ বছর আগে দুজনের বিয়ে হয়। খায়রুল আমিনের প্রতিবেশী ছিলেন তাঁরা। সংসারে তাঁদের এক ছেলে ও এক মেয়ে। ভূমি ধসে তাঁদের মৃত্যু হলেও রক্ষা পায় দুই সন্তান হাসনাত ইব্রাহিম (১৪) ও সাবরিনা সুলতানা (৭)। ঘটনার আগের দিন দুই ভাইবোন নানার বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে প্রাণে রক্ষা পায়।
নিহত রোকেয়া আকতারের ভাই মোহাম্মদ ফারুক জানান, তাঁর বোন ও ভগ্নিপতির ইচ্ছা ছিল লেখাপড়া করিয়ে ছেলেমেয়েকে চিকিৎসক ও প্রকৌশলী বানাবেন। কিন্তু এখন সব শেষ হয়ে গেল।
মা–বাবা এভাবে হারিয়ে যাবেন, তা মানতে পারছে না ইব্রাহিম ও সাবরিনা। মা–বাবার জন্য সর্বক্ষণ কান্নাকাটি করছে তারা। নানার বাড়িতে থেকেই সম্ভবত তাদের মানুষ হতে হবে। মা-বাবার স্বপ্ন পূরণ করতে হবে।

লুৎফুন্নেছা ও তাঁর মেয়ে নীহামনি এখন কেবলই ছবি
লুৎফুন্নেছা ও তাঁর মেয়ে নীহামনি এখন কেবলই ছবি

একই ঘটনায় নিহত হয় আরেক কলেজছাত্রী রিনা আকতার (১৭)। সে নিহত শাহ আলমের ভাগনি। মহেশখালীর একটি স্কুল থেকে এবার এসএসসি পাস করে রিনা ভর্তি হয় কক্সবাজার সরকারি মহিলা কলেজে। মা-বাবার ইচ্ছা ছিল, লেখাপড়া শিখে মানুষ হবে মেয়ে। কিন্তু হারিয়ে গেল রিনাও।
কক্সবাজার বাঁচাও আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক আয়াছুর রহমান জানান, শহরের হিলটপ সার্কিট হাউস, রাডার স্টেশন, লাইট হাউস, কলাতলী, পাহাড়তলীসহ অন্তত ১১টি পাহাড়ে ১৫ হাজারের বেশি ঘরবাড়ি তৈরি করে ঝুঁকি নিয়ে বসতি করছে দুই লাখ মানুষ। পাহাড় কেটে তৈরি হচ্ছে আরও নতুন নতুন ঘরবাড়ি। ভারী বর্ষণের ফলে বিভিন্ন পাহাড়ে ফাটল ধরছে। পাহাড় ধসে হতাহতের সংখ্যাও বাড়ছে। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই পাহাড় কাটা বন্ধ করা যাচ্ছে না।
পরিবেশবাদী সংগঠন কক্সবাজার বন ও পরিবেশ সংরক্ষণ পরিষদের আহ্বায়ক মাসুদুর রহমান জানান, ২৭ জুলাই রাডার স্টেশনের পাহাড় ধসে দুই পরিবারের মা-মেয়ে, স্বামী-স্ত্রীসহ পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে। গত মে মাসে শহর ও রামুতে একাধিক পাহাড় ধসে মারা গেছেন আরও সাতজন। এর আগের পাঁচ বছরে ১০টির বেশি পাহাড় ধসের ঘটনায় আট সেনাসদস্যসহ ৯৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। তারপরও পাহাড় কাটা বন্ধ হচ্ছে না।
পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজারের সহকারী পরিচালক সরদার শরিফুল ইসলাম বলেন, ২৮ জুলাই ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে তিনটি পৃথক দল শহরের কলাতলী, লাইট হাউস, শুকনাছড়ি মুজিবনগর, কলাতলী জেলগেট, ডিককুলসহ বিভিন্ন পাহাড়ে অভিযান চালিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ শতাধিক ঘরবাড়ি উচ্ছেদ করেছে। আরও কয়েক হাজার ঝুঁকিপূর্ণ ঘরবাড়ি উচ্ছেদ দরকার। কিন্তু বৃষ্টির জন্য তা সম্ভব হচ্ছে না।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক ( সার্বিক) অনুপম সাহা জানান, প্রাণহানি রোধে পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ স্থাপনা সরিয়ে ফেলা হচ্ছে। লোকজনকে নিরাপদ স্থানে সরে আসার জন্য চলছে মাইকিং। কিন্তু এতে তেমন সাড়া মিলছে না।