পৌরাণিক যুগে ফেরার প্রয়াস!

পৌরাণিক পুনর্জাগরণ আন্দোলন মূলত প্রাচীন গ্রিসের ১২ জন দেব-দেবীর ওপর গুরুত্ব দেয়
পৌরাণিক পুনর্জাগরণ আন্দোলন মূলত প্রাচীন গ্রিসের ১২ জন দেব-দেবীর ওপর গুরুত্ব দেয়

পশ্চিমা শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির ওপর গ্রিক পুরাণের প্রভাব অনেক। ইউরোপে খ্রিষ্টধর্মের ব্যাপক প্রসার সত্ত্বেও ধ্রুপদি সংস্কৃতির সেই প্রভাব অটুট রয়েছে যুগ যুগ ধরে। কিন্তু গ্রিসের পৌরাণিক ধর্ম ও অনুসারীদের অবস্থা ক্রমেই সংকুচিত হয়ে এসেছে।
তবে গ্রিসের মানুষেরাই, সংখ্যায় তারা খুব অল্প হলেও, ধরে রেখেছে খ্রিষ্টপূর্ব যুগের ঐহিত্যবাহী ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান। এই জনগোষ্ঠীর জন্য ২১ জুন তারিখটি তাৎপর্যপূর্ণ। প্রতিবছরের মতো এবারও তারা সুপ্রাচীন এক উৎসব উদ্যাপনে সমবেত হয়েছিল। এই উৎসবের নাম প্রমিথিয়া, গ্রিক পুরাণের দেবতা প্রমিথিউসের নামানুসারে। পৌরাণিক বিশ্বাস, দেবরাজ্য থেকে আগুন চুরি করে আনতে তিনিই মানবজাতিকে সাহায্য করেছিলেন।

ইতিহাস বলছে, আনুমানিক ৩১২ খ্রিষ্টাব্দে খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষা নেন তৎকালীন রোমান সম্রাট কনস্ট্যান্টাইন। এরপর ৩৮০ থেকে ৩৯৩ সালের মধ্যে সম্রাট প্রথম থিওডোসিয়াস বেশ কয়েকটি আদেশ জারি করে প্রাচীন ধর্মের চর্চা নিষিদ্ধ করেন। এর আগে অলিম্পাস পাহাড়ের ১২ জন দেব-দেবীর আরাধনা করত গ্রিসবাসী। সেই দেবতাদের নাম অ্যাপোলো, অ্যারিস, দিয়নিসাস, হার্মিস, হেফায়েস্তাস, পোসেইদন ও জিউস। দেবীরা হলেন আফ্রোদিতি, অ্যাথেনা, আর্তেমিস, দিমিতার ও হেরা। তাঁদের প্রত্যেককে প্রকৃতির বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য ও উপাদানের আধাররূপে পূজা করত প্রাচীন গ্রিকরা। কিন্তু খ্রিষ্টধর্মের আবির্ভাবের মধ্য দিয়ে একেশ্বরবাদ প্রবর্তনের ফলে গ্রিসের পৌরাণিক দেব-দেবীদের উপাসনা ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তা হারায়।


কিন্তু প্রাচীন সেই লৌকিক ধর্ম, মূল্যবোধ, দর্শন ও জীবনধারাকে ফিরিয়ে আনতে চায় গ্রিকদের একটি অংশ। তাদের মতে, ১৬ শতাব্দীর বেশি সময় ধরে খ্রিষ্টধর্ম দখল করে রেখেছে গ্রিসকে। ধ্রুপদি ইতিহাসের ছাত্র ও ভাস্কর ত্রিভোওলিদস বলেন, গন্তব্য সম্পর্কে সচেতনতার জন্য মানুষকে অবশ্যই তার অতীত জানতে হয়। নইলে ভবিষ্যতের তাৎপর্যও কমে যায়। এই উৎসব হচ্ছে শিকড়ের কাছে ফেরা এবং হাজার হাজার বছর ধরে অব্যাহত একটি ধারার অংশ হিসেবে নিজেকে উপলব্ধি করার প্রয়াস।

ধারণা করা হয়, পৌরাণিক ধর্মের অনুসারীদের মোট সংখ্যা এখন প্রায় এক লাখ
ধারণা করা হয়, পৌরাণিক ধর্মের অনুসারীদের মোট সংখ্যা এখন প্রায় এক লাখ


গ্রিক যোদ্ধার পোশাক-পরিচ্ছদে সজ্জিত ছয় দৌড়বিদ উৎসবের সূচনা করেন। তাঁরা মাউন্ট অলিম্পাস এলাকায় ১০ কিলোমিটার দৌড়ে অংশ নেন। এ সময় তাঁদের বর্ম, দীর্ঘ বর্শা ও অস্ত্রের ঝনঝনানি একধরনের প্রাচীন যুদ্ধের আবহ তৈরি করে। কিন্তু মাউন্ট অলিম্পাসের পাদদেশ থেকে তাঁদের দৌড় শুরু যখন হয়, পথচারীরা সেদিকে কদাচিৎ নজর দেয়। কারণ, এ রকম ঘটনা দেখে যে সবাই অভ্যস্ত! গ্রিসের সেই প্রাচীন সভ্যতার অবসানের পর কত যুগ কেটে গেছে! এখন দেশটির ৯৮ শতাংশ মানুষ নিজেদের অর্থোডক্স খ্রিষ্টান হিসেবেই পরিচয় দেয়। অর্থোডক্স চার্চের একজন কর্মকর্তা গ্রিক পুরাণের বর্তমান অনুসারীদের সম্পর্কে ২০০৭ সালে বলেন, ওরা একটি মৃত ধর্মকে পুনরুজ্জীবিত করার ঘৃণ্য কাজে মগ্ন হয়েছে। তবে পৌরাণিক সংস্কৃতির অনুসারীদের প্রতি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাচ্ছে বলে মন্তব্য করেন দর্শনের অধ্যাপক ত্রাইফন অলিম্পিয়স। রিটার্ন অব দ্য হেলেনিস নামের একটি আন্দোলন তাঁর হাত ধরেই ১৯৯৬ সালে যাত্রা শুরু করে। তিনি বলেন, ‘জনগণ বুঝতে পেরেছে যে আমরা বিপজ্জনক বা খ্রিষ্টানবিরোধী বা অশুভর পূজারি নই। আমরা শান্তিপ্রিয় এবং সমাজের জন্য প্রয়োজনীয় ধ্যান-ধারণার প্রবর্তনের পক্ষপাতী। গ্রিসের বর্তমান অর্থনৈতিক মন্দা একটি বড় সংকট। এই সংকটকালে আমাদের পুরোনো আদর্শের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে যাচাই করে নেওয়া উচিত।’

পৌরাণিক পুনর্জাগরণ আন্দোলন মূলত প্রাচীন গ্রিসের ১২ জন দেব-দেবীর ওপর গুরুত্ব দেয়, কেবল জিউস ও হেরার ওপর নয়। এই দেবদেবীরা সৌন্দর্য, সুস্থতা বা প্রজ্ঞার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হন। বর্তমান অনুসারীদের মধ্যে রয়েছে নানা মিশ্রণ। তাঁদের কেউ মনে করেন, গ্রিসের অর্থোডক্স চার্চ ও জাতীয়তাবাদীরা দেশটির মৌলিক অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে।

আধুনিক যুগে গ্রিসের পৌরাণিক দেব-দেবীদের ঠাঁই হয়েছে বিভিন্ন জাদুঘর, দর্শনের প্রাচীন বইপত্র, সিডি, খাবার, অলংকার ও পোশাক-পরিচ্ছদে।

তিন দিনের উৎসবে গণপ্রার্থনা, দুটি বিয়ে ও নামকরণের অনুষ্ঠান থাকে। পৌরাণিক সংস্কৃতির অনুসারীরা আধুনিক খ্রিষ্টান নামের পরিবর্তে বেছে নেন কালিস্তো, হার্মিস বা অর্ফিয়ুসের মতো প্রাচীন ঘরানার নাম। অবশ্য এসব আচার অনুষ্ঠানের কোনোটিই গ্রিসে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত নয়। পৌরাণিক পুনর্জাগরণবাদীরা বহু চেষ্টা করেও প্রাচীন মন্দিরগুলোতে প্রার্থনার অনুমতি আদায়ে ব্যর্থ হয়েছেন। আবার নিজস্ব মন্দির প্রতিষ্ঠার সুযোগও তাঁদের দেওয়া হচ্ছে না। কারণ, এতে স্থানীয় অর্থোডক্স ধর্মগুরুর (বিশপ) অনুমোদন প্রয়োজন।


গ্রিসে পৌরাণিক ধর্মচর্চাকে একটি বিশেষ জনগোষ্ঠীর (এথনিক) ধর্ম হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য আন্দোলন করে যাচ্ছে সুপ্রিম কাউন্সিল অব এথনিকোই হেলেনিস নামের একটি সমমনা সংগঠন। তবে এই দাবির প্রতি খুব কম মানুষেরই সমর্থন রয়েছে বলে মনে করেন সাইপ্রাস বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক ও গ্রিক ধর্মবিশেষজ্ঞ ভিক্তর রোওদোমেতফ। তিনি বলেন, বছরের কেবল নির্দিষ্ট কিছু দিনে গ্রিকদের অর্থোডক্স চার্চে যেতে দেখা গেলেও এই খ্রিষ্টধর্মই দেশটির পরিচয়ের ভিত্তি। প্রাচীন ধর্মের পূজারিদের তৎপরতাকে ‘কৌতূহলীদের আকর্ষণ’ ছাড়া আর কিছু বলার সুযোগ নেই।

যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচীন ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক রবার্ট পার্কার বলেন, ঘড়িকে উল্টো দিকে চালানো অসম্ভব। সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিবেশ ও সামাজিক ব্যবস্থায় একটি প্রাচীন ধর্মকে পুনরায় প্রবর্তনের উপায় নেই। তাই এ ধরনের চেষ্টা করাটা রীতিমতো ‘পাগলামি’ ও ‘হাস্যকর’।

পৌরাণিক ধর্মের অনুসারীদের মোট সংখ্যার কোনো আনুষ্ঠানিক হিসাব না থাকলেও ১৭ বছর আগে মাউন্ট অলিম্পাসে প্রথম সমাবেশের পর থেকে তাদের সংখ্যা বহু গুণে বেড়েছে নিঃসন্দেহে। ধারণা করা হয়, এই সংখ্যা প্রায় এক লাখ।

পৌরাণিক যুগে ফেরার এই প্রয়াস নিয়ে যে যা-ই বলুক, মাউন্ট অলিম্পাসে প্রতিবছর নিয়মিত আয়োজিত হয় প্রমিথিয়া উৎসব। সেখানে বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানের পর চাঁদের আলোয় সমবেত নৃত্য আর আনন্দ-উদ্যাপনের একটা আলাদা আবেদন তো অবশ্যই আছে।

সূত্র: বিবিসি অনলাইন