মনে হতো, আমার আব্বু এমন কেন?

ক্লাস সিক্সে ওঠার আগেই আব্বুর কাছে বায়না ছিল, একটা হিরো রেঞ্জার সাইকেল। সিক্সে ওঠার পর জেদটা জোরালো হলো। কিন্তু আব্বু কিছু বলতেন না। তাঁর এই নীরবতায় আমার ভীষণ অভিমান হতো। মনে হতো, আমার আব্বু এমন কেন? একটা সাইকেল কিনে দিলে কী হয়?

সাইকেল বিষয়ে আম্মু কিন্তু কোনো কথা বলতেন না। এখন বুঝি, তিনি হয়তো বাবা-ছেলের আকাঙ্ক্ষা এবং চাহিদার সমীকরণ মেলানোর চেষ্টা করতেন। না হলে, সাইকেলের জন্য আমি যখন নাছোড়, এমনই একদিন মেজ মামাকে ফোন করবেন কেন। মামাও আমার মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে দ্রুতই একটা সাইকেল কিনে দিলেন। নিজে কিনে দিতে না পারার খচখচানি আব্বুর ভেতরে হয়তো ছিল, কিন্তু সেই কষ্ট আড়াল করে আমার আনন্দে হাসতে কার্পণ্য করলেন না। এত কিছু তখন তো আমি আর বুঝি না। সাইকেল পেয়েই খুশি। আব্বুর ওপর রাগ-অভিমানও চলে গেল।

বাবার কিনে দেওয়া বাইসাইকেলের রং হয়তো বদলেছে, তবে হারিয়ে যায়নি
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

বন্ধুদের নতুন সাইকেল দেখাতে সেদিনই বেরিয়ে পড়লাম। সারা দিন ঘোরাঘুরি করে ঠিক সন্ধ্যার দিকে বাড়ি ফিরলাম। বারান্দায় সাইকেলটা রেখে হাত-মুখ ধুয়ে পড়তে বসে গেলাম। নতুন সাইকেল পেয়েছি, পড়া নিয়ে টালবাহানা করার আর উপায় নেই। এরই মধ্যে আম্মু এসে বললেন, সাইকেলটা ঘরে তুলে রাখ। কিন্তু বারান্দায় গিয়েই আমার চোখ ছানাবড়া। শূন্য বারান্দা। আমার নতুন সাইকেল কই?

পুরো এলাকা তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখা হলো। কোথাও সাইকেলের খোঁজ পাওয়া গেল না। কষ্টে আমার ভেতরটা ভেঙে খান খান হয়ে গেল। ডুকরে কাঁদতে থাকলাম। রাতভর অবিরাম কাঁদলাম। আব্বু-আম্মু সে রাতটা আমার পাশে বসে কাটালেন।

পরদিন সকালে আব্বু যথারীতি অফিসে চলে গেলেন। কিন্তু আমি স্কুলে গেলাম না। কেউ কিছু বললও না। মুখটি ভার করে ঘরে বসে থাকলাম। সাইকেল হারানোর শোকে আমি কাতর। কে তখন কী বলবে!

পাঁচটার পর সাধারণত অফিস থেকে ফিরতেন আব্বু। কিন্তু সেদিন সন্ধ্যার পরও আব্বু এলেন না। আম্মুকে জিজ্ঞেস করলাম। বারবার তিনি জবাব এড়িয়ে গেলেন। বুঝতে পারছিলাম কিছু একটা হয়েছে। কিন্তু কী এমন হলো যে আম্মু এমন করছেন।

রাত আটটার দিকে বাড়ির দরজায় কড়া নড়ল। দৌড়ে গেলাম দরজা খুলতে। হ্যাঁ, আব্বুই দাঁড়িয়ে। সঙ্গে একটা লাল রঙের বাইসাইকেল!

আগের রাতের সাইকেল হারানোর শোক মুহূর্তেই বাঁধভাঙা আনন্দে রূপ নিল। আমি ভুলে গেলাম হারানো সাইকেলের কষ্ট।

সেদিন সাইকেল পেয়ে যতটা খুশি হয়েছিলাম, এমন খুশি আর কোনো কিছু পেয়ে হয়েছি বলে মনে হয় না। তবে ধার করা টাকায় আব্বুর কেনা বাইসাইকেল সেদিন আমার খুশি ফিরিয়ে দিয়েছিল সত্যি, কিন্তু আজও তা নীরবে কাঁদায়।