মেয়েকে লেখা বাবার খোলা চিঠি

‘নিজের লড়াইটা নিজে লড়ে গেলেই তোর জেতার আশাটা বেশি। তোর বাবার সবটুকু আশীর্বাদ তোর সঙ্গে থাকবে।’ ছবিটি প্রতীকী।
‘নিজের লড়াইটা নিজে লড়ে গেলেই তোর জেতার আশাটা বেশি। তোর বাবার সবটুকু আশীর্বাদ তোর সঙ্গে থাকবে।’ ছবিটি প্রতীকী।

ভারতে মেয়েদের জন্য বিপদ যেন ওত পেতে আছে সবখানেই। ট্যাক্সিতে, বাসে, ট্রেনে, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিপদ ঘাপটি মেরে আছে অফিস-হাসপাতাল এমনকি বাড়িতেও। পথে-ঘাটে ধর্ষণের ​শিকার হচ্ছে মেয়েরা। রাজধানী নয়াদিল্লি থেকে শুরু করে দেশটির শহর-বন্দর-গ্রাম। পুরো ভারতেই ধর্ষণ হচ্ছে। একা কিংবা দলবেঁধে পুরুষেরা এই ধর্ষণ করছে। শত প্রতিবাদ–বিক্ষোভেও এই নির্মম পাশবিকতা বন্ধ হচ্ছে না। এই নিরাপত্তাভীতি মেয়েদের জন্য এমনিতেই প্রতিকূল বাস্তবতাকে আরও কঠিন করে তুলছে। কঠিন এই সময়ে বসে এক মেয়েকে চিঠি লিখেছেন এক বাবা। তিনি ভারতের শক্তিমান অভিনেতা মনোজ বাজপেয়ি। প্রথম আলোর পাঠকদের জন্য হাফিংটন পোস্ট–এ প্রকাশিত সেই চিঠি।

প্রিয় আভা,

অনেক দিন আগে তোর ফুপু দিল্লিতে এসেছিল নিজের ভেতর গড়ে উঠতে থাকা স্বপ্নগুলো পূরণের জন্য। ও যেদিন একটা ফ্যাশন ইনস্টিটিউটে কাজে যোগ দিল, সেদিনই আমি ওকে একটা কথা বলেছিলাম, ‘তোকে বাসে করে কাজে যেতে হবে। ভাই হিসেবে তোকে এভাবে পাঠানোটা আমার জন্য মোটেই স্বস্তির না। কিন্তু তোকে গাড়ি কিনে দেওয়ার ক্ষমতা তো আমার নেই। আর, আমাদের সামনে দুনিয়াটা এমনই, সব নারীকে প্রতিটা দিনই এই দুনিয়া মোকাবিলা করেই টিকে থাকতে হচ্ছে।’

আভা, আমি সত্যিই জানি না তুই কী করে এই দুনিয়াটা সাহসে ভরে তুলবি। জগতের অন্ধকার দিকটা থেকে তোকে রক্ষা করতে, তোকে বাঁচাতে সব সময় আমি পাশে থাকতে পারব না।

নিজের পথটা তোর নিজেকেই খুঁজে নিতে হবে, যা কিছু তোকে আটকে রাখতে চাইবে সেগুলোর সমাধানও তোকেই বের করতে হবে। নিজের হাতিয়ার নিজেই তৈরি করবি। আর কখনোই স্বপ্নের পেছনে দৌড়ানোটা ছাড়বি না। কে বলবে, এই দুনিয়া নিরাপদ এবং আগামী দিনেও নিরাপদ থাকবে? নিজের মতো করে বাঁচতে শিখলেই দুনিয়াটা তোর হবে।

প্রথম দিন থেকেই এই দুনিয়া মানুষের জন্য লাগাতার চ্যলেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে আসছে, আর মেয়েদের জন্য সব সময়ই এই চ্যালেঞ্জ আরও বেশি কঠিন ছিল। এখনো তা তেমনি কঠিন আছে।

তোর ফুপু এই কঠিন পথেই পা বাড়িয়েছিল, আর আজ সে নিজের যোগ্যতাতেই ফ্যাশন ডিজাইনার হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। ও নরকের মধ্য দিয়ে গেছে। মরমে মরে গিয়ে আমি তোকে বলছি, নিজের পায়ে দাঁড়া আর ওই সমাজকে পাল্টা চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দে; যেখানে শুধু মেয়ে হওয়ার কারণেই দুনিয়াটা তোর জন্য আরও কঠিন করে তোলা হয়।

সব কঠিনকে মোকাবিলা কর। যে মেয়ে সোজাসুজি চোখের দিকে তাকিয়ে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রস্তুত, দুনিয়া তার সামনেই মাথা নত করে। একবার তোর মায়ের কথা ভাব। যে মুম্বাইয়ে এসে নিজের জোরেই অক্লান্ত পরিশ্রম করে গেছে। শত কঠিনের মধ্যেও তোর মা কখনো তো হাল ছাড়েইনি বরং তোকে জন্ম দেওয়ার সময় পর্যন্তও আপ্রাণ লড়াই করে গেছে। আমার মায়ের পর সে-ই আমার জীবনের আদর্শ নারী।

আমি জানি তুই তোর মায়ের মেয়ে, তোর ফুপুর ভাতিঝি আর তোর বাবার কলিজার টুকরা। তোর দুই হাতভরা পাথেয়। তোকে শুধু এই দুনিয়াটা মোকাবিলা করার শক্তি অর্জন করতে হবে।

আমি বলছি না যে এটা খুব সহজ।

আমি একসময় অনেক বুড়ো হয়ে যাব, কিন্তু কী করা, এই দুনিয়া তো সঠিক না।

আভা, আমার ইচ্ছা করে আমি যদি তোর পাশে পাশে থেকে তোকে পথ দেখাতে পারতাম! তোকে বলতে পারতাম, কী করতে হবে! তোর বাবা হিসেবে এটাই মনে হয় আমার প্রথম চাওয়া। কিন্তু আমি নিশ্চিতভাবেই জানি রে—তুই যখন তোর যৌবনে থাকবি, ততদিনে আমি আর থাকব না।

মানুষজন তোকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে চাইবে, কিন্তু আমি খুবই আশাবাদী যে তুই তা হতে দিবি না। তুই সহজে পরাজয় মেনে নিবি না, কেননা তুই আমাদের মেয়ে এবং আমরা নিজের জোরেই বেঁচেছি। সব সময়।

আমি আশা করে থাকব যে, একদিন কেউ একজন তোকে এই চিঠিটা দেখাবে আর তোর কঠিনতম সময়ে এই চিঠি তোকে সাহস আর শক্তি দেবে। ওই ব্যক্তিকে পরাস্ত কর, যে তোর শক্তিকে গুঁড়িয়ে দিতে চায়, যে তোর লক্ষ্য আর স্বপ্ন ভেঙে দিতে চায়।

যোদ্ধার মতো লড়াই কর, সিংহীর মতো রুখে দাঁড়া। এর পরও যদি পরাজয় আসে, সেটা মেনে নিতে হবে। কারণ ঘোড়ায় চেপে বসতে না পারলে তো সারা জীবন কেবল দর্শক হয়েই থাকতে হবে। আর কখনোই দর্শকের কাছ থেকে সাহায্য আশা করবি না। নিজের লড়াইটা নিজে লড়ে গেলেই তোর জেতার আশাটা বেশি। তোর বাবার সবটুকু আশীর্বাদ তোর সঙ্গে থাকবে।

অযুত ভালোবাসায়,
তোর বাবা
মনোজ বাজপেয়ি